বর্তমানে জন সংখ্যা বৃদ্ধি একটি গুরুতর সমস্যা, যার ফলে সমগ্র দেশে খাদ্য শস্য উৎপাদন যথেষ্ট ভাবনার কারণ। এই বিপুল জন সংখ্যার জন্য পরিমিত ও গুণগত খাদ্য সরবরাহ করা এবং একই সঙ্গে মাটির উর্বরতা বজায় রাখা কৃষিতে একটি প্রধান চ্যালেঞ্জ। অত্যধিক পরিমাণে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক প্রয়োগ মাটির উর্বরতা দ্রুত ধ্বংস করছে, যা গুণগত ও সুষম খাদ্য উৎপাদনে ব্যাঘাত সৃষ্টি করেছে। শুধু তাই নয়, মানুষের শরীরের পক্ষেও অত্যন্ত ক্ষতিকারক প্রভাব বিস্তার করেছে এই রসায়ন। এই পরিস্থিতি সবথেকে ভয়ানক আকার ধারণ করছে তণ্ডুল বা দানা শস্যের ক্ষেত্রে, বিশেষত ধান উৎপাদন, যেখানে রাসায়নিক সারের প্রয়োগ সবচেয়ে বেশি। জটিল পরিস্থিতিতে সবুজ সারের প্রয়োগ একটি টেকসই সমাধান। শিম্ব গোত্রীয় সবুজ সার ধানের নাইট্রোজেন চাহিদার বেশ কিছুটা অভাব পুরণ করে এবং সেই সঙ্গে মাটিতে যথেষ্ট পরিমাণে জৈব পদার্থ যুক্ত করে যা মাটির উর্বরতা বৃদ্ধির সহায়ক হয়। বর্তমানে ধঞ্চে গরীব চাষী ভাইদের অপরিহার্য একটি সার এবং বিকল্প সমাধান। শিম্ব গোত্রীয় হওয়ায় এই ফসলের গুণ বহুবিধ। এটি মাটির রাসায়নিক, ভৌতিক এবং জৈবিক স্বাস্থ্যকে সুরক্ষিত করে। মাটিতে বসবাসকারী বিভিন্ন উপকারী জীবাণুর বংশ বৃদ্ধি এবং আধিক্য বৃদ্ধি করে, মাটির গঠন, গ্রোথন, জলধারণ এবং বায়ু চলাচল ক্ষমতার উন্নতি ঘটায়, মাটির প্রাণ হিউমাস গঠন করে এবং বিভিন্ন মৌলিক ও যৌগিক খাদ্যের ক্ষমতা বজায় রাখতে সহায়তা করে।

_সবুজ সারঃ_ ক্রমবর্ধমান উষ্ণতা বৃদ্ধির এই সংকট জনক পরিস্থিতিতে মাটির নিজস্ব হিউমাস দ্রুত সমাপ্তির দিকে, তাই সুষম সারের উপুর্যুপরি প্রয়োগ মাটির হিউমাস গঠনের জন্য আবশ্যকীয়, যা মাটিকে উর্বর এবং সুস্থ রাখতে সাহায্য করে, নিয়মিত নাইট্রোজেন সারের সরবরাহ করে এবং উপকারী জীবাণু গুলির বংশ বৃদ্ধি ঘটায়। সেক্ষেত্রে সবুজ সার খুবই গুরুত্বপূর্ণ, মাটির গঠন এবং উৎপাদনশীলতাই বৃদ্ধির চাবিকাঠি। শিম্ব গোত্রীয় ফসল চাষ করে কচি ও সবুজ অবস্থায় মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিলেই সবুজ সার হয়। এই ফসল সরাসরি জমিতে চাষ করে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে কিংবা অন্য জমিতে ফসল চাষ করে তার পাতা ডালপালা কেটে চাষের জমিতে মিশিয়ে দেওয়া হয়। শিম্ব জাতীয় ফসলে (ধঞ্চে, শন, বরবটি, কলাই) শিকড়ে থাকা রাইজোবিয়াম জীবাণু বাতাসের নাইট্রোজেন আবদ্ধ করে জমির উর্বরতা বাড়ায়। এই রাইজোবিয়াম জীবাণু শিকড়ের গুটির মধ্যে নাইট্রোজেন সঞ্চয় করে। বিভিন্ন পরিবেশ অনুযায়ী রাইজোবিয়াম জীবাণু একক প্রতি ২০-৩০ কেজি পর্যন্ত নাইট্রোজেন যোগান দিতে পারে। শিম্ব জাতীয় ফসলের বীজের সাথে রাইজোবিয়াম মিশিয়ে ব্যবহার করতে হয়। সবুজ সার হিসাবে ধানের জমিতে (বিশেষত আমন ধান) জমিতে ধঞ্চের চাষ সবচেয়ে বেশি করা হয়।

