শ্রীগুরুজী ও বাঙ্গালী

শ্রী মাধব সদাশিব গলওয়ালকর (এর পরে শ্রীগুরুজী নামে উল্লিখিত হবেন) ওরফে শ্রীগুরুজী রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের দ্বিতীয় সরসঙ্ঘচালক। প্রখর রাষ্ট্রবাদ ও সমাজ জাগরণে অসাধারণ কাজের জন্য রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ চিরদিনই রাষ্ট্রবিরোধী ও সমাজবিরোধী শক্তির চক্ষুশূল হয়ে থেকেছে। বিশেষ করে কমিউনিস্ট মতাদর্শের ধ্বজাধারী দুর্বুদ্ধিজীবিবৃন্দ চিরদিনই সঙ্ঘ সম্পর্কে মিথ্যা প্রচারের মাধ্যমে সমাজে বিভ্রান্তি তৈরি করেছে।

রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের দার্শনিক অধিষ্ঠান স্পষ্ট করার বিশেষ শ্রেয় শ্রীগুরুজীর। অপর পক্ষে  সঙ্ঘের প্রতিষ্ঠাতা ডাক্তার কেশব বলিরাম হেডগেওয়ার ও শ্রীগুরুজীর ত্যাগ-তিতিক্ষায় পরিপূর্ণ তপঃপূত জীবনকে যথাযথ ভাবে অনুধাবন না করলে সঙ্ঘকেও সঠিক ভাবে বোঝা সম্ভব নয় বলে মনে করা হয়। সেজন্য শ্রীগুরুজী সম্পর্কে দুর্বুদ্ধিজীবীরা দীর্ঘদিন ধরে সীমাহীন অপপ্রচার চালিয়ে গিয়েছে।

বর্তমান প্রবন্ধটি দুর্বুদ্ধিজীবীদের নিন্দার উদ্দেশ্যে রচিত নয়। কিন্তু এই গৌরচন্দ্রিকা বর্তমান প্রবন্ধের জন্য বিশেষ প্রয়োজনীয়। কারণ, এই নির্লজ্জ মিথ্যাপ্রচারের কারণে বাঙ্গালী মানসে শ্রীগুরুজী সম্পর্কে নানা ধরণের বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। বাঙ্গালী মানসে এমন একটি ধারণা তৈরি করা হয়েছে যাতে মনে হয় সঙ্ঘ, সঙ্ঘের নেতৃত্ব এবং সর্বোপরি শ্রীগুরুজী প্রবল বাঙ্গালীবিরোধী। সঙ্ঘ বা শ্রীগুরুজী বাঙ্গালীদের কখনওই কোন গুরুত্ব দেননি। এই বিভ্রান্তির নিরসনই এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য।

কাশী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার সময়ে মাধব সদাশিব গলওয়ালকর নিজ জ্ঞান, চরিত্র ও ছাত্রবাৎসল্যের কারণে ছাত্রদের মধ্যে গুরুজী নামে পরিচিত হন। সঙ্ঘের স্বয়ংসেবক এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শ্রী ভাইয়াজী দাণী-র বিশেষ প্রয়াসে শ্রীগুরুজী সঙ্ঘের সঙ্গে যুক্ত হন। তাঁর জ্ঞান, চরিত্র, কর্মকুশলতা ও সাংগঠনিক দক্ষতার কারণে সঙ্ঘের প্রতিষ্ঠাতা ডাক্তারজী নিজের অবর্তমানে শ্রীগুরুজীর উপরেই সঙ্ঘের দায়িত্ব অর্পণ করেন।

কিন্তু, ডাক্তারজীর অবর্তমানে সরসঙ্ঘচালক রূপে দায়িত্ব নেওয়ার আগে শ্রীগুরুজী ১৯৩৫ সালে ওকালতি পরীক্ষায় পাশ করেন। ইতিমধ্যে শ্রীরামকৃষ্ণের শিষ্য তথা রামকৃষ্ণ মিশনের তৎকালীন অধ্যক্ষ শ্রীমৎ স্বামী অখণ্ডানন্দজী মুম্বাই যাওয়ার পথে নাগপুরের ধন্তোলি স্থিত রামকৃষ্ণ আশ্রমে এসে উপস্থিত হন। সেই সময়ে স্বামী অখণ্ডানন্দজীর দর্শন লাভে শ্রীগুরুজীর সুপ্ত আধ্যাত্মিক পিপাসা সহসা জেগে ওঠে। স্বামী অখণ্ডানন্দজীর নিকট দীক্ষা লাভের বাসনা জাগে শ্রীগুরুজীর হৃদয়ে।

