অমরবঙ্গজ্যোতিষ্ক
পবিত্র ভারতভূমি বহু মহামানবের আবির্ভাধন্য। আমি প্রথমে যে মহাপুরুষটির কথা বলিব তিনি সেইসব নির্বোধদের মধ্যে পড়েন না যাঁহারা নিজের জীবন বিপন্ন করিয়া দেশোদ্ধারে ব্রতী হইয়াছিলেন। সেই মন্দবুদ্ধি মহামানবদের কাহারও কপালে জুটিয়াছিল প্রবাসে মৃত্যু, কাহারও মৃত্যুপূর্বে চরম অবহেলা ও একাকিত্ব, কাহারও বা অপমৃত্যু।
অর্থনীতিতে “rational man” সংজ্ঞায়িত হইয়াছে এইরূপে – “who tries to maximize his utility” অর্থাৎ নিজ স্বার্থরক্ষায় সদা সচেষ্ট। আমাদের বহুজন শ্রদ্ধাভাজন মহাপুরুষটি এই rationality-র জোরে দীর্ঘ চল্লিশ বৎসর রাজত্ব থুড়ি মন্ত্রীত্ব চালাইয়া শাসনতন্ত্রের পরিবর্তে দলতন্ত্র নামক একটি ব্যবস্থার ভিত সুদৃঢ় করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন। প্রসঙ্গত ‘দাস ক্যাপিটা’ একটি অর্থনীতিরই পুস্তক।
সর্বহারার প্রতিনিধিত্ব করিতে এই মানুষটি দখল লইয়াছিলেন ‘ইন্দিরা ভবন’ নামক একটি সুরম্য সরকারি অট্টালিকার যথা হইতে তাঁহাকে অবসর গ্রহণের পরেও সরানো যায় নাই। দীর্ঘজীবি এই নেতা প্রবীণ বয়স পর্যন্ত অনেক নবীনকে রূপ লাবণ্যে টেক্কা দিতে পারিতেন। তাঁহার রূপ লাবণ্যের গোপন রহস্য – নিশ্চিন্ত জীবন, পরিমিত সুখাদ্য, খাস স্কটল্যান্ডে প্রস্তুত যবজাত পানীয়, নিয়মিত বিদেশবাস ইত্যাদি।
১৯৬২-তে ভারতে চিনা আগ্রাসনের সময় যথার্থ কমিউনিস্টের ন্যায় চিন প্রীতি ও স্বদেশ বিদ্বেষ দেখাইয়া প্রতিক্রিয়াশীল কেন্দ্রীয় সরকারের ষড়যন্ত্রে কয়েক মাসএর জন্য কারাবরণ করেন। এইরূপ উদ্ভট জাতীয়তাবোধের শাস্তি মহাচিনেও নিশ্চিত মৃত্যুদণ্ড। কিন্তু ভারত যুক্তরাষ্ট্রের মহান গণতান্ত্রিক ছত্রছায়ায় উদ্ভূদ কমিউনিস্ট নামক বিচিত্র জীবেরা দেশের স্বাধীনতা হইতে সার্বভৌমত্ব সবকিছুকে ধিক্কার ও ধাক্কা দিয়াও দিব্য বহাল তবিয়তে মুক্ত বিচরণ ও নিজেদের মুক্তচিন্তা দেশবাসীর মধ্যে অবাধে প্রচার করিয়া থাকেন।
বাংলার বিরোধী নেতা থাকা কালে তিনি শত সহস্র তরুণকে প্রতিবাদ প্রদর্শনের উপায় স্বরূপ বাস ট্রাম পোড়াইতে অনুপ্রাণিত করেন। যুক্তফ্রন্টের উপমুখয়মন্ত্রীত্ব লাভ করিয়াই তিনি দেশি-বিদেশি যাবতীয় সাম্রাজ্যবাদী পুঁজি বিতাড়নের উপায় ভাবিতে থাকেন। ১৯৭২ হইতে ১৯৭৭ কংগ্রেসি অরাজকতা। তাহার পরেই পশ্চিমবঙ্গে সুদিনের সূর্যোদয় লোহিত জ্যোতির উদ্ভাসে।
