চীনের উইঘুর সমস্যা ও সরকার কর্তৃক তার মোকাবিলা

প্রাচীন ইতিহাস :

উইঘুররা পূর্ব ও মধ্য এশিয়ার তুর্কি জাতি-গোষ্ঠীভুক্ত সম্প্রদায়। তবে বর্তমানে তারা প্রধানত উত্তর-পশ্চিম চীনের স্বশাসিত জিংজিয়াং অঞ্চলে বাস করে। এতদ্ব্যতীত তাইওয়ান কাউন্টিতেও তারা বাস করে। তাদের আচরিত ধর্ম ইসলাম। কিন্তু আদিতে তা ছিল না। দশম শতাব্দীতে কালুগ, ইয়াগমাস, চিগিলস প্রভৃতি তুর্কি উপজাতিরা পশ্চিম তিয়েন শানের সেমিরেচাই ও কাশগরিয়াতে কারা-খানিদ খানেত স্থাপন করেন এবং পরবর্তীকালে ট্রান্সক্সিয়ানা দখল করেন। সুলতান সাতুক বুঘরা খান তুর্কি রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করে কারাখানিদদের মুসলমানে রূপান্তরিত করেন। এরাই পরে উইঘুর সম্প্রদায় হন। খেতানের ইন্দো-ইউরোপীয় শক বৌদ্ধদের তুর্কি মুসলমান কারাখানিদরা একাদশ শতাব্দীতে জয় করেন তবে উইঘুররা পঞ্চদশ শতাব্দী পর্যন্ত বৌদ্ধ ছিল এবং সপ্তদশ শতাব্দীতে তারা সম্পূর্ণ মুসলমান হয়ে যায়। ভারতের হিন্দুদের বিপুল সংখ্যায় ধর্মান্তরিত হওয়ার সঙ্গে এর সাদৃশ্য লক্ষণীয়। পূর্বতন বৌদ্ধ ইউঘুরদের তাদের পূর্বপুরুষদের স্মৃতি সম্পূর্ণ ভুলিয়ে দেওয়া হয় এবং তাদের শেখানো হয় যে কাফের কালমুকরা তাদের এলাকায় বৌদ্ধ ধাঁচাগুলি নির্মাণ করেছিল অর্থাৎ সেখানে বৌদ্ধ বলে কিছু ছিল না। বাংলাদেশে লালন কর নামে এক হিন্দুকে এবং তার হিন্দু ভৈরবীদের বেগম খালেদা জিয়া মুসলমান হিসাবে কবর দেয়। যদিও তারা অনেক আগেই পরলোকগমন করেছিলেন এবং মৃত্যুর অনেক পরে তার আসল নাম লালন কর পালটে লালন ফকির শাহ রাখা হয়। পারস্যের পারসিক ও আরবদেশগুলির প্রাক-ইসলামিকরণের যুগের সংস্কৃতিকে সম্পূর্ণ মুছে ফেলা হয়েছে এবং এটাই ইসলামের দস্তুর।

সুফি ও নাক্সবন্দিরাও ইসলাম প্রচার করেছিল। সপ্তদশ শতাব্দীতে বৌদ্ধ জুঙ্গার খানেত জুঙ্গারিয়াতে ক্ষমতা দখল করেছিল। ১৭৫০ সালে জুঙ্গার বৌদ্ধদের উপর গণহত্যা চালায় মুসলমানেরা এবং মজার কথা তিববতীয় বৌদ্ধ কিং রাজবংশের অধীনে প্রায় ২ কোটি বৌদ্ধ নিহত হয়। ফলত মুসলমান আধিপত্য শুরু হয়। ১৯১২ সালে কিং রাজবংশকে হটিয়ে চীন প্রজাতন্ত্র চালু হয়। উইঘুর মুসলমানরা সোভিয়েত কমিউনিস্ট নেতা জোসেফ স্টালিনের সমর্থনে ১৯৩৩ ও ১৯৪৪ সালে কয়েকবার অভ্যুত্থান চালিয়েছিল। ১৯৪৯ সালে ১ অক্টোবর মাওয়ের নেতৃত্বে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন সৃষ্টির পর মাও সৈফুদ্দিন আজিজিকে পূর্ব তুর্কিস্থান প্রজাতন্ত্রের প্রথম কমিউনিস্ট পার্টি গভর্নর নিযুক্ত করেন। উইঘুর বিচ্ছিন্নতাবাদ শুরু হয় তখন থেকে। উইঘুর নেত্রী রাবিয়া কাদের ২০০৯ সালে উরুমকি দাঙ্গা লাগায়।