স্বামী অখণ্ডানন্দ ছিলেন ‘নির্ভীক মহান কর্মযোগী’। শ্রীরামকৃষ্ণের মহামন্ত্র ‘শিবজ্ঞানে জীবসেবা’-র আদর্শকে সর্বপ্রথম কার্যে পরিণত করেন স্বামী অখণ্ডানন্দ তাঁর সারগাছির সেবাশ্রমে। নাগপুর রামকৃষ্ণ আশ্রমের অধ্যক্ষ স্বামী ভাস্করেশ্বরানন্দজীর অনুমতি নিয়ে স্বামী অমূর্তানন্দজী কর্তৃক প্রদত্ত পরিচয়পত্র নিয়ে শ্রীগুরুজী ১৯৩৬ সালে এসে উপস্থিত হন সারগাছি। সেখানে খুব শীঘ্রই তিনি স্বামী অখণ্ডানন্দজীর সেবকের মর্যাদা লাভ করেন। শ্রীরামকৃষ্ণের স্নেহধন্য এবং নিয়মনিষ্ঠার পরাকাষ্ঠা স্বামী অখণ্ডানন্দজী হাত ধরে শ্রীগুরুজীকে আধ্যাত্মিকতার মার্গে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। ১৯৩৭ খ্রীষ্টাব্দের মকর সংক্রান্তির পুণ্য লগ্নে শ্রীগুরুজীকে মন্ত্রদীক্ষা দেন স্বামী অখণ্ডানন্দ।

 শ্রীগুরুজীর দীর্ঘকেশ এবং শ্মশ্রুশোভিত যে রূপ আমরা দেখে থাকি তার পিছনে স্বামী অখণ্ডানন্দজীর বিশেষ নির্দেশ বর্তমান। সারগাছিতে সেবক শ্রীগুরুজীকে স্বামী অখণ্ডানন্দজী নির্দেশ নিয়েছিলেন যাতে শ্রীগুরুজী কখনও চুল ও দাড়ি না কাটেন। আজীবন নিজের গুরুর এই নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন শ্রীগুরুজী।

শ্রীরামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দের সঙ্গে শ্রীগুরুজীর সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর। স্বামী অখণ্ডানন্দজীর মন্ত্রশিষ্য শ্রীগুরুজী স্বামী বিবেকানন্দের স্বপ্নকে সাকার করার জন্য আজীবন প্রচেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন। স্বদেশমন্ত্রে স্বামীজী স্পষ্ট ভাষায় বলেছিলেন, “ব্রাহ্মণ ভারতবাসী, চণ্ডাল ভারতবাসী আমার ভাই…”। স্বামীজী সমগ্র হিন্দু সমাজের মধ্যে সমস্ত বৈমনস্য মুছে দিয়ে সমাজে একাত্মতার ভাবনা জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করেছিলেন। শ্রীগুরুজী উড়ুপিতে আয়োজিত মহাসম্মেলনে হিন্দু সমাজের প্রমুখ সন্তগণের মাধ্যমে ঘোষণা করিয়েছিলেন– হিন্দবঃ সোদরাঃ সর্বে, ন হিন্দুঃ পতিতো ভবেৎ। হিন্দু সমাজের মার্গদর্শনকারী পূজ্য সন্তবর্গের মাধ্যমে এই ঘোষণা হিন্দু সমাজের একাত্মতার প্রতিষ্ঠায় এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।

স্বামী বিবেকানন্দ শিলা স্মারক প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও শ্রীগুরুজীর বিশিষ্ট অবদান রয়েছে। ১৯৬৩ সালে স্বামী বিবেকানন্দ শিলা স্মারক প্রতিষ্ঠার যোজনা নেওয়ার পরে সংশ্লিষ্ট সমিতি শ্রীগুরুজীর নিকট সাহায্য প্রার্থনা করেন। কারণ, শিলা স্মারক প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে প্রমুখ বাধা রূপে উপস্থিত হয়েছিল চার্চের নেতৃত্বাধীন স্থানীয় মতান্তরিত খ্রীষ্টানবর্গ এবং কেন্দ্রীয় সংস্কৃতি দফতরের মন্ত্রী হুমায়ূন কবীর। হুমায়ূন কবীর বসিরহাট লোকসভা ক্ষেত্রের নির্বাচিত সাংসদ। পশ্চিমবঙ্গ থেকে নির্বাচিত জনৈক বাংলাভাষী মন্ত্রী যখন বিবেকানন্দ শিলা স্মারকের প্রবল বিরোধিতা করে চলেছন প্রতিনিয়ত সেই সময়ে শ্রীগুরুজী সঙ্ঘের সরসঙ্ঘচালকের দায়িত্ব সামলানো শ্রী একনাথ রানাডে-কে সঙ্ঘের সমস্ত দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে বিবেকানন্দের কাজে নিয়োগ করেন। এর ফল স্বরূপ, অধ্যাত্ম নির্ভর সেবা সংস্থা বিবেকানন্দ কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠা ঘটল যেটি সম্ভবতঃ স্বামী বিবেকানন্দের নামাঙ্কিত সর্ববৃহৎ সংস্থা।

