মোপলা হিন্দু গণহত্যা ১৯২১: ২৫০০ জন হিন্দুকে যেখানে হত্যা করে হয়েছিলো

আরতি আগরওয়াল

অপরাধীঃ  কেরলের মোপলা / ম্যাপিলা মুসলিমরা

সময়ঃ ১৯২১-২২

পরিসংখ্যানঃ

·         ২৫০০ জন হিন্দু নিহত হয়

·         কমপক্ষে ২৬০০ জন রিফিউজি হয়ে পালাতে বাধ্য হয়

·         কমপক্ষে ২৬০০ জনকে জোর করে ধর্মান্তরিত ও যৌন নির্যাতন করা হয়

·         শতাধিক হিন্দু মন্দির ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়

মোপলা হিন্দু গণহত্যা, বা মালাবার বিদ্রোহ, বা ম্যাপিলা বিদ্রোহ বা মোপলা দাঙ্গা বলতে  ইতিহাসের একাধিক ঘটনাকক্রমকে বোঝায়, যেখানে হিন্দুদের শুধু খুনই করা হয়নি,বরং পুরো ঘটনাটিকে সুকৌশলে-সুপরিকল্পিত ভাবে ইতিহাস থেকে পুরোপুরি মুছে ফেলে সেখানে একটি মিথ্যে বানোয়াট গল্প সবাইকে শোনানো হয়েছিলো। ১৯১২-২২-এর মোপলা বিদ্রোহটি ছিলো ভারতের ইতিহাসের অন্যতম কলঙ্কিত একটি অধ্যায়‚ যেখানে বিদ্রোহীরা ব্রিটিশরাজকে আক্রমণ করার সাথে সাথে হিন্দুদের উপরেও নৃশংস আক্রমন চালায়। কারা ছিলো এই মোপলা‚ কীভাবে এবং কেন মালবার বিদ্রোহ শুরু হয়েছিল এবং কেন এই বিদ্রোহ কলঙ্গিত তা জানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

কারা ছিলো এই মোপলারা বা ম্যাপিলারা ?

ম্যাপিলা – এই শব্দটা এসেছে মালায়ালাম থেকে‚ যার অর্থ “সম্মানিত / দুর্দান্ত সন্তান”! মালাবর অঞ্চলে কেরালায় সমস্ত “অতিথি” বা ‘আক্রমণকারীদের” এই নামে উল্লেখ করা হতো। মোপলারা হলো প্রথম দিকের মুসলমান যাদের কিছু অংশ দক্ষিণ এশিয়ায় বসতি স্থাপন করে। মশলা বানিজ্যের পথে এদের সাথে আরবের সরাসরি যোগাযোগ ছিলো। ১৪৯৮ সাল পর্যন্ত স্থানীয় হিন্দুদের সহনশীলতার সাহায্য নিয়ে ধনে-জনে তারা স্ফীত হয়ে ওঠে। এই সময় হিন্দু মুসলিম দের মধ্যে বিবাহও প্রচলিত ছিলো ও বহু হিন্দু এই বিবাহের মাধ্যমে ইসলামে দীক্ষিত হয় ( যদিও উল্টোটা কখনো ঘটেছে বলে জানা যায়না)!

 ১৪৯৮ সালে ভাস্কো দা গামা ভারতে আসার ফলে মোপলারা কোনঠাসা হয়ে পড়ে। তাদের ব্যাবসা বানিজ্যে ভাঁটা দেখা দেয় ও আরব বাণিজ্য পথগুলিও ধীরে ধীরে হাতছাড়া হয়ে যায়। মোপলারা হিন্দুদের মালিকানাধীন কোনও জমি উত্তরাধিকারী হওয়ার অধিকারী ছিল না। ইউরোপীয়রাও মোপলাদের প্রতি তেমন কোনো সহিষ্ণুতা দেখায়নি। ফলে এইসময় ব্যাবসা বানিজ্য হারানোর ফলে ও ইউরোপীয়দের দ্বারা আরও বিভিন্নভাবে অত্যাচারিত হওয়ার ফলে মোপলারা ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে। কিন্তু সেই ক্রোধ ইউরোপীয়দের সাথে সাথে তাদের হিন্দুদের প্রতি শত্রুতার দিকেও টেনে নিয়ে যায়।