শোষক মালিক শ্রেণির বিরুদ্ধে সর্বহারার সংগঠনকে পোক্ত করিতে এই অবতার বাংলার মাটি হইতে একে একে তাবত পুঁজিপতিদের হটিতে বাধ্য করিলেন, বহু কল-কারখানায় তালা ঝুলাইয়া শ্রেণিসংগ্রামের আদর্শ প্রতিষ্ঠা করিলেন। তাঁহার আপন পুত্রটি সম্ভবত পুঁজি ছাড়াই শিল্পপতি রূপে সাফল্য লাভ করেন, কারণ মহামানবটির অপত্যস্নেহের পরিচায়ক ‘বেঙ্গল ল্যাম্প’ কেলেঙ্কারি উন্মোচিত হইলে বন্ধুবর আরএসপি-র যতিন চক্রবর্ত্তীর মস্তক যূপকাষ্ঠে বাঁধা পড়িলেও তাঁহার নিজের সাদা পাঞ্জাবিটিতে কাদার ছিটে লাগিতে পায় নাই।
এখন কল-কারখানা রূপ শোষণযন্ত্র তো বন্ধ হইল; কিন্তু তজ্জন্য কর্মহীন শ্রমিকদের দুর্দশা চর্মচক্ষুতে দর্শনের পীড়া কি সহ্য হয়? তাই সেই ক্লেশ নিবারণ হেতু বৎসরের অনেকটা সময় বিশেষত গ্রীষ্মকালটা মহামানবকে বিদেশ গিয়া অশ্রুমোচন করিয়া আসিতে হইত। বিদেশি বিনিয়োগ আমন্ত্রণই তাঁহার সফরের ঘোষিত উদ্দেশ্য হইলেও বাস্তবিক কোনও বিনিয়োগের বিষবৃক্ষ তিনি বঙ্গে রোপণ করেন নাই।
তাঁহার রাজত্বকাল নিয়মিত বন্ধ্, কলকারাখানায় লালবাতি, অজস্র নৃশংস লকআপ হত্যা, স্বজনপোষণ, পার্টি করার বিনিময়ে দপ্তরকার্যে নিষ্কৃতি, মধ্য-মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত ইংরেজি শিক্ষায় অব্যহতি, শিক্ষার সর্বস্তরে রাজনীতির প্রসার ইত্যাদি মহৎ কর্মের জন্য চিরস্মরণীয় হইয়া থাকিবে।
দলের প্রতি আনুগত্যের কারণে তিনি ‘ভূমিসংস্কার’ ব্যতীত অন্য কোনওরকম সংস্কার হইতে বিরত ছিলেন। বিনিময়ে দলও তাঁহাকে দিয়াছিল রাজকীয় জীবনযাত্রার নিশ্চয়তা। তাই দলের ‘ঐতিহাসিক ভুল’টি তাঁহার পরিপাক করিতে কষ্ট হইলেও একেবারে বদহজম হয় নাই।
দেশের সমসাময়িক প্রধানমন্ত্রীকে ‘ঐ মহিলা’, রাজ্যের বিরোধী নেত্রীকে ‘বাজে মেয়ে’, আপাত বিরোধী দলকে ‘গরু-ছাগলের দল’ ইত্যাদি মন্তব্যে সৌজন্য প্রতিভাসিত করিয়া, বানতলার নারকীয় ধর্ষণকাণ্ডকে ‘এমন তো কতই হয়’ বলিয়া লঘু করিয়া, অত্যাচারে মৃত পুত্রের শোকার্ত জননীকে ‘এমন দু-একটা হতেই পারে’ বলিয়া সান্ত্বনা দিয়া, অসংখ্য সাঁইবাড়ির ঘটনায় নির্লিপ্ত (মদতে) থাকিয়াই চব্বিশ বৎসর ক্ষমতায় বহাল ছিলেন। অন্যদিকে মাত্র দশ বৎসর মুখ্যমন্ত্রিত্ব চালানো কমরেডটি অতি কর্মতৎপরতা প্রদর্শনহেতু চৌত্রিশ বৎসরের দায় মাথায় লইয়া নির্বাচনে নাকাল হইয়া সক্রিয়া রাজনীতি হইতে কার্যত নির্বাসনে চলিয়া গেছেন।