_ধঞ্চে:_ শিম্ব গোত্রীয় সবুজ সারের মধ্যে ধঞ্চে ধান চাষের সবচেয়ে উপকারী এবং রাসায়নিক সারের বিকল্প সুরাহা। এর প্রচলিত নাম ধাঞ্চি, ধঞ্চে, ধইঞ্চা ইত্যাদি। এশিয়া মহাদেশে এবং ভারতে সব চেয়ে প্রচলিত ধঞ্চের প্রজাতি হল- _Sesbania acculeata_ এবং _Sesbania rostrata_ । _Sesbania acculeata_ প্রধানত মূলে গুটি তৈরি করে, এটি ১ থেকে ২ মিটার অবধি লম্বা এবং দ্রুত বৃদ্ধিকারী গাছ। এটি ভেজা কাদামাটি, শুকনো মাটি, স্বল্প লবণাক্ত জমি সহ সব ধরণের মাটিতেই জন্মায়। ভারতের বিস্তীর্ণ এলাকায় চাষ করা হয় এই ফসল।

Sesbania rostrata হল এমন একটি শিম্বী গোত্রীয় উদ্ভিদ যা কাণ্ডে মূলে গুটি তৈরি করে নাইট্রোজেন আবদ্ধ করে। জল মগ্ন জমিতে এই গাছের বৃদ্ধি ভালো হয়।

_ধঞ্চের উপকারিতা:_
১) ধঞ্চে মাটির ভৌত ধর্মের মান যেমন গঠন, গ্রোথন, জল চলাচল, বায়ু চলাচল ক্ষমতা ইত্যাদির উন্নতি ঘটায়।
২) এই ফসল মাটিতে সবুজ অংশ যোগ করে মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি করে এবং মাটির হিউমাস গঠনে সাহায্য করে।
৩) মাটিতে বসবাসকারী উপকারী জীবাণুগুলির বংশ বৃদ্ধি করে এবং তাদের আধিক্য ঘটাতে মাটিতে উপস্থিত উদ্ভিদ খাদ্য মৌল গুলিকে গাছের গ্রহণযোগ্য অবস্থায় পরিবর্তন করে।
৪) ধঞ্চে শিকড়ে থাকা জীবাণুর মাধ্যমে বাতাসের নাইট্রোজেন আবদ্ধ করে জমির উৎপাদনশীলতা বাড়ায়।
৫) এই সবুজ সার নিজের শিকড়ের মাধ্যমে মাটির গভীর স্তরে খনিজ মৌলকে ওপরের স্তরে নিয়ে এসে গাছের ব্যবহারোপযোগী করে তোলে।
৬) ধঞ্চে মাটির বায়ু চলাচল ক্ষমতা বজায় রাখে এবং মাটিতে জল অনুপ্রবেশে সাহায্য করে।
৭) ভূমিক্ষয় রোধ ধঞ্চের আরও একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য।
৮) জলমগ্ন জমিতে মাটির অম্লতার ভারসাম্য রক্ষা করে এবং ফসফরাসের প্রাপ্যতা বৃদ্ধি করে।
৯) এটি একটি সুষম গোখাদ্য হিসাবেও ব্যবহার করা হয়।
১০) ধানের জমিতে ধঞ্চের প্রয়োগ শুধু ধানের উৎপাদনশীলতা বাড়ায় তাই নয়, পরবর্তী ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