“পর্তুগিজদের মনোভাব মধ্যযুগীয় ইউরোপীয় ঐতিহ্যের প্রতিফলন ঘটিয়েছিলো এবং গোয়ার গভর্নর আফনসো আলবুকার্ক (১৫১৫ খ্রিস্টাব্দ) যিনি মক্কা ধ্বংস করার স্বপ্ন দেখতেন এবং বিরোধী মোপলাদের  তীব্রভাবে নির্যাতন করতেন‚ তার দ্বারা এই মনোভাব ভালোভাবে উপস্থাপিত হয়েছিল।”

দ্য সুপ্রিম মুসলিম কাউন্সিল: ইসলাম আন্ডার দ্য ব্রিটিশ ম্যান্ডেট ফর প্যালেস্টাইন।

পৃষ্ঠা ৪৫৯, উরি এম.কুপফেরস্মিট।

পর্তুগিজ, তৎকালীন ডাচ (১৬৫৬), তৎকালীন ব্রিটিশ (১৬৬২), ফরাসী (১৭৭৫) দের দ্বারা দেখানো এই ব্র্যান্ড “মশলা রাজনীতি” মোপলাদের জঙ্গিবাদ এবং ধর্মীয় ধর্মান্ধতার দিকে টেনে নিয়ে যায়। এরপর হায়দার আলী ( ১৭৮২) ও টিপু সুলতানের(১৭৯৯) সময় মোপলারা কিছু সুখ্যাতি অর্জন করলে তারা আবার পুরনো দিনের সমৃদ্ধি ফিরে পাওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। যদিও ইসলামী আক্রমণকারীদের দ্বারা বপন করা হিন্দুদের প্রতি বিদ্বেষ তখনো তাদের মনে স্থায়ীভাবে ঘাঁটি গেড়ে ছিলো। কিন্তু ১৭৯২ এর দিকে ব্রিটিশরা এই অঞ্চলের পরিপূর্ণ ক্ষমতা অর্জন করে ফেললে মোপলাদের এই সুখস্বপ্নের আশা ধুলিস্যাৎ হয়ে যায় আর তারা আগের থেকেও বেশি হিংস্র হয়ে ওঠে। এবং ভাস্কো দা গামার সময়ের মতোই ইউরোপীয় দের উপর রাগ মেটানোর খাড়া নেমে আসে সহজ শিকার স্থানীয় হিন্দুদের উপরেই।  এরই ফল স্বরুপ ১৮২১ থেকে ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ৫১ বার মোপলা জঙ্গি আন্দোলন ঘটে যায়। আর স্বাভাবিকভাবেই এই আন্দোলনগুলি শুধুমাত্র জমি বা বানিজ্য সম্পর্কিত বিবাদের ফলে ঘটেনি। জেহাদী চেতনাও এর মধ্যে পরিপূর্ণ ভাবে ছিলো। জেহাদী যোশের বশবর্তী হয়ে যাদেরই তারা শত্রু বলে মনে করতো তা সে খ্রিস্টান শাসক বা হিন্দু ভূস্বামি (জেনমিস)‚ তাদেরই উপর তারা নৃশংস ভাবে ঝাঁপিয়ে পড়তো।

খিলাফত আন্দোলন ও অসহযোগ আন্দোলন মোপলা বিদ্রোহকে উদ্বুদ্ধ করেছিলো।  এই খিলাফত আন্দোলনটি ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ইসলামী খিলাফত বা খলিফার সমর্থনে ভারতীয় মুসলমানদের একটি বিদ্রোহ। যার লক্ষ্য ছিলো অটোমান সাম্রাজ্যের সহায়তায় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে ধ্বংস করে ভারতবর্ষের উপর ইসলামিক আধিপত্যের প্রতিষ্ঠা! (১৯২২ এর দিকে এই অপচেষ্টা দমন করা হয়)

# pic

শওকত আলী ও মহম্মদ আলী‚ এই দুই ভাইদের নেতৃত্বে খিলাফত আন্দোলন শুরু হলে গান্ধীজি একে সমর্থন জানান। যদিও তিনি এটা ভালোভাবেই জানতেন যে যদি হিন্দুরা সমর্থন দিতে ব্যর্থ হয় তবে জেহাদী আক্রমণ হিন্দুদের উপরেই সবার আগে হবে। 