আর আমরা? ভিভিআইপি ব্যবস্থাপনায় মহৎ ‘জ্যোতি’ষ্কটির হাসপাতালে ভর্তি থাকা কালে মিনিটে মিনিটে তাঁহার রক্ত, মূত্র, মল, জল, কফ, থুথুর রিপোর্টের বিশদ ধারাবিবরণী টিভি চ্যানেকগুলো হইতে মুখস্থ করিয়াছি; প্রাণস্পন্দহীন দেহটিকে যতক্ষণ সম্ভব সংরক্ষণ করিয়া আবেগের ফল্গুধারা ছুটাইয়াছি এবং শেষ পর্যন্ত পার্টি এই অমর নেতাটির চিরঅমরত্বপ্রাপ্তি সংবাদ স্বীকার করিলে কোটিতে কোটিতে অশ্রু অপনোদন পূর্বক শেষ যাত্রায় যোগ দিয়াছি। এবং অবশ্যই একদিনের একদিনের ছুটি উপহার পাইয়াছি।
রুমানিয়ার চাউসেস্কুকেও দুর্নীতির দায়ে জনমতের চাপে ক্ষমতাচ্যুত হইতে হইয়াছিল। কিন্তু পশ্চিমবাংলার চাউসেস্কু বসু পাইয়াছেন দেবতার আসন – তা দেবতার অস্তিত্ব কমিউনিজ়ম স্বীকার করুক বা না করুক।
খাতুন কী খিদমতমে
পূর্বোক্ত মহামানব তাঁর যোগ্য উত্তরসূরী নিজ দলের পরবর্তী মুখ্যমন্ত্রীর মধ্যে নয়, রাখিয়া গিয়াছেন তাঁহার প্রধানা বিরোধী দলনেত্রীর মধ্যে, যদিও সর্বসমক্ষে তাঁহাকে ‘বাজে মেয়ে’ বলিয়া একদা হতফেল্লা প্রদর্শন করিয়াছিলেন। এই মহীয়সী মহিলা দেখাইয়া দিয়াছেন শত্রুকে তাহারই অস্ত্রে ঘায়েল করিবার কৌশল। আসলে ঘোষিত শত্রুপক্ষের প্রাতঃস্মরণীয় নেতাটিই যে তাঁহার দীক্ষাগুরু।
তিনি যে মন্ত্রিত্ব, ক্ষমতা ও অর্থলোলুপ নন তাহা অতীতে একাধিকবার তুচ্ছ অজুহাতে এমনকি ‘কাকে কর্ণ লইয়া গিয়াছে’ জাতীয় ধূয়াতেও কর্ণপাত পূর্বক হেলায় মন্ত্রীত্ব ত্যাগ করত আপন তরণী আপন হস্তে বার বার ছিদ্র করিয়া প্রমাণ করিয়াছেন। সীতা সাবিত্রীর এই দেশে নারী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের মধ্যে ইন্দ্রিয় পরায়ণতার অভিযোগ আজ অব্দি উঠে নাই; আর এই দিদিমনিটি তো জীবনাচরণে ‘সন্ন্যাসিনী’। সুতরাং দুর্নীতি, অত্যাচার, কৃষক ও নারী-নিগ্রহের বিরুদ্ধে জ্বলন্ত প্রতিবাদস্বরূপিনী এই নেত্রী একাধিকবার সরকারি ও বেসরকারিভাবে প্রহৃত ও অসম্মানিত হইয়াও সংগ্রামের রাস্তায় অনড় অবস্থান দেখাইয়া পশ্চিমবঙ্গের জনমানসে প্রকৃতই আস্থা ও ভালোবাসা অর্জন করিয়া বিপুল জনসমর্থনে তাঁহার বহুপ্রতীক্ষিত মুখ্যমন্ত্রীর আসনটি যখন লাভ করিলেন, তখন বিপক্ষের অপপ্রচার যাহাই বলুক, সাধারণ মানষের কেহ প্রমাদ গোণেন নাই।
