রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই বলা হয়, এটি সম্পূর্ণ সমাজের সংগঠন। স্বাধীনতার পরেও সঙ্ঘের এই ভূমিকায় কোনও বদল আসেনি। তাই স্বাধীনতার পরে ১৯৪৯ সালে সঙ্ঘের যে সংবিধান তৈরি হয়, তাতে স্পষ্ট ভাবে বলা হয় যে, যদি কোনও স্বয়ংসেবক রাজনীতিতে সক্রিয় হতে চান তবে তিনি যে কোনও রাজনৈতিক দলের সদস্য হতে পারেন। এই সংবিধান রচনা ভারতীয় জনসঙ্ঘ তৈরি হওয়ার আগে হয়েছে। জনসঙ্ঘ স্থাপনার পরে সেখানে অনেক স্বয়ংসেবক ও প্রচারক যোগ দেওয়ার পরেও নীতিগত কোনও বদল হয়নি।

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় একাধিক দল থাকাটাই স্বাভাবিক। সঙ্ঘ যে-হেতু সম্পূর্ণ সমাজের সংগঠন তাই এটাই স্বাভাবিক, যে সমাজের কোনও ক্ষেত্র সঙ্ঘের কাছে অস্পৃশ্য থাকবে না এবং স্বয়ংসেবকরা সমাজ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নিজেদের রাষ্ট্রীয় ভাবনা নিয়ে যাবেন। তাই কিছু স্বয়ংসেবক সক্রিয় রাজনীতিতে আছেন মানে সঙ্ঘ রাজনীতি করে বা সঙ্ঘ রাজনৈতিক দল, এমনটা বলা অনুচিত ও ভুল হবে। রাজনৈতিক দল সমাজের শুধুমাত্র একটি অংশের প্রতিনিধিত্ব করে আর সমাজের অন্য অংশও রয়েছে। সঙ্ঘ যে-হেতু সম্পূর্ণ সমাজের সংগঠন তাই ‘সম্পূর্ণ’ একটি ‘অংশ’-এর কী করে হবে?

সঙ্ঘ স্থাপনার (১৯২৫) পরে ১৯৩০ সালে ডাক্তার হেডগেওয়ার সত্যাগ্রহ আন্দোলনে অংশ নেওয়ার সময়ে, অন্য স্বয়ংসেবক এবং সহকারীদের সঙ্গে সত্যাগ্রহে যাওয়ার আগে, সরসঙ্ঘচালকের দায়িত্ব নিজের সহকারী ডাক্তার পরাঞ্জপেকে দিয়ে দেন। তিনি ব্যক্তিগত ভাবে সত্যাগ্রহ আন্দোলনে অংশ নেনে এবং তার জন্য এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয়। স্বাধীনতার পরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার পটেল যখন সঙ্ঘকে কংগ্রেসের সঙ্গে মিশে যাওয়ার কথা বলেন তখন শ্রী গুরুজি তা মেনে নেননি কারণ, সঙ্ঘ একটি দল হতে চায়নি, সম্পূর্ণ সমাজকে সংগঠিত করতে চেয়ছে। রাজনীতিতে একটি জাতীয়তাবাদী দলের প্রয়োজন রয়েছে এবং সেই শূন্যতা সঙ্ঘের পূরণ করা উচিত বলে ডক্টর শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় প্রস্তাব করলে শ্রী গুরুজি স্পষ্ট বলে দেন, এই কাজ আপনি করুন, সঙ্ঘ আপনাকে সহযোগিতা করবে, কিন্তু সঙ্ঘ সম্পূর্ণ সমাজকে সংগঠিত করার কাজই করে যাবে।

১৯৭৭ সালে জরুরি অবস্থার পরে যখন জনতা পার্টি নির্বাচন জিতল তখন সেবার স্বয়ংসেবকরা তাতে মনপ্রাণ দিয়ে যোগ দেন। অনেক দল মিলে জনতা পার্টি গঠন হয়। কিন্তু সঙ্ঘ অনেক সে পথে হাঁটেনি ক্ষমতাসীন দলের অনেক লোভনীয় প্রস্তাব সত্বেও। তৎকালীন সরসঙ্ঘচালক শ্রী বালাসাহেব দেওরস প্রস্তাব ফিরিয়ে বলেছিলন, জাতীয় জীবনে একটা বিশেষ ও জটীল পরিস্থিতিতে সঙ্ঘ নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। কিন্তু এখন সঙ্ঘ তার নির্দিষ্ট লক্ষ্য সম্পূর্ণ সমাজ গঠনের কাজই করবে।

এটা বোঝার জন্য সমাজে সংগঠন নয়, সম্পূর্ণ সমাজকেই সংগঠিত করতে সঙ্ঘের যে আদর্শ তা বোঝা দরকার।

২০১৮ সালে অখিল ভারতীয় প্রতিনিধি সভা হয় নাগপুরে। সেখানে সরকার্যবাহের আমন্ত্রণে প্রবীন স্বয়ংসেবক এমজি বৈদ্য (১৯৩১ সালে আট বছর বয়সে স্বয়ংসেবক হন) এক দিনের জন্য যোগ দেন। ৯৫ বছর বয়সের বৈদ্যকে সেই দিন সরসঙ্ঘচালক মোহনজি ভাগবতের হাত দিয়ে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। এর পরে তিনি বলেন, “সঙ্ঘকে বোঝা সহজ কাজ নয়। পাশ্চাত্যের দ্বৈত (binary) ভাবনা থেকে বোঝা সম্ভব নয়। ভারতীয় ভাবনার একাত্ম মানসিকতা থেকেই সঙ্ঘকে বোঝা সম্ভব।”

