আনন্দবাজার পত্রিকা বহুকাল পড়িনা। বন্ধুবর চম্পকদ্যুতি মজুমদার দৃষ্টি আকর্ষণ না করলে, সম্ভবত শ্রীমতী সেমন্তী ঘোষের প্রবন্ধটি নজরেই আসত না। সেই প্রসঙ্গেই এই ক্ষুদ্র বক্তব্যটির অবতারণা। সংবাদ মাধ্যম গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ – হ্যাঁ, এমনটাই আমরা সকলে শুনে আসছি। এবারে গণতন্ত্র মানে কীরকম গণতন্ত্র, আজকের দিনে দাঁড়িয়ে সে প্রসঙ্গও উঠবে বটে। আট দশকের বেশি সময় ধরে বাংলা সংবাদপত্র জগতে আনন্দবাজার পত্রিকা একটি বহুল পরিচিত নাম। বৈদ্যুতিন মাধ্যমের প্রাসঙ্গিকতা প্রবল হয়ে ওঠায় সংবাদপত্র গোষ্ঠীটি বৈদ্যুতিন মাধ্যমেও পা রেখেছে। একই সঙ্গে একথাও বলা জরুরী – আমাদের দেশে অত্যন্ত সফল ভাবে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রচলিত। সমস্ত বিশ্বের কাছে ভারতের সংসদীয় গণতন্ত্র এক অতি উজ্জ্বল নজির বিশেষ। সুতরাং কোনও ভারতীয় নাগরিক যদি আনন্দবাজার গোষ্ঠীর কাছে গণতন্ত্রের ‘প্রকৃত” চতুর্থ স্তম্ভের ব্যবহার আশা করে, সম্ভবত তা খুব একটা অমূলকও হবে না। যেহেতু আমাদের দেশে সোভিয়েত ইউনিয়ন ধাঁচের ‘গ্ণতন্ত্র’ কায়েম নেই, আমরা অতি অবশ্যই চাইব না – আনন্দবাজার আরও একটি “প্রাভদা” হয়ে উঠুক। অবশ্য উদার অর্থনীতির যুগে ‘ব্যবসাও বড় বালাই” – একথা আমাদের স্মরণে রাখতে হবে।
শ্রীমতী ঘোষের প্রবন্ধটির সূচনা হয়েছে আনন্দবাজার পত্রিকার বাংলা বৈদ্যুতিন মাধ্যম “এবিপি আনন্দ” নামক চ্যানেলে অনুষ্ঠিত একটি টক শোয়ে ভারতীয় জনতা পার্টির প্রাদেশিক সভাপতি শ্রী দিলীপ ঘোষের কয়েকটি মন্তব্যের কঠোর সমালোচনা দিয়ে। গণতান্ত্রিক দেশ আমাদের। এখানে দিলীপ বাবুর যেমন বলবার স্বাধীনতা আছে, তেমনই শ্রীমতী ঘোষেরও সমালোচনা করবার অধিকার আছে বৈকি। কিন্তু একজন সাধারণ দর্শক বা শ্রোতা হিসেবে আমার খুব সাধারণ প্রশ্ন, দিলীপবাবু ভুল কথা কী বলেছেন? ক্ষুদ্র ব্যক্তিগত চিন্তা বলে একজন মানুষ নারীবাদী বা পুরুষবাদী (কথাটা বোধ হয় পিতৃতান্ত্রিক) হওয়ার অনেক আগে একজন মানুষ। একজন মানুষ যদি ভারতীয় আইনসভার একজন মাননীয় সদস্যকে প্রশ্ন করবার অধিকার রাখেন – “আপনি কুকথার কোর্স কোথা থেকে করেছেন?” তাহলে সেই মাননীয় সদস্যেরও সম্পূর্ণ অধিকার আছে, নিজের সম্মানকে রক্ষা করে উত্তর দেওয়ার। বিতর্কটি যেহেতু দেখেছি, জানি, মাননীয়া প্রশ্নকর্ত্রী দিলীপবাবুর শাণিত যুক্তিকে এড়াতে না পেরে মন্তব্য করেন –“একজন মহিলার সাথে কীভাবে এইরক কথা বলতে পারেন?’ এবং দিলীপবাবু তৎক্ষণাৎ বলেন –“আপনিই বা একজন পুরুষের সাথে কীভাবে এইরকম কথা বলতে পারেন?” এবং এই বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতেই পরবর্তীতে দিলীপবাবুর ‘ন্যাকামি’ সংক্রান্ত বক্তব্য। হ্যাঁ, ‘ন্যাকামি’ শব্দটি কথ্যভাষায় প্রচলিত। মাননীয়া ঘোষের সুসংস্কৃত কর্ণকুহরে শব্দটি অপাংক্তেয় মনে হতেই পারে। তবে শব্দটি ন্যক্কারজনক – এদাবী করা নিতান্তই একপেশে!