_সবুজ সার হিসাবে ধঞ্চে গাছের বৈশিষ্ট্য:_
FAO বা বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (1977) IRRI বা আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠান (1988) -এর ভাষ্য অনুসারে নিচু জমি এলাকায় একটি প্রধান সবুজসার হচ্ছে ধঞ্চে। সবুজ সার হিসাবে জমিতে প্রয়োগের জন্য এর কিছু অত্যাবশ্যকীয় বৈশিষ্ট্য নিচে উল্লেখ করা হল:

দ্রুত অঙ্কুরিত ও প্রতিষ্ঠিত হবার ক্ষমতা রয়েছে এর এবং উন্নত চারা তৈরিও করতে পারে। ক্ষরা ও বন্যা সহনশীল এই উদ্ভিদ। রয়েছে দ্রুত নাইট্রোজেন আবদ্ধকরণের ক্ষমতা। সব ধরনের আবহাওয়াতে বেড়ে উঠার ক্ষমতাও আছে। দ্রুত বৃদ্ধি এবং সবুজ নরম ডাল পালা পাতা তৈরির ক্ষমতা সম্পন্ন। এর দ্রুত পাচনশীলতা সার হিসাবে অধিক গ্রহণযোগ্য।

_ধনঞ্চে চাষের পদ্ধতিঃ_
_জমি তৈরিঃ_ জমিতে শুধু ধঞ্চে লাগানোর জন্য দুটো থেকে তিনটে কর্ষণই যথেষ্ট।
_উপযুক্ত তাপমাত্রাঃ_ ধঞ্চে চাষের জন্য সবচেয়ে উপযোগী হল ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তার উপরের তাপমাত্রা অর্থাৎ কিছুটা গরম আবহাওয়া।
_বীজের হারঃ_ যেখানে আগাছার আধিক্য কম সেক্ষেত্রে বর্ষার আগে ৩০-৪০ কেজি/হেক্টর হারে ধঞ্চের বীজ জমিতে ছিটিয়ে দেওয়া হয়। উপযুক্ত হলকর্ষণ এবং জলসেচের সাহায্যে বীজের হার কিছুটা কমিয়ে ১৫-২০ কেজি/হেক্টর করা যেতে পারে। সাধারনত ১০০০ টি ধঞ্চের বীজের ওজন ১৪ থেকে ১৮ গ্রাম পর্যন্ত হয়। বীজের অঙ্কুরদ্গম উন্নত করার জন্য ১০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে জলে মাত্র ৩ সেকেন্ড ডুবিয়ে রেখে বীজ পরিশোধন করা হয়। খেয়াল রাখতে হবে এর ব্যতিক্রম যেন না হয়।
_জলসেচঃ_ ধঞ্চেতে সাধারণত প্রচুর জল ও জলমগ্ন অবস্থার প্রয়োজন হয় না। কিন্তু সঠিক সময়ে পরিমিত জলসেচ গাছের দ্রুত বৃদ্ধির সহায়তা করে। যদি মাটি শুকিয়ে ফাটল ধরে তাহলে ধঞ্চের পাতা ঝরে যায় এবং গাছের বৃদ্ধি হ্রাস পায়।
_জমিতে মেশানো-_ সবুজ সার হিসাবে আমন ধানের জমিতে ধঞ্চের চাষ সবথেকে বেশি করা হয়। এই জন্য জ্যৈষ্ঠ মাসের মাঝামাঝি বৃষ্টিতে আমন ধানের জমিতে লাঙ্গল দিয়ে একর প্রতি ১২ থেকে ১৫ কেজি ধঞ্চের বীজ বোনা হয়। সেই সঙ্গে ৬০ কেজি সিঙ্গেল সুপার ফসফেট একর প্রতি প্রয়োগ করা হয়। বীজ বোনার পাঁচ থেকে ছয় সপ্তাহের মাথায় (৩৫-৪০ দিন বয়সে) গাছ নরম থেকে অবস্থায় লাঙ্গল দিয়ে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়। এই সময়ে মাটিতে উপযুক্ত রস থাকা প্রয়োজন। সাত থেকে আট দিনে ধঞ্চে গাছ পচে গিয়ে জৈবসারে পরিণত হয়। ধঞ্চে গাছ শক্ত হয়ে গেলে লাঙ্গল দিতে অসুবিধা হয় এবং পচতে বেশি সময় লাগে। এই পদ্ধতি অনুসরণ করলে আমন ধান রোয়ার আগে আর কোনো ফসফেট সার দিতে হয় না। সেই সঙ্গে ধানের মোট নাইট্রোজেন সারের ১/৩ অংশ ওই ধঞ্চে থেকে আসে। একর প্রতি প্রায় ২ টন জৈবসার জমিতে যুক্ত হয়। এই পদ্ধতিকে সবুজ সার প্রয়োগ বা ইংরাজিতে GREEN MANURING বলে।