কিন্তু দিদিমনি অজ্ঞানে কিংবা সজ্ঞানে সমাজসেবার নেশায় ব্যাঘ্রের পৃষ্ঠে চড়িয়া বসিয়াছিলেন এবং সেই সমস্ত শ্বাপদকুল যখন নখ-দন্ত প্রদর্শন শুরু করিল, তখন তাহাদের উপর নেত্রীর প্রতি আনুগত্য ব্যতীত আর কোনও শর্ত আরোপ করেন নাই; বরং শারদা হইতে মৌলবাদী সন্ত্রাস সব কিছুতেই অনুগতদের প্রতি কল্পতরু হইয়াছিলেন। তাই রাজ্যে সিপিএম নামক হার্মাদ গোষ্ঠী ক্ষমতায় থাকা কালে যেখানে জুতা চুরির জন্যও সিবিআই তদন্তের দাবি জানাইতেন, সেখানে আজ রোমহর্ষক কদর্যতা ও নৃশংসতার ঘটনাতেও কুম্ভীরাশ্রু বিসর্জনের সৌজন্যটুকু না দেখাইয়া ঘটনার পশ্চাতে সোজা রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র অথবা সিপিএম-এর অপ্রচার অথবা মাওবাদী-ঝাওবাদী সন্ত্রাসের অকাট্য যুক্তি দেখাইয়া দেন। প্রসঙ্গত ভয়াবহ জ্ঞানেশ্বরী নাশকতা কাণ্ডে গোয়েন্দা তদন্ত স্পষ্ট মাওবাদী হস্তক্ষেপের প্রমাণ দাখিল করিলেও তৎকালীন রেলমন্ত্রী দিদি মাওবাদীদের অস্তিত্বই স্বীকার করেন নাই। আজ মা মাটি মানুষের প্রতিনিধিত্ব করিতে আসিয়া ষোল বৎসরের গণধর্ষিতা ও জীবন্ত অগ্নিদগ্ধা নাবালিকাকেও মাওবাদী হিসাবে দাগাইয়া দিতে ক্ষণমাত্র বিলম্ব করেন না।
প্রয়াত ও প্রাতঃস্মরণীয় সেই কমিউনিস্ট ‘জ্যোতি’ষ্কটির মতো মা-মাটি-মানুষের দিদি রাজকীয় তাচ্ছিল্য রপ্ত করিতে না পরিলেও অবলীলায় পরম দার্শনিকতা দেখাইতে পারেন, শরীরের অসুখের ন্যায় ধর্ষণও একটি ব্যধি বই কিছু নয়। আর সত্যের অপলাপ ও অস্বীকারের কৌশলটি তো নিষ্ঠা সহকারে অনুসরণ ও অবলম্বন করিয়া আপন ট্রেডমার্ক বসাইয়া ছাড়িয়াছেন। গুরুর ন্যায় পুত্রস্নেহ দেখাইবার উপায় নেই তো কী, ভ্রাতুষ্পুত্রের জন্য কি কিঞ্চিত নবাবির আয়োজন করিতে পারেন না?
তবে একটি ব্যাপারে তিনি যথেষ্ট সৎ ও ধারাবাহিক। তাহা হইল তথাকথিত সংখ্যালঘুদের নিয়ম বহির্ভূত গুরুত্ব প্রদান। দিদি মাথায় হিজাবতুল্য ঘোমটা টানিয়া নমাজের অভিনয়ে যতটা সাবলীল, টালিগঞ্জের চিত্রাভিনেত্রীরাও তাঁহার কাছ হইতে তালিম লইতে পারেন। তাই হয়তো চলচ্চিত্র জগৎ তাঁহার কাছে কিছু শিখিবার সদিচ্ছায় আকাশের তারকার অবস্থান হইতে তৃণমূলে অবতরণ করিয়াছে। আর চিত্রাঙ্কন তো দক্ষিণপন্থী দিদির বাঁয়ে হাত কা খেল। খেলাটা যে বাম হস্তেরই ছিল, শারদা প্রতারণা পরিকল্পনায় একের পর এক তৃণমূলী রাঘব বোয়ালদের নাম প্রকাশ্যে আসায় তাহা প্রাঞ্জল হইয়া উঠিয়াছে।
সিপিএম-এর আমল হইতেই পশ্চিমবঙ্গ ছিল সম্প্রদায় বিশেষের মৌলবাদের প্রত্যক্ষ সমর্থক ও নাশকাতাকামীদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল তথা পরোক্ষ মদতদাতা। সেই ঐতিহ্য মা-মাটি-মানুষের সরকার সযত্নে বহন করিয়া তাহার শাখা-প্রশাখা তথা মূল এত দূর ও এত গভীর পর্যন্ত বিস্তৃত করিয়াছে, যে পশ্চিমবাংলার