আলী ভ্রাতৃদ্বয় গান্ধীকে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিল যে আফগানরা যদি “পবিত্র যুদ্ধ” বা জেহাদ করার জন্য ভারত আক্রমণ করে তবে তারা কেবল ব্রিটিশদের সাথে নয়, হিন্দুদের সাথেও লড়াই করবে। হিন্দু মুসলমান দুই সম্প্রদায়েরই নেতা হওয়ার স্বপ্নে বিভোর গান্ধী এতেও সম্মতি দেন ও হিন্দুদের কাছে সাহায্যের জন্য আবেদন জানান। এই বিষয়ে মুসলমানদের আদেশ মেনে চলাই হিন্দুদের উচিৎ বলে তিনি পরামর্শ দেন।

 “সাম্রাজ্যবাদী সরকার জেনেশুনে ৭০ মিলিয়ন মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিকে আহত করছে। ……যদি ভারতবর্ষের মুসালমানরা খিলাফতের প্রতি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য সরকারকে অসহযোগিতা করে, তবে প্রতিটি হিন্দুর কর্তব্য হবে তাদের মুসলমান ভাইদের সহযোগিতা করা। ” [ – ২০০০০ মানুষের সামনে গান্ধীর বক্তৃতার অংশ। মোপলা বিদ্রোহ‚ ১৯২১‚ সি. গোপালান নায়ার, পৃ-১৯-২২ ]

তাঁর এই পৃষ্ঠপোষকতার ফলে খিলাফত আন্দোলন মালবারেও শক্তি অর্জন করে এবং মালবার বা মোপলা বিদ্রোহকে জাগিয়ে  তোলে।

 “গত মাসে গান্ধী ইয়ং ইন্ডিয়াতে লিখেছিলেন:” তিনি স্পষ্টতই সেই সময়টি দেখতে পাচ্ছেন যখন তাকে অবশ্যই রাষ্ট্র পরিচালিত প্রতিটি আইনের আনুগত্য অস্বীকার করতে হবে, যদিও সেখানে রক্তপাত ঘটতে পারে। “

আমাদের বিদেশী শত্রুদের সাথে যোগাযোগ করার কারণে  বিশ্বযুদ্ধ ও আফগান যুদ্ধের সময় যাদের আটকে রাখা হয়েছিল সেই আলি ভ্রাতৃদ্বয় – এমন একটি অপরাধ যার জন্য তাদের বিচার করা ও শাস্তি দেওয়া উচিত ছিল – তাদের মুক্তি দেওয়া হয়েছে এবং প্রকাশ্যে বলা হয়েছে যে তারা ভারতে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে জেহাদের ঘটনায় আফগানদের যথাসম্ভব সাহায্য করার জন্য সমস্ত সত্য মুসলমানদের অনুরোধ জানিয়েছিলো। জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের আপত্তি সত্ত্বেও মালবারে তাদের এই মতবাদ প্রচার করার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল, তাকে (জেলা ম্যাজিস্ট্রেট) রাষ্ট্রদ্রোহী সভা নিষিদ্ধ করার অনুমতি দেওয়া হয়নি। মোপলা বিদ্রোহের পেছনে কি কোনো যুক্তি সঙ্গত কারণ থাকতে পারে? ” – ডেইলি টেলিগ্রাফকে লেখা স্যার মাইকেল ও ’ও ডয়্যারের লেখা চিঠির অংশ ।

মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে থাকা কংগ্রেসও মালাবার উপকূলে অসহযোগ আন্দোলন ছড়িয়ে দেওয়ার লোভে খিলাফত আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়ে বসে। 

“কংগ্রেস অসহযোগ নীতি গ্রহণ করেছিল; খিলাফত ও অসহযোগ কোনো আন্দোলন আলাদা ছিল না;… প্রতিটি মোপলা কেন্দ্রের একটি খিলাফত সমিতি ছিল, যাতে একজন করে মোপলা সভাপতি ও সংখ্যাগরিষ্ঠ মোপ্লা সদস্য ছিলো” [মোপলা বিদ্রোহ ১৯২১, সি. গোপালান নায়ার, পৃ-১৯]

মোপলা বিদ্রোহীরা ছোরা এবং গোলাবারুদ নিয়ে সজ্জিত থাকতো এবং ব্রিটিশ এবং হিন্দুদের উপর আক্রমণ করার পরিকল্পনা করে। তারা হিন্দু ভূস্বামীদের বলে অস্ত্র দেওয়ার জন্য , এবং মোপলাদের বিশ্বাস করা হিন্দুরা কি ঘটতে চলছে তা না জেনে বুঝেই তাদের অস্ত্রের যোগান দেয়‚ আর এই অস্ত্র শেষ পর্যন্ত তাদেরই প্রাণ নেওয়ার জন্য ব্যবহৃত হয়েছিলো।