আরেকটি ধনঞ্চে প্রয়োগের পদ্ধতি হল বাদামী সার প্রয়োগ বা BROWN MANURING। এক্ষেত্রে একই সঙ্গে ধান এবং ধনঞ্চে চাষ করা হয়। এক্ষত্রে বীজের হার ২০ কেজি/হেক্টর রাখা হয় এবং ধান রোয়ার তিন দিন পড়ে ধনঞ্চের বীজধানের জমিতে ছড়ানো হয়। ৩০ দিন পর আগাছা নাশক হিসাবে 2,4/D ইথাইল এস্টার ব্যবহার করা হয় ধঞ্চে কে নষ্ট করার জন্য। ফলে ধীরে ধীরে ধঞ্চে গাছ শুকিয়ে বাদামী রঙ ধারণ করে এবং মাটিতে মিশে যায়। বাদামী সারের মাধ্যমে মাটিতে ৩৫ কেজি/হেক্টর নাইট্রোজেন যুক্ত হয়। এবং মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি পায়।

_উপসংহারঃ_
অতিরিক্ত হারে রাসায়নিক সারের প্রয়োগ এক দিকে যেমন ফসলের উৎপাদন বাড়িয়ে বিপুল জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা মেটাচ্ছে, অপর দিকে ডেকে আনছে পরিবেশ এবং মাটির অভিশাপ। শুধুমাত্র মাটির অস্বাস্থ্যই নয়, পরিবেশ দূষণেরও কারণ অত্যাধিক রাসায়নিক সারের প্রয়োগ। এমতবস্থায় চাষি ভাইদের কাছে আশার আলো হল এই সবুজ সার। সবুজ সার হিসাবে ধঞ্চের উপকার অনস্বীকার্য। এটি খাদ্যের গুণগত মান বজায় রাখে এবং মাটির উর্বরতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। সুতরাং সবুজ সার হিসাবে ধঞ্চের চাষ এবং ধানের জমিতে প্রয়োগ একটি পরিবেশবান্ধব পদ্ধতি, যা শুধু বর্তমান সময়ের উপযোগীই নয়, ভবিষ্যতেও এর অবদান উজ্জ্বল হয়ে উঠবে।


[ *লেখক পরিচিত: রম্যজিৎ মণ্ডল, শস্য বিজ্ঞান বিভাগ, বিধান চন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, মোহনপুর, নদীয়া।* ]

_প্রস্তুত প্রবন্ধটি ‘ভারতীয় কিষান বার্তা’-র জৈবকৃষি বিশেষ সংখ্যার অন্তর্গত। ১ লা ডিসেম্বর, ২০২০। সম্পাদক ড. কল্যাণ চক্রবর্তী।_ ( _Bharatiya Kishan Barta, Organic Farming Special Issue, 1 December, 2020, Editor: Dr. Kalyan Chakraborti)_

রম্যজিৎ মণ্ডল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.