গড়ে প্রতি বর্গ কিলোমিটারে একটি করিয়া মাদ্রাসা নামক অস্ত্রাগার ও জঙ্গীপ্রশিক্ষণ শিবির সরকারি মদতে জনগণের কষ্টার্জিত সম্পদে সবিশেষ সমৃদ্ধি লাভ করিয়া বাংলা কেন, সারা ভারতের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক মানচিত্র ‘পরিবর্তন’-এর ব্লু-প্রিন্ট রচনা করিয়া চলিতেছে। বর্ধমানের শিমুলিয়া সহ দু-একটি তুচ্ছ ঘটনায় জাতীয়তাবাদী মানে ‘গৈরিক সাম্প্রদায়িক’ কেন্দ্র সরকারি শাসক দল যে অনাবশ্যক তৎপরতা দেখাইতেছে, তাহা রাজনৈতিক প্রতিহিংসাপরায়ণতা ভিন্ন আর কিছু হইতে পারে না। সমগ্র রাজ্যবাসী এবং অতঃপর দেশবাসী যেখানে মাথায় ক্রুশে বোনা টুপি বা ওড়না ঢাকা দিয়া নমাজ পড়িলে বা পড়িবার ফটোশুট করিলেই ল্যাটা চুকিয়া যায়, সেখানে সামান্য অনিচ্ছাকৃত বোমা বিস্ফোরণকে কেন্দ্র করিয়া কেঁচো খুঁড়িতে সর্প আবিষ্কার করাটা বাড়াবাড়ি নয়?
শুধু কি তাহাই? সংখ্যালঘুদের সংবিধান প্রদত্ত নারী নির্যাতনের অধিকার হরণ করিয়া তাৎক্ষণিক তিন-তালাক বিরোধী আইন প্রণয়নের মতো ভয়ানক সাম্প্রদায়িক উদ্যোগকে তো বলা যায় দিদি একা হাতে আটকাইয়া দিয়াছিলেন। রাজ্যসভায় বিলটির একদা গতিরোধের প্রধান কেন, একক কৃতিত্ব তাঁহার দলকে দেওয়া যায়। জামাত-এ উলেমা-এ হিন্দ যে তাহাদের মানবতাবাদী মিছিল দ্বারা মাদ্রাসায় তদন্ত হইতে তালাক মামলায় সংস্কার, যে কোনও পদক্ষেপই ধর্মীয় স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ বলিয়া বিবেচিত হইবে ও প্রতিক্রিয়ায় বহ্নু্ৎসব হইবে – এই মর্মে সমগ্র দেশবাসীকে বার্তা দিতে সমর্থ হইয়াছে, তাহা কাহার ভরসায়?
মা-মাটি-মানুষ নামটির তাৎপর্য আমরা কবে অনুধাবন করিব? দলীয় নেতা কর্মী ব্যতিত মানুষের জীবনের মূল্য মাটির ঢেলার অধিক নয় বলিয়াই আমরা বাংলা মায়ের প্রতিনিধি ‘দিদি’টিকে আমাদের অভিভাবিকার পদে অভিষিক্ত করিয়াছি। প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখিতে ‘তিস্তা চুক্তি’ই করিতে হইবে এমন বিধান কোন বিধাতায় দিয়াছেন? ‘জামাতি’কে জামাতা করাটাও তো একটা কার্যকর পদ্ধতি হইতে পারে। ইহা এ রাজ্যের অবোধ মানুষ বুঝিতে চায় না, কেবল আপন কন্যা গণ-বলাৎকৃত হইয়া খুন হইল, না সামান্য কটা ‘টাকা মাটি মাটি টাকা’ চিট ফান্ডে ডুবিল, নাকি কোথায় কে বোমা বিস্ফোরণের ছক কষিল, নাকি একে একে সার্বজনীন পূজাগুলি বন্ধ হওয়ার মুখে – এইসব তুচ্ছ ব্যাপার লইয়া অহেতুক উদ্বেগে হৈচৈ করে!!