মোপলা বিদ্রোহ- জেহাদের একটি পরিণতি

অনেক ঐতিহাসিকের মতে এই মোপলা বিদ্রোহ ( এবং আগের গুলো ) ছিলো কৃষিজনিত সমস্যা এবং অর্থনৈতিক সঙ্কটের পরিণতি। যদিও আসলে তা ছিলোনা। যদি সত্যিই তাই হতো তবে হিন্দু কৃষক‚ যারা কিনা মুসলমান কৃষকদের মতোই হিন্দু ভূস্বামীদের( জেনমিস) জমি চাষ করতো তারাও এই গণহত্যার শিকার হতোনা। আবার এর আগেও একবার হায়দার আলী ও টিপু সুলতানের আমলে মালাবারের হিন্দুরা বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিলো।

“কৃষি অসন্তোষ জনিত অভিযোগগুলি স্পষ্টতই মোপলাদের মধ্যে গ্রামীণ মালাবারে বা সাধারণভাবে কৃষিক্ষেত্রের মধ্যে সহিংসতা ছড়ানোর পক্ষে পর্যাপ্ত ছিল না। কেন হিন্দুরাও একইভাবে ক্ষেপে ওঠেনি এই প্রশ্নের মূলেই আছে এই আন্দোলনের ইসলামী চরিত্র। এই সমস্ত আন্দোলন‚ এমনকি তাৎক্ষণিক কারণ হিসাবে যারা কৃষি অসন্তোষকে দায়ী করেছিলো তারাও এক অনিচ্ছাকৃত ইসলামিক জেহাদের দ্বারা পরিচালিত হয়েছিলো। এদের প্রত্যেকটি কার্যক্রমকে ধর্মীয় কাজ হিসাবে প্রকাশ করা হতো কারণ মোপলারা ধর্মীয় নেতাদের ছোটো ছোটো জংগী গোষ্ঠী গুলির দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিলো। [ – ডেল.এস (১৯৭৫)দ্য মোপলা আউটব্রেকঃ আইডিওলোজি অ্যান্ড সোশ্যাল কনফ্লিক্ট ইন নাইন্টিন্থ সেঞ্চুরি কেরালা। দ্য জার্নাল অফ এশিয়ান স্টাডিজ‚ ৩৫(১)‚৮৫-৯৭‚ডি.ও.আই.-১০.২৩০৭/২০৫৪০৪১]

মোপলা বিদ্রোহ হিন্দুদের জন্য আগের আন্দোলন গুলির থেকেও বেশী ক্ষতিকর ছিলো‚ কারণ এটি ছিল একটি সংগঠিত আন্দোলন। যা এটিকে অসন্তুষ্ট ধর্মীয় জঙ্গিদের দ্বারা ঘটিত বিচ্ছিন্ন বিদ্রোহের পরিবর্তে খিলাফত আন্দোলনের প্রভাবে একটি সুসংগঠিত অপরাধে পরিণত করে।

“……১৯২১ সালে খিলাফত আন্দোলন ধর্মীয় জঙ্গিবাদ ও সামাজিক দ্বন্দ্বের মধ্যে আগে থেকেই বিদ্যমান ঐতিহ্যে আদর্শ ও সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ উপাদানগুলিকে যুক্ত করে। অন্য যেকোন কিছুর থেকেও এই যোগটিই মোপলা  বিদ্রোহকে আগের সমস্ত ঘটনাগুলোর থেকে আলাদা করে তুলেছিলো। [ডেল.এস (১৯৭৫)দ্য মোপলা আউটব্রেকঃ আইডিওলোজি অ্যান্ড সোশ্যাল কনফ্লিক্ট ইন নাইন্টিন্থ সেঞ্চুরি কেরালা। দ্য জার্নাল অফ এশিয়ান স্টাডিজ‚ ৩৫(১)‚৮৫-৯৭‚ডি.ও.আই.-১০.২৩০৭/২০৫৪০৪১]