‘ইশাবস্য উপনিষদ’-এর পঞ্চম মন্ত্রে আত্মতত্ত্ব বর্ণনার সময়ে উপনিষদকার বলেছেন–
তদেজতি তত্রৌজতি তদদুরে তদুন্তিকে।
তদন্তরস্য সর্বস্য তদু সর্বস্য বাহ্যতঃ।।

অর্থাৎ এই আত্মতত্ত্ব স্থির আবার স্থির নয়। এটা দূরের, আবার কাছেরও। এটা সবার ভিতরে রয়েছে আবার বাইরেও।

এটাকে পরস্পরবিরোধী মনে হতে পারে কিন্তু এটাই সত্য।

সঙ্ঘও অনেকটা এই রকম। সঙ্ঘ সম্পূর্ণ সমাজের সংগঠন। আর সমাজের চেহারাটা সব সময়েই মিশ্র। সমাজের সাংস্কৃতিক, শ্রমিক, ছাত্রছাত্রী, শিক্ষা, সেবা রাজনীতি, ধার্মিক এমন অনেক ক্ষেত্রে রয়েছে। কিন্তু সঙ্ঘ এর কোনও একটি অঙ্গের সংগঠন নয়, সম্পূর্ণ সমাজের সংগঠন। কোনও ক্ষেত্রই বাদ নেই সঙ্ঘে। স্বয়ংসেবকরা সব ক্ষেত্রেই সক্রিয়। আবার একই সঙ্গে সঙ্ঘ সমাজের একটি মাত্র সংগঠন হতে পারে না। এসব কিছুর মধ্যেই সঙ্ঘ আরও বেশি কিছু। এটা সম্পূর্ণ সমাজের সংগঠন।

একই কথা বলা হয়েছে পুরুষসুক্তে। এই পৃথিবী-সহ সম্পূর্ণ বিশ্বে ব্যপ্ত হয়েও সে সামান্য (স ভূমি বিশ্বতো বৃত্বাত্যতিষ্ঠদশাঙ্গুলং।)।

আণবিক বিজ্ঞানীরা এক সময়ে দাবি করেছিলেন যে, অণু অবিভাজ্য। পরবর্তীকালে তাঁরা বলেন, অণু বিভাজ্য এবং তার মধ্যে নিউট্রন, প্রোটন ও ইলেক্ট্রন তিনটি কণা রয়েছে। আরও পরে তাঁরা জানান শুধু তিনটিই নয়, অনেক কণা মিলিয়েই অণু। আরও পরে তাঁরা জানান, শুধু কণাই নয়, অণুর ভিতরে রয়েছে তরঙ্গের মতো উপাদান। এর পরে এই তত্ত্ব আসে যে এটা কণা বা তরঙ্গ নয়, এটা দু’টোই। এর মধ্যে দুই চরিত্রই বিদ্যমান আর এটা কখনও কণা কখনও তরঙ্গ। এটাই হিসেনবার্গের ‘অনিশ্চয়তা তত্ব’। একই কথা ‘ইশাবাস্য উপনিষদ’-এ বলা হয়েছে। এটা বুঝতে পারলেই আপনি ভারতীয় ভাবনার একাত্ম তত্ত্ব বুঝতে পারবেন। তবেই আপনি সঙ্ঘের আসল স্বরূপ বুঝতে পারবেন বলে এমজি বৈদ্য বলেন।

এই কারণে, সঙ্ঘ সম্পূর্ণ সমাজের সংগঠন হওয়ায় এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্র সমাজের একটি অঙ্গ হওয়ায় এই ক্ষেত্রেও স্বয়ংসেবকরা সক্রিয় হবেন। নির্বাচন গণতন্ত্রের উৎসব হওয়ায় তাতে যাতে বেশি মানুষ অংশ নেন তার জন্য এবং স্থানীয় ছোটখাট বিষয়ের থেকে বেশি করে জাতীয় ভাবনা থেকে মানুষ যাতে নির্বাচনে অংশ নেন তার জন্য জনজাগরণের কাজও এক জন সুনাগরিক হিসেবে স্বয়ংসেবকরা করবেন। সঙ্ঘের সংবিধান কোনও স্বয়ংসেবককে (পদাধিকারীদের নয়) কোনও রাজনৈতিক দল বা প্রার্থীর প্রচার করা থেকে বিরত করে না। কিন্তু ৯০ শতাংশ স্বয়ংসেবকই কোনও দল বা প্রার্থীর নাম না নিয়ে জাতীয় ইস্যু নিয়ে জনজাগরণের কাজ করেন। তা সত্ত্বেও সঙ্ঘ কোনও রাজনৈতিক দল নয় বা কোনও রাজনৈতিক দলের অংশও নয়। সম্পূর্ণ সমাজের সংগঠনের কাজই করে সঙ্ঘ। একে ভারতীয় ভাবনার একাত্ম তত্ত্ব ও ‘ইশাবস্য উপনিষদ’-এর দৃষ্টি দিয়েই বোঝানো সম্ভব।

মনমোহন বৈদ্য

লেখক: সহ-সরকার্যবাহ, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.