স্বস্তিকার আগের একটি সংখ্যায় ঘৃণার প্রচারকারীদের অর্থাৎ হেট ক্যাম্পেনারদের সম্বন্ধে লিখেছিলাম। আজ সামগ্রিকভাবে হেট ক্যাম্পেন অর্থাৎ ঘৃণার প্রচার সম্পর্কে বলব। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোধ্যায়ের একটি ভোট-প্রচার ভিডিয়োতে দেখা যায় তিনি ভোটারদের কাছে আহ্বান জানাচ্ছেন বিজেপিকে রুখতে কেবল তার দলকেই ভোট দিন, কংগ্রেস-সিপিএমকে ভোট দিয়ে ভোট নষ্ট করবেন না। কারণ এই দুই দল জিততে তো পারবেই না, বরং এদের ভোট দিলে তৃণমূলের ভোট কমে যাওয়ার কারণে বিজেপি জিতে যেতে পারে। চৌত্রিশ বছরের বাম আমলে আমরা একটা চিত্র দেখেছিলাম, কংগ্রেস ভেঙে তৃণমূল তৈরি হওয়ার পর বিরোধী ভোট ভাগাভাগিতে বামপন্থীদের জয়ের সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে।
তখন বলা হতো, বামপন্থীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে দক্ষিণপন্থীদের একজোট হতে হবে। মুসলমান ভোট লালায়িত মমতা তার সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সঙ্গী বিজেপিকে মুহূর্তের মধ্যে নস্যাৎ করে, তার বহু আন্দোলনের বিশ্বাসঘাতক শত্রু কংগ্রেসিদের হাত ধরে সিপিএমকে বাঙ্গলা ছাড়া করেছিলেন, রাজ্যের মানুষও তখন যেন-তেন-প্রকারে বামফ্রন্টকে ক্ষমতাচ্যুত করতে দলীয় মতের ঊর্ধ্বে উঠে এই জোটকেই বিকল্প বলে মেনে নিয়েছিলেন। মমতা আজ যখন বিজেপির বিরুদ্ধে এই একই নীতি নিতে যাচ্ছেন, তখন অঙ্কের হিসেবে প্রচুর গরমিল হচ্ছে। সিপিএম শেষ পর্যন্ত একটি নিন্দনীয়, ঘৃণিত সত্তায় পরিণত হয়েছে, আর বিজেপি এখনও হিন্দুদের আস্থা ও মর্যাদার একমাত্র প্রতীক হিসেবে গণ্য। বাম আমলের অত্যাচার, আর বিজেপির আমলে ভারতীয়দের সুরক্ষা, স্বদেশ অস্মিতা– এই দুই শাসনের নরক ও স্বর্গের রূপ দেখিয়ে দিয়েছে।
ফলে সেদিন বিরোধী নেত্রী হিসেবে উজ্জ্বল ভাবমূর্তির অধিকারিণী মমতা যে ফয়দা লোটার সুযোগ পেয়েছিলেন, আজ শাসন-ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে নগ্ন মুসলমান তোষণ, সেনা-বিরোধিতা, দেশদ্রোহিতা, আর্থিক দুর্নীতি— এরকম
নানা কলঙ্কে জড়িয়ে তিনি একমাত্র শত্রু বিবেচনা করেছেন বিজেপিকে, আরও ভালোভাবে বললে নরেন্দ্র মোদীকে। তাই কংগ্রেস সমর্থক -বাম সমর্থকের দরজাতেও তাকে কড়া নাড়তে হয়। ভারতীয় সংসদীয় গণতন্ত্রে বহুত্ববাদের প্রথম পূজারি অটলবিহারী বাজপেয়ী দেখিয়েছিলেন একান্ন শতাংশ মানুষের মতদানই গণতন্ত্রের কাঠামোয় শেষ কথা বটে কিন্তু বহু স্বরের অনুরণন তখনই সম্ভব যদি ওই একান্ন শতাংশের মাধ্যমে একশোশতাংশতেই মনোভাব প্রতিফলিত হয়।
এনডি এ গঠনের মাধমে জোট রাজনীতির যে মাপকাঠি অটলজী আজ থেকে কুড়ি বছরেরও বেশি সময় আগে নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন, পরে দশ বছর যে রাজনীতিকে মানতে বাধ্য হয়েছিল ভারতীয় সংসদীয় গণতন্ত্রের ওপর প্রভুত্ব করা কংগ্রেস, আজ বিজেপি বিরোধিতায় নেমে সেই রাজনৈতিক বহুত্ববাদকে কীভাবে কলুষিত করা হচ্ছে মায়াঅখিলেশ, চন্দ্রবাবু-মমতা- লালুপ্রসাদরাহুল গান্ধীরা দেখিয়ে দিচ্ছেন প্রতিনিয়ত। কারোর সঙ্গে কারো মিল নেই, জোটধর্ম পালনের ন্যূনতম সদিচ্ছা কারোর নেই, তাই একদিকে দেখি উত্তরপ্রদেশে মায়া- অখিলেশের জোটে কংগ্রেস ব্রাত্য, পশ্চিমবঙ্গে মমতা একাই বিয়াল্লিশ (প্রার্থীপদের নিরিখে), কংগ্রেস-সিপিএমের মুখ দেখাদেখি এরাজ্যে বন্ধ, আবার অন্ধ্রে কিংবা দিল্লিতে কংগ্রেসের প্রতিযোগী চন্দ্রবাবু বা কেজরি, কেরলে আবার সরাসরি রাহুল বনাম বামেদের লড়াই। অথচ এরাই ব্রিগেডে হাত ধরাধরি করে বার্তা দিতে চায় আমরা বিজেপির বিপক্ষে।
ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির লড়াইয়ে নেমে বিজেপির বিরুদ্ধে ঘৃণাই এদের মূলধন। তাই ভারতীয়দের জুজু এদের দেখাতেই হবে, সে গো-ভক্ষণের অজুহাতেই হোক কিংবা এনআরসি, সে উগ্র প্রাদেশিকতা বা হিন্দি বিরোধিতা ও সাম্প্রদায়িকতার মোড়কেই হোক বা রাষ্ট্রদ্রোহিতা। টুকরে টুকরে গ্যাং বিশ্বের কাছে নিজেদের আন্তর্জাতিকতাবাদী প্রমাণ করতে চায়, অথচ এদের স্লোগানেই থাকে বিচ্ছিন্নতাবাদ আর বিশ্ব সন্ত্রাসবাদের ইন্ধন। সংসদীয় কাঠামোয় এই যে একটি দলের বিরুদ্ধে ঘৃণা— আর যাই ভারতীয় গণতন্ত্রের পক্ষে শুভ নয়।
এর পেছনে নেহরুবাদের অনেকটা অবদান আছে। যে মার্কসীয় তাত্ত্বিকদের ইতিহাস-রচনাকে দেশের প্রকৃত ইতিহাস রচনার পথে সবচেয়ে বড়ো অন্তরায়। হিসেবে গণ্য করা উচিত ছিল, আজ তাদেরই মূল ধারার ইতিহাস রচয়িতা হিসেবে সমাদর করা হচ্ছে। নেহরুবাদ মুছে গেলে, পরিবারতন্ত্র অবলুপ্ত হলে যে ভারতের স্বাভিমান আবার জাগ্রত হবে, ধান্দাবাজির রাজনীতিতে বিশুদ্ধতার ছোঁয়া লাগবে, এটা মানতে অনেক রাজনীতিকেরই অসুবিধা হচ্ছে, তাই ঘৃণার আমদানি।
বিশ্বামিত্রের কলম
2019-05-09