ভ্রান্ত পথে মোপলা বিদ্রোহ

মালাবারের যে কজন হিন্দু অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলো তারা মুসলমানদের পরিকল্পিত হিংসা ও ধ্বংসযজ্ঞের জন্য প্রস্তুত ছিল না। ” সহিংসতার ফলে বীতশ্রদ্ধ হয়ে বেশিরভাগ মালাবার হিন্দুই আন্দোলন থেকে সরে যায়‚ আর এই ঘটনাই মালাবার বিদ্রোহকে ডেকে আনে। ” [দ্য সুপ্রিম মুসলিম কাউন্সিল: ইসলাম আন্ডার দ্য ব্রিটিশ ম্যান্ডেট ফর প্যালেস্টাইন। উরি এম.কুপফেরস্মিট‚ পৃষ্ঠা ৪৫৯]

মালাবার বিদ্রোহ শুরু হওয়ার সাথে সাথেই হিন্দুরা তার থেকে সরে দাড়ায়। আর এর ফলেই  জেহাদীরা হিন্দুদের উপরেও ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে।

এই বিদ্রোহ চলেছিলো মাসের পর মাস ধরে। এতে হিন্দুদের উপর চালানো হয়নি এমন কোনো অত্যাচার আর অবশিষ্ট ছিলোনা। হিন্দুদের বিরুদ্ধে মোপলাদের এই আক্রমণ স্পষ্টতই এটা প্রমাণ করে যে তাদের যুদ্ধ শুধু ব্রিটিশদের থেকে মুক্তির জন্যই নয়, ইসলামিক আধিপত্যের জন্যও ছিল।

মোপলা বিদ্রোহের ফলস্বরূপ ২০০ এরও বেশী মোপলাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। এছাড়াও ৫০২ জনকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড এবং প্রায় ৫০,০০০ জনকে আন্দামানে বন্দী করা বা নির্বাসিত করা হয়েছিলো। ব্রিটিশ সরকার তাদের থেকে মোটা জরিমানা আদায় করে।

মোপলা বিদ্রোহে হিন্দুদের উপর অত্যাচার

মোপলা বিদ্রোহের পুরো সময় ধরেই, হিন্দুদের উপর অবর্ণনীয়, অকল্পনীয় অত্যাচার চালানো হয়েছিল, যে কারণে একে মোপলা হিন্দু গণহত্যা বলাই যুক্তিসঙ্গত হবে।বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া হিসাব মতে কমপক্ষে ২৫০০ জন হিন্দুকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছিল। আর ২৫০০ জন জোর করে ধর্মান্তকরণের শিকার হয়। এছাড়াও নারীদের ধর্ষন‚ শিশুদের হত্যা এইসব তো ছিলোই। আন্তর্জাতিক সংবাদপত্রে এবং জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও অন্যান্য পুলিশ কর্মকর্তাদের লেখায় এই নৃশংসতা প্রকাশিত হয়েছিল।

“আর্য সমাজ একাই ১৭৬৬ টি জোর করে ধর্মান্তকরণের মামলা রেকর্ড করে। এবং যদি অন্য সমস্ত রিলিফ কমিটির থেকে পাওয়া পরিসংখ্যান সংগ্রহ করা হয় তবে এই সংখ্যা নিশ্চিত ভাবেই  ২৫০০ ছাড়িয়ে যাবে।” [পন্ডিত ঋষি রামের চিঠি‚ মোপলা বিদ্রোহ ১৯২১‚ সি.গোপালন. পৃ- ১১৯]

আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সবাই নিশ্চিত ছিল যে খিলাফত আন্দোলনের সাথে সামঞ্জস্য রেখে মোপলা বিদ্রোহ প্রকৃতপক্ষে ছিলো  একটি “পবিত্র যুদ্ধ” বা জেহাদ ।

# pic

মালবার বিদ্রোহ

প্রাথমিকভাবে একটি পবিত্র যুদ্ধ।

এলাহাবাদ, সানডে মর্ণিং – মালাবার বিদ্রোহটি প্রকৃতপক্ষে একটি পবিত্র যুদ্ধ। এতে সবুজ পতাকা ব্যবহৃত হয়েছে এবং হিন্দুদের জোর করে ধর্মান্তর করা হয়েছে। পাইকারি হারে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা অব্যাহত রয়েছে এবং আরও খুনের ঘটনা ঘটেছে। অসহযোগকারী ধর্মান্ধরা সম্পূর্ণ নিজেদের শাসনের ঘোষণা করেছে এবং ধ্বংসকার্যের ফলে দুর্ভিক্ষ ঘটার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে……। [ডেইলি টেলিগ্রাফ (ল্যান্সস্টন, টাস।: ১৮৮৩-১৯২৮ ), সোমবার ২৯ শে আগস্ট, ১৯২১ . http://bit.ly/2XEMwwa- এর থেকে নেওয়া হয়েছে]