কিন্তু মাননীয়া সেমন্তী ঘোষ নিজের দাবীকে প্রতিষ্ঠিত করবার বাসনায়, নিজের রাজনৈতিক বক্তব্যের ভিত্তি দৃঢ়মূল করবার বাসনায় তার পরে এগুলি কী লিখলেন? ভারতের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সহ ভারতীয় জনতা পার্টির বহু উচ্চপদাধিকারী মানুষ নির্বাচনী প্রচারের কাজে পশ্চিমবঙ্গে নিয়মিত কর্মরত। তাঁরা দৃঢ়নিশ্চিত, এইবারের নির্বাচনে ‘আসল পরিবর্তন’ হবেই হবে। কিন্তু এই রাজনৈতিক প্রচারের মাশুল হিসেবে পশ্চিমবঙ্গের শাসকদলের উচ্চতম শ্রেণীর কাছে থেকে তাঁরা প্রত্যেকে ‘হোঁদল কুতকুত’, ‘যোগী-ভোগী’, ‘যা তোর বাপ কে ডেকে নিয়ে আয়’, ‘কোমড়ে দড়ি পরাবো’ বা ‘শালা’ জাতীয় অমৃত ভাষণ সদাসর্বদা শুনছেন। ভারতের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বা মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে ‘তুই-তোকারি’ তো নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। মাননীয়া ঘোষ, খেয়াল করবেন, ভারতীয় জনতা পার্টির নেতৃত্ব সেখানে শুধুই ‘দিদি’ বলে সম্বোধন করছেন। প্রধানমন্ত্রী তো এও বলেছেন – পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর লাথিও তিনি মাথা পেতে নেবেন, শুধু পশ্চিমবঙ্গের মানুষের কপালে তিনি লাথি মারতে দেবেন না। এই কথাগুলি আপনার কর্ণগোচর হয়নি মাননীয়া ঘোষ। শুধু প্রধানমন্ত্রীর ‘দিদি’ সম্বোধনটিতে আপনার ‘নির্লজ্জ টিজিং’ বলে মনে হয়েছে! আশ্চর্য লাগে বৈকি!
মাননীয়া সেমন্তী ঘোষ, বলতে বাধ্য হচ্ছি – আপনাদের মতো তথাকথিত বুদ্ধিজীবিদের জন্যই পশ্চিমবঙ্গের প্রকৃত বুদ্ধিমত্তার এইরক্ম শোচনীয় হাল। আপনি যেভাবে প্রবন্ধটিতে ব্যাখা করছেন, লড়াইটা সেরকম শাড়ি ভার্সাস পাঞ্জাবীর নয়। লড়াইটা বস্তুতপক্ষে হওয়া উচিৎ ছিল কুশাসন বনাম সুশাসনের। যদি তা না হত, তাহলে আপনি পার্ক স্ট্রীটের ভদ্রমহিলাটির কথা উল্লেখ করতেন। কামদুনির কিশোরীটির কথা আপনার প্রবন্ধে উঠে আসত। মাননীয়া ঘোষ, রাজনীতির অভিসন্ধির আড়ালে নারীবাদী পরে হবেন। আগে বিবেককে জাগিয়ে মানুষ হোন। এটকুই অনুরোধ।
কৌশিক কিশোর