গোমতীর তীরে ছত্তর মঞ্জিলের গর্ভে খোঁড়াখুঁড়ির কাজটা শুরু হয়েছিল বহুদিন। বেগমদের মহল, তাই প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের লোকজনও মাটি খোঁড়ার সময় যথেষ্টই সতর্ক ছিলেন। কে বলতে পারে, ‘মিললেও মিলতে পারে অমূল্য রতন!’ কিন্তু না, গুপ্তধন নয়, বহুমূল্য অলঙ্কারও নয়, মাটির অতল গহ্বর থেকে যার দেখা মিলল সেটি একটি বিরাটাকার গন্ডোলা। এককালে প্রমোদতরী ছিল কি না সে ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলেন না পুরাতাত্ত্বিকরা, কারণ এত বড় প্রমোদতরী সাধারণত হত না। আশ্চর্যের বিষয়, বহুদিন মাটি চাপা এই গন্ডোলার গায়ে কিন্তু ছিল নবাবী শিল্পের নিখুঁত ছোঁয়া।
মঙ্গলবারের বিকেল। উত্তরপ্রদেশ সরকারের থেকে বিশেষ অনুমতি নিয়েই ছত্তর মঞ্জিলে এই খননের কাজ চালাচ্ছিল রাজ্য প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ (UPSAD)। মাটির প্রায় ২০ ফুট গভীরে কাঠের পাটাতন দেখে প্রথমে কোনও নির্মাণকাজ ভেবেছিলেন প্রত্নতাত্ত্বিকেরা। ধীরে ধীরে মাটি সরাতেই গন্ডোলার পুরো কাঠামোটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ৪২ ফুট লম্বা এবং চওড়ায় প্রায় ১১ ফুট। বিশেষজ্ঞদের মতে, ২২০ বছরের পুরনো ছত্তর মঞ্জিলের গর্ভে খুঁজে পাওয়া এই গন্ডোলার বয়সও কম কিছু নয়। এর প্রতিটি কোণায় কারুকাজ অসামান্য। শিল্পীর নিপুণ হাতের ছোঁয়ায় প্রাচীন এই গন্ডোলা আজও যেন প্রাণবন্ত, এক অজানা রহস্যের খোঁজ দেয়।
রাজ্য প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের ডিরেক্টর এ কে সিংয়ের কথায়, “কী ভাবে এবং কেন এই বিশাল ও সুন্দর গন্ডোলাটি মাটিতে পুঁতে দেওয়া হয়েছিল তার কারণ অজানা। নবাবী ইতিহাসেও এর কোনও উল্লেখ নেই। তবে বন্যা বা অন্য কোনও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে এটি মাটির তলায় চলে গিয়েছিল কি না সেটা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।”
মঙ্গলবার বিকেল থেকে ছত্তর মঞ্জিলের ওই বিশেষ জায়গায় খনন শুরু হয় বলে জানিয়েছেন উত্তরপ্রদেশের ‘রাজকীয় নির্মাণ নিগম’ (UPRNN)-এর সদস্যেরা। প্রত্নতাত্ত্বিকদের সঙ্গে তাঁরাও হাতে হাত মিলিয়ে খননকাজে অংশ নিয়েছিলেন। এই সংস্থার বিশেষজ্ঞদের মতে, ২০১৭ সালের মে মাসের পর থেকে এটি তৃতীয় রহস্যময় ও মূল্যবান খোঁজ। ছত্তর মঞ্জিলের প্রাচীন ও নবাবী স্থাপত্যের সংরক্ষণের জন্য একটি বিশেষ প্রকল্পের আয়জন করে রাজ্য সরকার। এর আগে মাটি খুঁড়ে ১৫ বর্গফুটের একটি ঘর উদ্ধার করেন প্রত্নতাত্ত্বিকেরা। মনে করা হয় এই ঘরটি একসময় রাজদরবারের লাগোয়া একটি কক্ষ ছিল যেটি তৎকালীন অওধের নবাবরা ব্যবহার করতেন। পরে সেটি বেগমদের কাজে লাগত।
পরবর্তী কালে এই মহলেরই এক প্রান্তে মাটির নীচে চাপা পড়া দু’টি জলাধারের খোঁজ পান প্রত্নতাত্ত্বিকরা। ডঃ এপিজে আব্দুল কালাম টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপকরা যার উৎস নিয়ে এখনও গবেষণা করছেন। রাজ্য প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের ডিরেক্টর এ কে সিং এবং প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি জিতেন্দ্র কুমারের মতে, গন্ডোলাটির কিছু কিছু অংশ ক্ষয়ে গেছে। কোথাও কোথাও আঘাত লাগার চিহ্নও স্পষ্ট। ছত্তর মঞ্জিলের বেগমরা এই গন্ডোলায় চেপে গোমতী নদীতে ভেসে বেড়াতেন কি না সেটা এখনও জানা যায় নি, তবে এত বিশাল একটি গন্ডোলা ঠিক কী কাজে নবাবরা ব্যবহার করতেন তাই নিয়েই নতুন উৎসাহে খোঁজ শুরু করেছেন প্রত্নতাত্ত্বিকরা।
লখনৌয়ের নবাবী ইতিহাস নিয়ে চর্চা করেন পিসি সরকার। তাঁর মতে, এটি নিঃসন্দেহে একটা বিরাট খোঁজ। নবাবী ঘরানার অনেক অজানা তথ্যের ঝাঁপি খুলে দেবে এই আবিষ্কার। তাঁর কথায়, “নবাবরা নৌবিহারের জন্য যে ধরনের গন্ডোলা বা প্রমোদতরী ব্যবহার করতেন, সেটি হয় মাছের আকৃতির, বা কুমীরের মুখযুক্ত বা ময়ূরপঙ্খী গঠনের হতো। যদিও এই গন্ডোলায় এখনও পর্যন্ত তেমন বিশেষ কোনও গঠন দেখা যায়নি। অথছ তার কাঠের পাটাতনে ইউরোপীয় ও নবাবী স্থাপত্যের ছাপ স্পষ্ট।সুতরাং সেটি কোন বিশেষ কাজে ব্যবহার হতো তার খোঁজ মিললেই নবাবী ইতিহাসের আরও একটা নতুন অধ্যায় খুলে যাবে। ”