ব্রিটিশ আধিকারিকরা অবাক হয়ে গিয়েছিলো এই হারে হিন্দুদের সুপরিকল্পিত নির্মূলীকরণ দেখে।  মোপলাদের দ্বারা হিন্দুদের বিরুদ্ধে এ জাতীয় গণহিংসার তাদের দুঃস্বপ্নেও ছিলোনা।

# pic

মালাবার বিদ্রোহ

মোপলা নৃশংসতা। এলাহাবাদ, বুধবার।

কুট্টিপুরমে ২০০ জন মোপলা তরোয়াল ও ছোরা নিয়ে থানায় হামলা চালিয়ে পাঁচ কনস্টেবলকে আহত করে। এর ফলে নারকীয় নৃশংসতার সৃষ্টি হয় বলে জানা গেছে। হত্যা করার আগে হিন্দুদের বাধ্য করা হয়েছিলো নিজেদের কবর খোড়ার জন্য। সৈন্যদের সাহায্য করার অপরাধে জীবিত অবস্থাতেই একজনের ছাল ছাড়িয়ে নেওয়া হয়। এবং নীলামপুরের কাছে দু’জন পুলিশকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।

উদ্বাস্তুরা সেনাক্যাম্প গুলিতে আশ্রয় নিয়েছে‚ তবে তাদের রসদের যোগান দেওয়া সৈন্যদের পক্ষেও কঠিন হয়ে পড়ছে। তারা জানিয়েছে যে হিন্দুদের নির্মূল পদ্ধতি নিয়মতান্ত্রিকভাবে এগিয়ে চলেছে তবে মহিলা ও বালিকাদের ধরে রাখা হচ্ছে। [ওয়ার্ল্ড (হোবার্ট, টাস।: ১৯১৮-১৯২৪, শুক্রবার, ৭ই অক্টোবর, ১৯২১. http://bit.ly/2XE4cbd এর থেকে নেওয়া হয়েছে।]

মোপলারা হিন্দুদের উপর সমস্ত ধরনের অত্যাচার চালিয়েছে। গবাদি পশু জবাই করে দেওয়া থেকে শুরু করে হত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট এবং নারী নির্যাতন পর্যন্ত সমস্ত কিছুই রয়েছে এই তালিকায়।

# pic

মোপলাহ বিদ্রোহ। বেপরোয়া হত্যাকাণ্ড। ইসলাম অস্বীকারকারী হিন্দুরা।

এলাহাবাদ, বৃহস্পতিবার

“…। বিদ্রোহীরা ইসলামকে অস্বীকারকারী সকল হিন্দুকে বেপরোয়াভাবে হত্যা করেছে। কিছু জেলা হিন্দুশূন্য হয়ে পড়েছে… “

 [অ্যাডভোকেট (বার্নি, টাস।: ১৮৯০ – ১৯৫৪), ৮ই অক্টোবর, ১৯২১ http://bit.ly/2XBDq3x এর থেকে নেওয়া হয়েছে।]

দিন যত গড়াতে থাকে হিন্দুদের পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে থাকে। 

# pic

মালবার বিদ্রোহ। হিন্দুহত্যা। মাদ্রাজে অশান্তি

এলাহাবাদ, শুক্রবার — শরণার্থীদের ভীড়ে কালিকট উপচে পড়েছে। মোপলারা এখন হিন্দুদের ধর্মান্তরিত হয়ে বাঁচার সুযোগও দিচ্ছেনা‚ নির্বিচারে তাদের হত্যা করছে।  ব্রিটিশ সৈন্যদের শক্তি বৃদ্ধি করতে একটি দল এগিয়ে আসছে…… [ওয়ার্ল্ড (হোবার্ট, টাস।: ১৯১৮-১৯২৪, শুক্রবার, ১০ই অক্টোবর, ১৯২১.http://bit.ly/2XEMCnw- এর থেকে নেওয়া হয়েছে।]

মোপলা বিদ্রোহ সেই অঞ্চলের বেশিরভাগ হিন্দুকে শরণার্থী বানিয়ে দিয়েছিলো। বিদ্রোহ যত এগিয়েছে তত বেশি সংখ্যক হিন্দু বাস্তুচ্যুত হয়ে শরণার্থী শিবিরে বা জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছিলো।