বর্তমান অবস্থা :

বর্তমানে সিনজিয়াঙে উইঘুররা সর্বাত্মক পুলিশ রাজেরশাসনে বাস করছে। তাদের ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক জীবনের উপরে কঠোর দমন পীড়ন চালানো হচ্ছে। প্রথমে অস্বীকার করলেও চীন সরকার উইঘুররা যাতে কোনো রকম ধর্মীয় চরমপন্থার আশ্রয় না নেয় তার উপর কড়া নজর রেখে চলেছে। তার মধ্যে আছে উইঘুর সম্পর্কিত বই, দাড়ি রাখা, নমাজের জন্য কোনো বস্ত্র পরিধন করা ইত্যাদির উপর বিধিনিষেধ আরোপ। এমনকী লোকের বাড়িতে বাড়িতে ক্যামেরা বসানো হয়েছে। প্রায় ১০ লক্ষ উইঘুরকে গণ-আটক শিবিরে ধরে রাখা হয়েছে ‘পুনর্শিক্ষা শিবির’ নাম দিয়ে। সেখানে বন্দিদের রাজনৈতিক চিন্তা, সাংস্কৃতিক পরিচয় এবং ধর্মীয় বিশ্বাস বদলানোর চেষ্টা চলছে। কয়েকজনকে সারাদিনে চব্বিশ ঘণ্টাই আটক রাখা হয় আর কয়েকজন শুধু রাতে বাড়ি যাওয়ার অনুমতি পায়। বন্দি অধিবাসীরা চীনা কমিউনিস্ট পার্টির প্রশংসা করে গান গায় এবং ‘আত্মসমালোচনা মূলক প্রবন্ধ’ লেখে। রক্ষীদের দিয়ে বন্দিদের উপর শারীরিক ও মৌখিক অত্যাচার চালানো হয়। এমনকী তাদের পরিবারের উপরও নজরদারি চলে। পুত্র বা স্বামীদের সন্দেহজনক কাজের জন্য মহিলাদেরও আটক করা হয়।

প্রথমে পুরোপুরি অস্বীকার করলেও বেজিং এখন বলছে সন্ত্রাসবাদ দমন করতে ও উইঘুর জনগণকে বৃত্তিমূলক শিক্ষা দিতে শিবিরগুলো খোলা হয়েছে। তথাকথিত মানবতাবাদী সংগঠনগুলো বারংবার বলা সত্ত্বেও শিবির পরিদর্শনের সুযোগ দেয়নি চীন সরকার, উপরন্তু সংবাদমাধ্যমগুলো জানিয়েছে যে অনেককে ওই শিবিরে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে রাখা হয়েছে।তাদের সেখানে মগজ ধোলাই করা হয়। স্ত্রী ও পুরুষদের দীর্ঘকাল বিচ্ছিন্ন রাখার কৌশল নেওয়া হয়েছে যাতে সন্তান উৎপাদন না করতে পারে এবং দেশের জনবিন্যাসে পরিবর্তন না করতে পারে।

রাষ্ট্রসঙ্ঘের মানবাধিকার পরিষদের এক বৈঠকে মুসলমান উইঘুর সম্প্রদায়ের গণ-আটকের তীব্র নিন্দা করেছে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা-সহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ। কিন্তু এই নিন্দাপবাদ উড়িয়ে দিয়ে চীন বলেছে এসব রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। যুক্তরাষ্ট্রের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স মার্ক ক্যাসেয়ার্স চীনের কাছে দাবি জানিয়েছে তারা যেন উইঘুর ও অন্যান্য মুসলমান সংখ্যালঘুর স্বেচ্ছাচারী দমনমূলক আটক করা থেকে বিরত থাকে। প্রায় ১০ লক্ষ উইঘুরকে তথকথিত পুনর্শিক্ষা কেন্দ্রগুলোতে মনস্তাত্ত্বিক দীক্ষাদান করা হয়; এদের দিয়ে কমিউনিস্ট প্রচার ও চীনা রাষ্ট্রপ্রধান জি জিনপিয়াংকে ধন্যবাদ দেওয়া এসব করানো হয়। চীন কর্তৃপক্ষ ওয়াটারবোর্ডিং ও অন্যান্য অত্যাচার প্রক্রিয়া চালায়। ওয়টারবোর্ডিং এমন এক জিজ্ঞাসাবাদ পদ্ধতি যাতে কোনো ব্যক্তিকে একটা বোর্ডের সঙ্গে বেঁধে দেওয়া হয় উপর দিকে মুখ করে যেটা নীচের দিকে গড়াতে থাকে আর সেই সঙ্গে খুব বেশি করে নাকে মুখে জল ঢালা হয় যাতে তার অনুভূতি হয় যে সে ডুবে যাচ্ছে। পক্ষান্তরে চীনের বিদেশ মন্ত্রী বলছেন— ‘বিশাল সংখ্যার মানুষকে মানবাধিকার দেওয়া হচ্ছে। আবার তাদের বাঁচানোও হচ্ছে।’ তিনি আরও বলেছেন — ‘বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসদমনের এক নতুন পথ দেখিয়েছে চীন’। সত্য কথাই বলেছে, কিন্তু কাশ্মীর নিয়ে যত হইচই হয় বিশ্বজুড়ে এক্ষেত্রে তার ছিটেফোটাও হয় না।

