একটা কাগজ হাতে নিল মেয়েটা। তারপর মনের মধ্যে জমে থাকা সমস্ত কথাগুলো লিখে ফেলল। একটা কথাও ফেলে রাখতে চায়নি মায়ের জন্য। ক্ষমাও চেয়ে নিয়েছিল, কারণ মেয়েটা জানত মায়ের সঙ্গে ওর আর দেখা হবে না। দেখা করতে চাইছিলও না, কারণ এবার মায়ের সঙ্গে দেখা হলেই ব্রিটিশদের হাতে ধরা দিতে হবে। ওদের হাতে প্রাণ যাওয়ার থেকে বিষ খাওয়াও অনেক ভালো। এটাই হয়তো মনে করেছিল কৈশোরজীবন থেকে নবযৌবনা মেয়েটি। লেখাগুলো লিখতে একটুও হাত কাঁপেনি। চিঠি শেষ করে জিভে পটাশিয়াম সায়ানাইড ঠেকিয়ে নেয় প্রীতিলতা। তারপর…ইতিহাসের পাতায় চিরতরে নাম লেখা হয়ে গিয়েছিল ওঁর।
প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে মহিলা বাঙালি শহীদদের অন্যতম। শেষ চিঠিতে মা’কে কি লিখেছিল ২১ বছরের মেয়ে ? তিনি লিখেছিলেন, “মাগো, তুমি আমায় ডাকছিলে? আমার যেন মনে হলো তুমি আমার শিয়রে বসে কেবলি আমার নাম ধরে ডাকছো, আর তোমার অশ্রু-জলে আমার বক্ষ ভেসে যাচ্ছে।
মা, সত্যিই কি তুমি এত কাঁদছো? আমি তোমার ডাকে সাড়া দিতে পারলাম না—তুমি আমায় ডেকে ডেকে হয়রান হয়ে চলে গেলে। স্বপ্নে একবার তোমায় দেখতে চেয়েছিলাম—তুমি তোমার আদরের মেয়ের আবদার রক্ষা করতে এসেছিলে! কিন্তু মা, আমি তোমার সঙ্গে একটি কথাও বললাম না। দুচোখ মেলে কেবল তোমার অশ্রুজলই দেখলাম। তোমার চোখের জল মোছাতে এতটুকু চেষ্টা করলাম না।
মা, আমায় তুমি ক্ষমা করো—তোমায় বড় ব্যথা দিয়ে গেলাম। তোমাকে এতটুকু ব্যথা দিতেও তো চিরদিন আমার বুকে বেজেছে। তোমাকে দুঃখ দেওয়া আমার ইচ্ছা নয়। আমি স্বদেশ-জননীর চোখের জল মোছাবার জন্য বুকের রক্ত দিতে এসেছি। তুমি আমায় আশীর্বাদ কর, নইলে আমার মনোবাঞ্ছা পুর্ণ হবে না। একটিবার তোমায় দেখে যেতে পারলাম না! সেজন্য আমার হৃদয়কে ভুল বুঝোনা তুমি। তোমার কথা আমি এক মুহুর্তের জন্যও ভুলিনি মা। প্রতিনিয়তই তোমার আশির্বাদ প্রার্থনা করি।
আমার অভাব যে তোমাকে পাগল করে তুলেছে, তা আমি জানি। মাগো, আমি শুনেছি, তুমি ঘরের দরজায় বসে সবাইকে ডেকে ডেকে বলছো, ‘ওগো তোমরা আমার রাণীশূন্য রাজ্য দেখে যাও’। তোমার সেই ছবি আমার চোখের ওপর দিনরাত ভাসছে। তোমার এই কথাগুলো আমার হৃদয়ের প্রতি তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে কান্নার সুর তোলে।
মাগো, তুমি অমন করে কেঁদোনা! আমি যে সত্যের জন্য-স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিতে এসেছি, তুমি কি তাতে আনন্দ পাও না?
কি করবে মা? দেশ যে পরাধীন! দেশবাসী যে বিদেশীর অত্যাচারে জর্জরিত! দেশমাতৃকা যে শৃঙ্খলভারে অবনতা, লাঞ্ছিতা, অবমানিতা! তুমি কি সবই নীরবে সহ্য করবে মা? একটি সন্তানকেও কি তুমি মুক্তির জন্য উৎসর্গ করতে পারবে না? তুমি কি কেবলই কাঁদবে?
আর কেঁদোনা মা। যাবার আগে আর একবার তুমি আমায় স্বপ্নে দেখা দিও। আমি তোমার কাছে জানু পেতে ক্ষমা চাইবো।আমি যে তোমায় বড় ব্যথা দিয়ে এসেছি মা। ইচ্ছা করে ছুটে গিয়ে তোমার কাছে ক্ষমা চেয়ে আসি। তুমি আদর করে আমাকে বুকে টেনে নিতে চাইছো, আমি তোমার হাত ছিনিয়ে চলে এসেছি। খাবারের থালা নিয়ে আমায় কত সাধাসাধিই না করেছো—আমি পিছন ফিরে চলে গেছি। না, আর পারছি না। ক্ষমা চাওয়া ভিন্ন আর আমার উপায় নেই। আমি তোমাকে দুদিন ধরে সমানে কাঁদিয়েছি। তোমার ক্রন্দন আমাকে এতটুকু টলাতে পারেনি। কি আশ্চর্য মা! তোমার রাণী এত নিষ্ঠুর হতে পারলো কি করে? ক্ষমা করো মা, আমায় তুমি ক্ষমা করো!”
প্রীতিলতার মৃত্যুর পর মাষ্টারদা এই চিঠিটি প্রীতিলতার মায়ের হাতে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন।১৯৩২ সালে পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাব দখলের সময় তিনি ১৫ জনের একটি বিপ্লবী দল পরিচালনা করেন। প্রীতিলতার দলটি ক্লাবটি আক্রমণ করে এবং পরবর্তিতে পুলিশ তাদের আটক করে। পুলিশের হাতে ধরা পড়া এড়াতে প্রীতিলতা পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যা করেন। ৫ মে ১৯১১-র এমন দিনেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন প্রীতিলতা।