# pic

মালবার বিদ্রোহ

হিন্দুদের জোর করে ধর্মান্তরিত করা হয় লাহোর‚ সোমবার- মালাবার উপকূলে বিভিন্ন শিবিরে শরণার্থীদের সংখ্যা এখন প্রায় ১০‚০০০ এ পৌঁছেছে। এবং তারা এখনো এসেই যাচ্ছে। স্থানীয় সৈন্যরা ছয়জন বিদ্রোহীকে হত্যা করেছে……রিফিউজিরা জানিয়েছে যে ৩১ জন হিন্দুকে আটকে রাখা ও ২৩ জনকে জোর করে ইসলামে ধর্মান্তরিত করা হয়েছে এবং এক জনকে হত্যা করা হয়েছে।

[ওয়ার্ল্ড (হোবার্ট, টাস।: ১৯১৮-১৯২৪, শুক্রবার, ৯ই অক্টোবর, ১৯২১.http://bit.ly/2XD3tHt এর থেকে নেওয়া হয়েছে।]

# pic

মোট হিন্দু শরণার্থীর সংখ্যা আনুমানিক ২৬০০০ এরও বেশি বলে মনে করা হচ্ছে। কেরালায় হিন্দুদের ত্রাণ সরবরাহের জন্য আসা আর্য সমাজের হিসাব মতে‚ কেবল তাদের ত্রাণ শিবিরেই ২৬‚০০০ টি এমন  রিপোর্ট রয়েছে।

“অক্টোবর থেকে ক্যালিকটে ত্রানশিবির ও মফস্বলে ভাতডৌল যুক্ত কনসেনট্রেশন ক্যাম্প তৈরি করা হয়েছিলো। দিন দিন শরণার্থীর সংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে নতুন নতুন শিবির খোলা হয়েছে। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে সেখানে সমস্ত বর্ণ ও বর্ণের প্রায় ২৬‚০০০ শরণার্থী নিয়ে ২২ টি শিবির তৈরী হয়ে গেছে।” [মোপলা বিদ্রোহ ১৯২১, সি. গোপালান নায়ার, পৃষ্ঠা ৯৬]

# pic

তবে মোপলাদের অত্যাচার শুধুমাত্র হিন্দুদের হত্যা করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলোনা। মালাবার অঞ্চলে প্রতিটি হিন্দু মন্দিরকে কলুষিত ও ধ্বংস করাও ছিলো তাদের উদ্দেশ্য।

“কোনও পরিসংখ্যান সংকলন করা হয়নি, তবে ধ্বংস হওয়া বা অপবিত্র হওয়া মন্দিরের সংখ্যা অবশ্যই ১০০ এর বেশি হতে হবে। সম্ভবত সংখ্যাটি আরো বেশি তবে সুস্পষ্ট কারণেই সরকার উদ্দেশ্যমূলকভাবে সঠিক পরিসংখ্যান সংগ্রহের প্রচেষ্টা থেকে বিরত থেকেছে।” [লেজিসলেটিভ কাউন্সিল ইন্টারপ্লেলেশন, ১৪ ই নভেম্বর, ১৯২২ ‘মোপলা বিদ্রোহ ১৯২১ থেকে  উদ্ধৃত,’ সি. গোপালান নায়ার, পৃ-৮৮]

গ্রামগুলিকেও রেহাই দেওয়া হয়নি এবং এলাকার সমস্ত মন্দিরগুলি হয় মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া বা অপবিত্র করে দেওয়া হয়েছিল।

“খুব কমই এমন কোনো গ্রাম আছে যার. নিজস্ব মন্দির নেই, বেশিরভাগ গ্রামেই একের বেশি মন্দির রয়েছে এবং বিদ্রোহী অঞ্চলের প্রায় প্রতিটি মন্দিরকেই অপবিত্র করা হয়েছে।” [মোপলা বিদ্রোহ ১৯২১, সি.গোপালান নায়ার, পৃ-৮৯ ]

মালাবার মহিলারা কাউন্টেস অব রেইডিং কে চিঠি লিখে, হিন্দুদের নির্মম হত্যা এবং হিন্দু মন্দির ও উপাসনালয়গুলির অপবিত্র করা সম্পর্কে তাকে জানিয়েছিলেন।