সুন্নি সম্প্রদায়ভুক্ত উইঘুররা এশিয়-তুর্কি ভাষায় কথা বলে। তারা চীনের থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চায় এবং ওই অঞ্চলকে পূর্ব-তুর্কিস্তান বলে। প্রাচীন সিল্ক রুটের বাণিজ্যপথে অবস্থিত জিংজিয়াং তেল ও খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ চীনের অন্যান্য অংশের অগ্রগতির সঙ্গে এখানেও উন্নতি হয় এবং চীনের অন্য অংশ থেকে হান গোষ্ঠীর চীনারা সেখানে অভিগমন করে। কিন্তু এর ফলে জনতাত্ত্বিক পরিবর্তন হয় ও হানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়। এতে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়, বিশেষত শহরাঞ্চলে। ২০০৯ সালে জিংজিয়াংয়ের রাজধানী উরুমকিতে দাঙ্গা হয়; উইঘুররা চীন সরকারের দমননীতি ও হান সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রতিবাদে অমুসলমানদের আক্রমণ করে।

প্রায় ২০০ লোক নিহত ও কয়েকশো আহত হয়েছিল সেই জাতিদাঙ্গায়। জিংজিয়াং চীনের উচ্চাকাঙ্ক্ষী লক্ষ্য কোটি ডলারের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ প্রকল্পের কেন্দ্রভূমিতে পড়ে এবং সরবরাহের আকর। চীনের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী তার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাব বাড়াতে চায়। চীনের বিশ্বব্যাপী উচ্ছাভিলাষের ক্রমবর্ধমান গুরুত্ব তাকে বাধ্য করছে এই এলাকায় তার মুঠো দৃঢ় করতে। এর পরে ২০১৬ ও ২০১৭ সালে তারা দমনমূলক নীতি নিয়েছে। তারা সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় স্বাধীনতা খর্ব করেছে। এবং বর্ধিত মাত্রায় তাদের উপরে নজরদারি চালাচ্ছে। কিন্তু উইঘুররা হিংস্র ভাবে অনেক জায়গায় আক্রমণ চালাচ্ছে। শিশুদের মুসলমান নাম রাখতে নিষেধ করা হয়েছে। সারা ২০১৭ সাল ব্যাপী এটা চলে। ২০১৬-তে চেন কুয়ানগুও নামে এক জাঁদরেল কমিউনিস্ট নেতাকে জিংজিয়াংয়ে প্রেরণ করা হয়েছিল। তিনি এর আগে তিব্বতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার কাজে অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন। তিনি তি শহরে ৫০০ লোকের একটা করে বর্গাকার এলাকা চিহ্নিত করেছিলেন এবং প্রতি বর্গক্ষেত্রের জন্য একটি করে থানা গঠিত করেন সারাক্ষণ অধিবসীদের উপর নজরদারি চালানোর জন্য। অনুরূপভাবে গ্রামীণ এলাকায় প্রতিটা গ্রামের জন্য একটি করে থানা তৈরি করা হয়। ট্রেন স্টেশনে নিরাপত্তা চেকপয়েন্ট স্থাপিত হয় যেখানে প্রত্যেকে তার আইডি কার্ড স্ক্যান করাবে। মুখের স্ক্যান করানো হয়েছে। পুলিশ ফোন বাজেয়াপ্ত করে সকলের গতিবিধি নথিভুক্ত করেছে এবং যাতে তারা বিদেশ যেতে না পারে তার জন্য পাসপোর্ট বাজেয়াপ্ত করেছে।

উইঘুররা যেমন সংঘাতের পথ বেছে নিয়েছে, চীন সরকার তার পাল্টা দমনের পথ অবলম্বন করেছে। ভারতের কাশ্মীর নীতিতে এর কী প্রভাব পড়ে তা দেখার বিষয়।

সুদীপ নারায়ণ ঘোষ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.