আগামী নির্বাচনের ফল যাহাই হউক, পূর্ববর্তী শাসক দলের ন্যায় বর্তমান ক্ষমতাসীন দলটিও পশ্চিমবাংলার বুকে নিজস্ব একটি ধারা চালু করিতে, যাকে বলে ‘ট্রেন্ড সেট’ করিতে সমর্থ হইয়াছে। এই নতুন ট্রেন্ড বা ফ্যাশনে উজ্জীবিত হইয়া যে গৈরিক বাহিনী আজ দেশ প্র্রেমের ধজা তুলিতেছে, তাহারাও নির্বাচনী বৈতরণী পার হইবার অভিলাষে টলিউডের তারকামণ্ডলী হইতে জননেতা সংগ্রহে তৎপর হইয়াছে। তাহা হইলে শিষ্যা গুরুর চেয়ে কম কীসে? গুরু যেখানে কারখানা বন্ধ, সিন্ডিকেট ও প্রমোটাররাজ চালু, পারিবারিক কাজিয়াতেও রাজনীতির অনুপ্রবেশ, শিক্ষাক্ষেত্রে জঙ্গী ছাত্র রাজনীতির প্রচলন, স্বজন-পোষণ, পুলিস-প্রশাসনকে দলদাসে পরিণত করা, বেআইনি অনুপ্রবেশকারীকে ভোটানুগত্বের বিনিময়ে দেশের নাগরিকত্ব প্রদান, ছেলে ছোকরাদের অবাধে খুন বলাৎকারের লাইসেন্স দান – ইত্যাদি ইতিবাচক গঠনমূলক প্রবণতা তৈয়ারিতে চব্বিশ বৎসর লাগাইয়াছিলেন, শিষ্যা সেখানে ইসলামিক মৌলবাদ ও তজ্জনিত সন্ত্রাসকে আন্তরিক ও নিয়মিত সহায়তা দান, নারী-নিগ্রহকারী বীর-পুংগবদের সাহস সঞ্চার, চুরিবৃত্তিকে সরকারি বৃত্তি প্রদান, তথাকথিত বুদ্ধিজীবিদের যখন তখন দলীয় পতাকাতলে একত্রিত করা এবং পুরস্কারস্বরূপ নেতৃত্ব ও মন্ত্রিত্ব প্রদান –এতদ্রূপ মহতী প্রবণতার নতুন ট্রেন্ড সেট করিয়া ফেলিয়াছিলেন মাত্র তিন বৎসরের মধ্যে।
গুরু ও শিষ্যায় পার্থক্য একটাই, চাউসেস্কু বসু যেখানে আমৃত্যু একটি বিলাসবহুল সরকারি বাসভবন দখল করিয়াও সর্বহারার সাথর্ক নেতা রূপে অত্যন্ত সুখে পরকালে গমন করিয়াছেন, সেখানে মমতাময়ী দিদি কালীঘাটে টালির ঘরে থাকিয়াও দুর্নীতির কালির ছোপ হইতে নিজ সাদা শাড়ি ও হাওয়াই চপ্পলজোড়া বাঁচাইতে পারিলেন না। গুরুদেব যেখানে বানতলা, ধানতলার তুল্য মুসলিম পুরুষ কর্তৃতক হিন্দু নারীর গণধর্ষণ ও নৃশংস হত্যার অজস্র ঘটনাও দিব্য দুষ্কৃতীদের ডাকাতি অথবা গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের তত্ত্ব দ্বারা সাম্প্রদায়িক বাস্তবতা আড়ালে রাখিতে পারিয়াছিলেন, শিষ্যা সেখানে অকপটে রাখঢাক না করিয়া স্বমুখে স্বীকার করিয়া ফেলিয়াছেন, ‘দুধেল গোরুর লাথি’ পরিপাকযোগ্য, অর্থাৎ ভোট পাইলে সাম্প্রদায়িক তাণ্ডব অনুমোদনযোগ্য। তাই লকডাউন চলাকালে হিন্দু বসতিতে দাতব্য রেশন দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে বাঁটোয়ারা হইয়া যায়, খুধার্ত মানুষ খাদ্যের দাবিতে পথে নামিলে পুলিসকে ডাণ্ডা মারিয়া ঠাণ্ডা করতে হয়, মহিলা বলিয়া ভাদাভেদও করে না; আর জেহাদি মহল্লায় পৃষ্ঠদেশে লাথি খাইয়াও লাথি মারা গোরুটিকে নিজেদের হেফাজতে আদরের দায়িত্ব লইয়া তাহার বিপুল পরিবারে সম্বৎসরের চাল ডাল আটা ও অন্যান্য সামগ্রী পৌঁছাইয়া, সক্রামক ব্যাধির ভীতি ত্যাগ করিয়া পরস্পর কণ্ঠলগ্ন হইয়া মৈত্রী মিছিল করিতে হয়।