“পিশাচ বিদ্রোহীদের দ্বারা সংঘটিত সমস্ত ভয়াবহতা ও নৃশংসতার সম্পর্কে মাননীয়া পুরোপুরি অবহিত নন; জলের কুয়োগুলো  ভর্তি হয়ে উঠেছিল আমাদের আত্মীয় পরিজনদের প্রায় অর্ধমৃত দেহ দিয়ে‚ যারা তাদের নিজেদের পৈতৃক বিশ্বাস ত্যাগ করতে অস্বীকার করেছিলো। গর্ভবতী মহিলাদের কেটে টুকরো টুকরো করা হয়। রাস্তার ধার ও জঙ্গলে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিলো মৃতদেহ গুলি থেকে ছিঁড়ে করে আনা গর্ভস্থ শিশুগুলিকে। আমাদের শিশুদের হাত থেকে কেড়ে নিয়ে আমাদেরই চোখের সামনে হত্যা করা হয়েছিলো এবং আমাদের বাবা ও স্বামীদের নানা ভাবে নির্যাতন করা হয়। তাদের শরীরের চামড়া ছাড়িয়ে নেওয়া হয় ও জীবন্ত জ্বালিয়ে দেওয়া হয়।……আমাদের হাজার হাজার বসতবাড়ি এদের বর্বরতার কারণে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। আমাদের উপাসনাস্থল গুলি কলুষিত ও ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। আগে যেখানে ফুলের মালা শোভা পেত সেখানে জবাই করা গরুর নাড়িভুড়ি ছড়িয়ে তারা নির্লজ্জভাবে আমাদের আরাধ্যকে অপবিত্র করেছে। আমাদের  ধনীদের বাড়িতে পাইকারি হারে লুটপাট চালানো হয়েছে। যাঁরা ধনী ও সমৃদ্ধ ছিলেন তারা এখন কালিকটের রাস্তায় দু’এক পয়সার জন্য প্রকাশ্যে ভিক্ষা করছে…” [মালাবারের হিন্দু মহিলাদের কাউন্টেস অফ রেইডিং এর কাছে দেওয়া স্মারক পত্র। সি.গোপালন নায়ারের মোপলা বিদ্রোহ‚১৯২১ থেকে সংগৃহীত]

হিন্দু শরণার্থীদের দ্বারা তাদের নিজেদের দুর্দশা, হত্যা, আত্মীয়-স্বজন হারানো, ধর্মকে কলুষিত করার সাক্ষ্য দেওয়ার এমন অজস্র উদাহরণ আছে। এটা তর্কাতীত যে মোপলাদের মালাবার বিদ্রোহ আসলে ব্রিটিশ ভারতের ইতিহাসে হিন্দুদের উপর বৃহত্তম  আক্রমণ ছিল।

আর্য সমাজের স্বেচ্ছাসেবীরা মোপলাদের দ্বারা জোর ধর্মান্তরিত হিন্দুদের ঘর ওয়াপসী ( পুনরায় পৈত্রিক ধর্মে ফিরিয়ে আনা) করানোর কাজ আন্তরিকতার সাথে সম্পন্ন করে। আর্য সমাজের পুরোহিতরা একটি সাধারণ “প্রায়শ্চিত্ত্ব” এর মাধ্যমেই তাদের আবার হিন্দু হিসাবে স্বীকৃতি পাওয়ার রাস্তা খুলে দেয়। তবে এই নির্মম হিন্দু গণহত্যার ক্ষত নিরাময় হওয়া এত সহজ ছিলোনা। বর্তমানেও কেরালার হিন্দুরা যে জনসংখ্যাজনিত অশান্তির সম্মুখীন হচ্ছে কোনো না কোনো ভাবে তার মূল নিহিত আছে মালাবারের সেই নির্মম হিন্দু-অত্যাচারের মধ্যেই।

References:

https://en.wikipedia.org/wiki/Khilafat_Movement

https://en.wikipedia.org/wiki/Malabar_rebellion#cite_note-:0-20

https://books.google.co.in/books?id=nf0MNk7i0ewC&printsec=frontcover

https://www.archive.org/details/cu31924023929700

Moplah Rebellion 1921, C. Gopalan Nair

The Supreme Muslim Council: Islam Under the British Mandate for Palestine by Uri M. Kupferschmidt

https://www.google.co.in/search?tbo=p&tbm=bks&q=inauthor:%22Uri+M.+Kupferschmidt%22

https://www.jstor.org/stable/311886

Dale, S. (1975). The Mappilla Outbreaks: Ideology and Social Conflict in Nineteenth-Century Kerala. The Journal of Asian Studies, 35(1), 85-97. doi:10.2307/2054041

https://www.jstor.org/stable/2054041

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.