১৯৬১থেকে ৭১ রবীন্দ্রনাথ কে নিষিদ্ধ করা হলো নিষিদ্ধ করলো আয়ুব সরকার ও তাঁর দোসররাই । আইয়ুবের দোসররাই মূলত উদ্যোগটা নেন। ১৯৬১ তে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী সময়ে আইয়ুব সরকার পূর্ব পাকিস্তানে যাতে কোন রকম অনুষ্টানের আয়োজন না হয় তাঁর জন্য বিশেষ তৎপর হয়ে ওঠে। শুরুটা হয় ১৯৫১ সাল থেকে, সাহিত্যিক আলী আহসানের নাম অনেকেই শুনে থাকবেন ১৯৫১সালে পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় সংহতির বৃহত্তর প্রয়োজনে তিনি রবীন্দ্রনাথকে অস্বীকার করতে চেয়েছিলেন। তিনি বলেন নতুন রাষ্ট্রের প্রয়োজনে আমরা সাহিত্যে নতুন জীবন ও ভাবধারার প্রকাশ খুঁজব। সেই সঙ্গে এটাও সত্য যে আমাদের সাংস্কৃতি সাতন্ত্র বজায় রাখবার এবং হয়ত জাতীয় সংহতির জন্য যদি প্রয়োজন হয় , আমরা রবীন্দ্রনাথকেও অস্বীকার করতে প্রস্তুত রয়েছি। সাহিত্যের চাইতে রাষ্ট্রীয় সংহতির প্রয়োজন আমাদের বেশি। রবীন্দ্রনাথ জন্মশতবর্ষে মওলানা আকরাম খান পরিচালিত ‘ আজাদ ‘ পত্রিকা সরকারি আনুকূল্যে এক ঘৃণ্য বিতর্কে অবতারণা করে পয়লা বৈশাখ থেকে এক মাসব্যাপী ‘ আজাদ ‘ বিরামহীনভাবে প্রতিদিন সম্পাদকীয় , উপ-সম্পাদকীয় প্রবন্ধ , চিঠি পত্র ও সংবাদ প্রকাশের মধ্যমে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিরুদ্ধে প্রচার চালায়। তাঁর মুল কথা ছিল বাঙালি মুসলানদের কাছে রবীন্দ্রনাথ কোন শ্রদ্ধার নাম নয় , রবীন্দ্রনাথ চিরদিন হিন্দুভারত প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছেন। তাঁর সাহিত্য পাকিস্তানের আদর্শ বিরোধী। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খান এদেশের কবিদের রবীন্দ্র সঙ্গীত রচনা করতে পরামর্শ দিয়েছিলেন । কবি গোলাম মোস্তফা বলেন ‘ দেশ বিভাগের সঙ্গে সঙ্গে বাংলা ভাষাও বিভক্ত হয়ে গেছে এবং পরিণতিতে একদিন পূর্ববঙ্গে ভাষাও হবে ইসলামি বাংলা ভাষা‘ । তিনি দাবী করেন পাকিস্তানের পরিবর্তিত মনোভঙ্গিমায় ও নতুন পরিপ্রেক্ষিতে তাই আমাদের একটা সাহিত্যিক বাছাই এর দরকার আছে।
১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষে সারা বিশ্ব যেখানে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছে তখন রেডিও পকিস্তান কোন প্রচার করেনি । পকিস্তানের ঢাকা কেন্দ্র থেকে ৪৫ মিনিটের রবীন্দ্র সঙ্গীতের অনুষ্ঠান ছাড়া রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কিত অন্য কিছু প্রচারিত হয়নি । সরকারি সাহায্য প্রাপ্ত পত্র পত্রিকা কিংবা সরকারি অর্থে পরিচালিত সাহিত্য পত্রিকা কিংবা গবেষণা পত্রিকায় সব সময় রবীন্দ্রবিদ্বেষ প্রচারিত হয়েছে । তাঁর মধ্যে অন্যতম ,’ মাহে নাও ‘ সব সময় রবীন্দ্র বিরোধী মন্তব্য প্রকাশ করে বলেছে পূর্ব পাকিস্তানের সাহিত্যে ও সাংস্কৃতির ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ অপরিহার্য নন। বাংলা একডেমী পত্রিকায় ১৩৬০-১৩৭৪ সাল পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কিত কোন প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়নি। তখন বাংলা একডেমীর পরিচালক ছিলেন সৈয়দ আলী আহসান। ১৯৬৫ ভারত পাকিস্তানের যুদ্ধের সময় পকিস্তান রেডিও থেকে রবীন্দ্র সঙ্গীতের প্রচার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয় । রবীন্দ্রনাথ হয়ে ওঠে শত্রু দেশের এক কবি । ১৯৬৭ সালে জুন মাসে তথ্য ও বেতার মন্ত্রী খাজা শাহবুদ্দিন জাতীয় পরিষদে ঘোষণা করেন যে , ভবিষ্যতে রেডিও পাকিস্তান থেকে পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের পরিপন্থী রবীন্দ্র সঙ্গীতের প্রচার নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং এই ধরনের অন্যান্য গানের প্রচার কমিয়ে দেওয়া হবে । ঢাকার ‘ দৈনিক পকিস্তান ‘ পত্রিকায় এই খবর প্রকাশিত হয়। সরকারের করুণা লাভের জন্য অনেক বুদ্ধিজীবী কবি সাহিত্যিক , শিক্ষাবিদ শিল্পী রবীন্দ্রবিরোধিতায় মুখর হয়ে ওঠেন। ‘ তামুদ্দিন স্বাতন্ত্র্যে বিশ্বাসী ‘ ৪০ জন বুদ্ধিজীবী সাহিত্যক সাংবাদিক তাঁদের বিবৃতিতে দেন। শুধু এই সব বুদ্ধিজীবীরাই নন । এসময় সরকারি সিদ্ধান্তকে সমর্থন জানিয়েছিলেন আরও দুটি পরস্পর বিরোধী গোষ্ঠী। একটিতে স্বাক্ষর দিয়েছিলেন মওলানা আকরাম খানের নেতৃত্বে ৩০জন বিশিষ্ট মওলানা যা দৈনিক আজাদ দৈনিক পয়গাম ১জুলাই ১৯৬৭ প্রকাশিত হয় । অন্য বিবৃতি দিয়েছিল ৪৫ জন সংগীতশিল্পী। এরা সকলেই ছিল রেডিও পাকিস্তানের কর্মচারী। তাঁরা বলেন ‘ রবীন্দ্র সঙ্গীতের ভাব, ভাষা, সুরের কোনটার সঙ্গে পূর্ব পকিস্তানের তৌহিদবাদী জনসাধারণের তিল মাত্র যোগ নেই॥ রবীন্দ্রসুরের বৈশিষ্ট্য বলিয়া যে একঘেয়েমিকে প্রশ্রয় দেওয়া হয়, পূর্ব পাকিস্তানের সংগ্রামী জনগণ ও মেহনতি মানুষের নিকট তাহা নিতান্ত বিরক্তকর এবং পীড়াদায়ক বলিয়া প্রতিপন্ন হইয়াছে । সংগ্রামী মানুষের নিকট রবীন্দ্রসঙ্গীতের কোন অবদান নাই বলিলেই চলে ।
দৈনিক পয়গমে ৫জুলাই ১৯৬৭ তে প্রকাশিত হয় । রাওয়ালপিন্ডিতে জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে কেন্দ্রীয় যোগযোগ মন্ত্রী সরকারি দলের নেতা আবদুস সবুর খান বাঙালি হয়েও রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে ঘৃণ্য মন্তব্য করেন । রবীন্দ্রনাথ কে নিষিদ্ধ করতে গিয়ে সে সময় পকিস্তানের শাসকরা দেশে যে সম্প্রদায়িক বিষ ছড়িয়ে দিয়েছিল তা মিশে গিয়েছিল আকাশে,বাতাসে, মাটিতে,জলে।সেই বিষ সেই দিন অনেকেই খেয়েছিল।তাঁরা প্রাণে মরেনি।কিন্তু তাঁদের শরীরে মনে এখনো সেই বিষক্রিয়া অব্যাহত শেষ করি কবিগুরুর কবিতার দুই লাইন দিয়ে।
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
সৌমেন ভৌমিক