একের পর এক বিবেকানন্দ সেতু, মাঝেরহাট বা শিলিগুড়ির সেতুগুলি ভাঙিয়া পড়া লইয়া নিন্দুকেরা কিছু বৎসরপূর্বে বিস্তর হৈচৈ করিয়াছিল। কিন্তু সেইগুলি যে বাংলার বিবেককে এতটুকু দংশন করিতে পারে নাই, বরং ভঙ্গুর সেতুগুলি যে তৃণের মূলোৎপাটনের বার্তাবাহী না হইয়া পুরাতন শাসকদলগুলির পতনের সূচক রহিয়া গেছে, তাহা নেত্রীর দ্বিতীয়বার বিধানসভা জয়ের মাধ্যমে প্রমাণিত। কারণ পথিমধ্যে উন্নয়ন যেভাবে স্তম্ভের ন্যায় দাঁড়াইয়া আছে, তাহাতে অসাম্প্রদায়িক পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম বাংলাদেশ হইতে আর বিলম্ব নাই। বিষাক্ত গেরুয়া শিবিরের সংখ্যার লঘু-গুরু বভতিরেকে সবার জন্য একই নীতির অন্যায় আবদার ব্যাপক জনসমর্থন লাভ করায় ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে খাতুনের দলটি বেপোয়া রিগিং করা সত্ত্বেও কিঞ্চিত চোট পাইয়াছে ঠিকই, কিন্তু মহতরমা ইহা দ্বারা বিন্দুমাত্র দমিবার পাত্রী নন। জনগণের কোটি কোটি টাকা খরচ করিয়া পাড়ার ক্লাবগুলিকে হস্তে রাখিয়া এবং ভিন রাজ্য থেকে ভিনদেশ-প্রেমী জনৈক পি.কে-র আমদানি করিয়া ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনে মা-মাটি-মানুষের জয়ধ্বণি নিশ্চিত করিতে সর্বশক্তি দিয়া ঝাঁপাইয়াছেন। অবশ্য ততদিনে ‘মা-মাটি-মানুষ’ স্লোগানটি ‘আম্মা-জ়মিন-ইনসান’-এ রূপান্তরিত হইবার সম্যক সম্ভাবনা। উপরন্তু জনতার সংখ্যাগুরু অংশ এই সাক্ষাত পিশাচিনীকে না চাহিলেও ‘করোনা’ ভাইরাস ঘটিত মহামারী হিন্দু নির্মূলীকরণের অস্ত্র স্বরূপ সাক্ষাত স্বর্গের প্রতিনিধি চিন হইতে প্রেরিত হইয়াছে। ইহা দমন করিবার উদ্দেশ্যে জারি করা ‘লকডাউন নামক’ সতর্কতাকে কীভাবে ‘জাতীয় প্রহসন’ ও ‘হিন্দু নিধনের প্রহরণ’ হিসাবে ব্যবহার করা যাইতে পারে, তাহা লইয়া রাজ্যে রাজ্যে প্রতিযোগিতা চলিতেছে। এই প্রতিযোগিতায় একদিকে দিল্লীর বর্তমান (২০২০) মুখ্যমন্ত্রী ও অন্যদিকে ‘শিবসেনা’ চরিত্র আমূল বদলাইয়া কার্যত ‘খানসেনা’-র সর্বময় কর্তা মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী হলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী। ফুফি মহতরমা পরাজয় স্বীকার করিয়া তৃতীয় স্থানে সন্তুষ্ট থাকিবেন, এমন দুরাশা পোষণ না করাই শ্রেয়।
আমরা নির্বোধের মতো কথায় কথায় সেনা নামানোর কথা বলি। সেনা যদি রাজ্যে রাজ্যে ভোট করাইবার কাজে ব্যাপৃত হয়, তাহা হইলে ভারতবর্ষের সুবিশাল সীমন্ত থাকিবে কাহার ভরসায়? সুতরাং নখ-দন্তহীন লোক দেখানো কেন্দ্রীয় বাহিনীর উপস্থিতিতে ২০২১-এর নির্বাচন যে রক্তপাতের নতুন নজির গড়িতে চলিয়াছে, তাহা বলার অপেক্ষা রাখে না। সেই রক্তপিচ্ছিল পথ বেয়ে ‘আম্মা-জ়মিন-ইনসান’-এর বিজয়োৎসবে যদি আরও কিছু সংখ্যাগুরু কন্যা বলি যায়, তাহা লইয়া অনর্থক গোল করা দায়িত্বশীল নাগরিকের উচিত হইবে না। কিন্তু যদি এর ব্যাত্যয় হয়, তাহলেও কি দৃশ্যপট খুব পরিবর্তিত হইবে?
