ভূদেব মুখোপাধ্যায়ই প্রথম বাঙালি লেখক যার গল্পে, প্রবন্ধে ও আখ্যায়িকায় ভারত-চিন্তার উজ্জ্বল প্রকাশ ঘটেছে।তাঁর “ঐতিহাসিক উপন্যাসে” দুটি কাহিনী -সফল স্বপ্ন ও অঙ্গুরীর বিনিময়।অঙ্গুরীয় বিনিময়ে গল্পরস আছে।শিবাজীর প্রতি আওরঙ্গজেব-দুহিতা রোশিনারার আকর্ষণ এই কাহিনীর প্রধান উপজীব্য।
আওরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে এক অভিযানের সময় শিবাজী কৌশলে রোশিনারাকে বন্দি করে নিজের দুর্গে নিয়ে এলেন।শিবাজীর ঘনিষ্ঠ পরিচয় পেয়ে কিছুদিনের মধ্যেই রোশিনারা তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়লেন।এদিকে শিবাজীর অধীনস্থ এক সেনাপতি রোশিনারাকে ভালবেসেছে।শিবাজী তার অন্যায় ব্যবহারের জন্য তাঁকে সাজা দিলেন।একটু সুস্থ হয়ে সেই সৈনিক গেলেন মোঘল শিবিরে।দুর্গম
পার্বত্য পথ দেখিয়ে সে মোঘল সৈন্য প্রবেশ করালো শিবাজীর দুর্গে।শিবাজী পালিয়ে সেবারের মতো প্রাণরক্ষা করলেন।কিছুদিন পরে নতুন সৈন্য সংগ্রহ করে শিবাজী হারানো দুর্গ পুনরুদ্ধার করলেন।বিশ্বাসঘাতক সেনাপতিকে দেবী ভবানী স্বয়ং স্বপ্নে দর্শন দিয়ে বললেনঃ” রে নরাধম।তুই আমার বরপুত্র শিবাজীর অপকারে প্রবৃত্ত হইয়াছিস,তুই নিজ জন্মভূমির প্রতিও স্নেহবিবর্জিত হইয়া তাহা বিধর্মী শত্রুর হস্তগত করিলি-জানিস না,গর্ভধারিণী মাতা,আর পয়স্বিনী গো এবং সর্বদ্রব্য প্রসবা জন্মভূমি -এই তিনই সমান।যে জন্মভূমির অপকার করিতে পারে,সে গো-বধ এবং মাতৃহত্যাও করিতে পারে।”
ভূদেব সর্বপ্রথম সুস্পষ্টরূপে জন্মভূমিকে মা’র সঙ্গে অভিন্ন করে দেখেছেন।প্রথমে দেশের মাতৃকল্পনা,তারপর ঐক্যবোধ সহজে আসে।শিবাজীর আরাধ্যা দেবী ভবানী ভারতমাতারই একটি রূপ।
ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের রূপক আখ্যায়িকা ” পুষ্পাঞ্জলির” প্রকাশ ১৮৭৬ সালে।এখানেও অখণ্ড ভারতের সংহত রূপ ফুটে উঠেছে।ব্যাসদেব ভারতের মূর্তি দেখে প্রশ্ন করলেন,ইনি কোন দেবী?মার্কণ্ডেয় মুনি এ কথার উত্তর না দিয়ে ব্যাসদেবকে নিয়ে তীর্থে বেরিয়ে পড়লেন।ঘুরে ঘুরে ভারতের উত্তরে, পশ্চিমে ও দক্ষিণের পীঠস্থান দর্শন করে এসে উপস্থিত হলেন কামাখ্যা।মার্কণ্ডেয় মুনি এবার বললেন,”এক্ষণে তোমার ধ্যানপ্রাপ্ত দেবীমূর্তির দর্শনপ্রাপ্ত হইলে।” অর্থাৎ ভারত-ভূমিকে দেবীমূর্তি হিসাবে কল্পনা করা হয়েছে।
পাণিপথের তৃতীয় যুদ্ধে শিবাজীর বংশধর রামচন্দ্র জয়লাভ করলে সমগ্র ভারতেকে এক অখণ্ড সাম্রাজ্যে পরিণত করা সম্ভব ছিল বলে ভূদেব মুখোপাধ্যায় উল্লেখ করেছেন তাঁর “স্বপ্নলব্ধ ভারতবর্ষের ইতিহাস(১৮৯৫)” নামক গ্রন্থে।
ভারতবোধ জাগ্রত করবার সহায়ক বলে ভূদেব মুখোপাধ্যায় হিন্দি প্রচারের সমর্থন করেছেন।তিনি বলেছেন,”…………ভারতবাসীর চলিত ভাষাগুলির মধ্যে হিন্দী-হিন্দুস্থানীই প্রধান এবং মুসলমানদিগের কল্যাণে উহা সমস্ত মহাদেশব্যাপক।অতএব অনুমান করা যাইতে পারে যে,উহাকে অবলম্বন করিয়াই কোন দূরবর্তী ভবিষ্যকালে সমস্ত ভারতবর্ষের ভাষা সম্মিলিত থাকিবে।……..ভারতবর্ষের অধিকাংশ লোকেই হিন্দী ভাষায় কথোপকথন করিতে সমর্থ। অতএব শুদ্ধ ভারতবাসীর বৈঠকে ইংরাজির ব্যবহার না করিয়া হিন্দীতে কথোপকথন করাই ভাল।”
ভূদেব মুখোপাধ্যায় প্রথম দেশের ভৌগোলিক ও জাতিগত সংহতির কথা বলেছিলেন;মাতৃভূমিকে দেবীরূপে এবং মাতৃরূপে তিনি পরিকল্পনা করেছিলেন। “জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী”-এই সংস্কৃত বাণীকে বাংলায় আরও অন্তরঙ্গ করে তোলবার কৃতিত্ব ভূদেব মুখোপাধ্যা’য়ের।
সন্দীপ মুখোপাধ্যায়।
গ্রন্থসূত্র-বঙ্গ প্রসঙ্গ