এর পূর্বেও বাঙ্গালী হিন্দুর রক্ষাকর্তা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় যখন রাষ্ট্রবাদী রাজনৈতিক সংগঠন নির্মাণের উদ্দেশ্য নিয়ে শ্রীগুরুজীর নিকট উপস্থিত হয়েছিলেন তখন শ্রীগুরুজী অনুপম প্রতিভাসম্পন্ন প্রচারক শ্রী দীনদয়াল উপাধ্যায়, নানাজী দেশমুখ প্রভৃতি প্রচারকদের নতুন রাজনীতির দলটিকে প্রতিষ্ঠিত করতে প্রেরণ করেন।

১৯৪৭-এ দেশবিভাজনের পরে এবং ১৯৫০-এ লক্ষ লক্ষ হিন্দু পূর্ব পাকিস্তান (অধুনা বাংলাদেশ) থেকে লক্ষ লক্ষ হিন্দু নিজেদের প্রাণ ও ধর্ম বাঁচানোর জন্য পালিয়ে আসেন। দেশবিভাজনের নেপথ্য সমর্থক এবং হিন্দু গণহত্যায় মুসলিম লীগের সমর্থক কমিউনিস্টরা উদ্বাস্তুদের মধ্যে হিংসাত্মক ও ধ্বংসাত্মক মতাদর্শ প্রচার করে এবং উদ্বাস্তুদের বিভ্রান্ত করে সদ্যস্বাধীন দেশের স্থিতাবস্থাকে নষ্ট করার প্রচুর প্রয়াস করেছে। এই উদ্বাস্তু আন্দোলনকে কমিউনিস্টরা পরবর্তীকালে ক্ষমতায় আসার জন্য ব্যবহার করেছে। অন্যদিকে এই উদ্বাস্তুদের সেবার জন্য শ্রীগুরুজীর মার্গদর্শনে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘বাস্তুহারা সহায়তা সমিতি’। এই সেবা সংস্থা আজও দুঃখী মানুষের সেবায় পূর্ণ নিয়োজিত। এই সংস্থা কোনদিনই কোন ভাবে কোন রাজনৈতিক কার্যকলাপের সঙ্গে যুক্ত নয় এবং সেবার বিনিময়ে কোন রকম রাজনৈতিক ফায়দা নেওয়ার চেষ্টা এই সংস্থা করেনি।

ইতিহাসের বিকৃতি, অর্ধসত্যের বিপুল প্রচার এবং সত্যের অপলাপই বামপন্থী দুর্বুদ্ধিজীবীদের প্রধান ক্রিয়াকৌশল। দেশবিভাজন ও হিন্দু গণহত্যার সক্রিয় সমর্থন, ধ্বংসাত্মক রাজনীতি প্রভৃতির মাধ্যমে বাঙ্গালীর জীবনে গভীর ক্ষত সৃষ্টিকারী বামপন্থীদের কোন প্রায়শ্চিত্তই পর্যাপ্ত নয়। তার পরেও তারা নিজেদের বাঙ্গালী প্রেমিক এবং শ্রীগুরুজীকে বাঙ্গালী বিরোধী বলে অপপ্রচারের অপপ্রয়াস করে গিয়েছে। কিন্তু শ্রীগুরুজীর জীবন পর্যালোচনা করলে বাঙ্গালীর সঙ্গে শ্রীগুরুজীর আত্মিক যোগাযোগের কথা সহজেই বুঝতে পারা যায়। ১৯০৬ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি (পবিত্র বিজয়া একাদশী) শ্রীগুরুজী জন্মগ্রহণ করেন। শ্রীগুরুজীর জন্মদিনের পবিত্র মুহূর্তে সমস্ত বিভ্রান্তি কাটিয়ে শ্রীগুরুজীকে হৃদয়ে স্থান দিতে হবে। তাতেই বাঙ্গালীর মোহমুক্তি এবং পরম কল্যাণ।

লেখক – রাকেশ দাশ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.