বলা বাহুল্য তাঁহাকে বা তাঁহার দলকে হঠাইতে বিরোধীদেরও একই পথে হাঁটিতে হইবে। এ রাজ্যের ইহাই নিয়তি। ইতমধ্যে তার আভাস বিলক্ষণ পাওয়া গিয়াছে। বাংলার মানুষ বিস্মৃতিপ্রবণ। তাই যাহাতে এই অবিস্মরণীয়ার বহুমুখী প্রতিভা কালগর্ভে তলাইয়া না যান, তাই মহতরমা প্রতিটি মণীষীর জন্মজয়ন্তীতে তাঁহাদের ছবি বা মূর্তির চাহিয়াও বৃহৎ ও ব্যাপকরূপে আপনার প্রতিকৃতি ঘটা করিয়া লটকাইয়া দেন। টালির বিশিষ্ট ঘরে থাকিয়াও মোগলাই কেতা ভালোই রপ্ত করিয়াছেন। তাই মণীষীদিগের পার্শ্বে আপন ছবি (হয়তো মূর্তিও আছে) সাজাইয়া নিজেকেই নিজে বাংলার সর্বকালীন শ্রেষ্ঠ মণীষীগণের একজন ও ‘বাংলার গর্ব’ বলিয়া ঘোষণা করিয়া দিয়াছেন, ঠিক রাজা বাদশার যেরূপ স্বয়ং উপাধি গ্রহণ করিতেন। আর পোশাকের বৈশিষ্ট্য ও অনুপম ধর্মনিরপেক্ষতার হেতু প্রজাগণ তো ইতিমধ্যে ‘মালিকা-এ-বাংলা’কে ‘চটি’, ‘দিদি’ ও পিসি ইত্যাকার শব্দের নানাবিধ বিন্যাস ও সমবায়ের সহিত ‘বেগম’ উপাধিতে ভূষিত করিয়াই ফেলিয়াছে। এইখানে আমার কিছ নিবেদন আছে।
দিদি এক সময় সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি চূড়ান্ত দক্ষিণপন্থী দলটির সহিত ভিড়িয়া কেন্দ্রীয় মন্ত্রীত্ব লাভ করিবার পরেও উপলব্ধি করেন, বঙ্গেশ্বরী হইতে গেলে তথাকথিত সংখ্যাগুরুর অবিভক্ত ও ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার সমর্থন লাভ করা অধিকতর কার্যকরী কিন্তু সহজতর পথ। কারণ তাহাদের জটিলতা ও চাহিদার বৈচিত্র্য কম, একমাত্র সাম্প্রদায়িক আবেগটুকু উস্কানি দিয়া উজ্জীবিত রাখাই যথেষ্ট। মহামান্যা স্বভাবতই সহজতর পথটি অবলম্বন করিয়াছেন। কিন্তু তাহা বলিয়া একজন অগ্নিপরীক্ষিত কুমারী, একজন কনফার্মড স্পিন্সটারকে ‘বেগম’ বলিয়া কটাক্ষের তীব্র প্রতিবাদ জানাইতেছি। পরিবর্তে ‘খাতুন’ কিংবা তাঁহার বংশগত পদবির সঙ্গে ধ্বনিসাযুজ্য রাখিয়া ‘বানো’ উপাধিটি প্রস্তাব করিলাম।