#ছোট্ট_একটা_দেশলাই_বাক্সের_গল্প


#চতুর্থ_ভাগ


ভারতে  একটা সময় সুইডেনের এক প্রতিষ্ঠান উইমকো অম্বরনাথ , বেরিলি, ধুপগুড়ি এবং দক্ষিনেশ্বরে কারখানা খোলে। উইমকোর বহুবিধ ম্যাচবক্সগুলোর মধ্যে গুরু নানকের ছবি শোভিত হলো অন্যতম দুষ্প্রাপ্য। 

পি আই নাদার নামে ব্যক্তি কলকাতার পূর্ণচন্দ্র রায়ের নিকট দেশলাই তৈরির খুঁটিনাটি শিখে দক্ষিণ ভারতে কারখানা স্থাপন করে । পরবর্তী কালে দক্ষিণভারতে কারখানা স্থাপন করে। পরবর্তীকালে দক্ষিণ ভারতের বেশির ভাগ দেশলাই কারখানাই এই নাদারদেরই তিনটি গোষ্ঠীর মালিকানা ভুক্ত হয়। সেই ট্র্যাডিশন আজও চলেছে। 


পূর্বেই বলেছি যে ভারত তথা কলকাতায় দেশলাই তৈরির প্রায় পাঁচ দশক পূর্ব থেকেই বিদেশ থেকে দেশলাই আমদানি হতো। প্রথম প্রথম সরাসরি ইংল্যান্ড, জাপান , সুইডেন ইত্যাদির বিদেশী কোম্পানি ভারতে দেশলাই বিক্রি শুরু করে। পরে ভারত তথা কলকাতার কিছু কোম্পানি বিভিন্ন দেশ থেকে দেশলাই বাক্স বানিয়ে ভারতের বাজারে ছাড়ে। ঐসময়ের দেবী কালীর ছবি নিয়ে দেশলাই বাক্সের কথা আমি বিস্তর উল্লেখ করেছি। আরো কিছু করছি।

তার আগে দেশলাইএর গুনমানের কথা বলি …..
বাক্সের রূপের চটক ভুলে যেত অনেকেই। কিন্তু এই দেশলাইকাঠি গুলো হত খুবই নিম্নমানের পাহাড়ি গাছের কাঠ দিয়ে তৈরি। খুব তাড়াতাড়ি জ্বলে যেতো। ফুলকি ঝরে “ফুকো” করে দিত জামা কাপড়। রান্নাঘরে গোপনে আঙুলের ডগায় ছ্যাঁকা দিয়ে দিত। বাক্সগুলো ও তৈরি হত একরকম পাতলা অথচ মজবুত শস্তার চ্যালাকাঠ দিয়ে, আমসত্ত্ব বা চামড়ার মতো যার লেয়ার ছাড়ানো যেত। অল্প বৃষ্টিতে পকেট ভিজলেই সে বাক্স আর তার ভেতরের দেশলাইএর বারোটা বাজত।


শিপ” দেশলাই নিয়ে আসে উইমকো। জাতীয় ব্র‍্যান্ড হবার খিদে ছিল ওদের। ছিল কার্ডবোর্ডের হাল্কা বাক্স, সস্তা অথচ ছিমছাম, কেমিক্যাল দেওয়া বলে অল্প জলের ছিটেতেও সে বাক্স ন্যাতাতো না। ছিল মডার্ণ স্টাইলে বিদেশী ধাঁচে আঁকা লোগো। ছিল সাদাকালো সরকারি টিভির চ্যানেলে প্রাইমটাইমে বেশ পেশাদারি সুন্দরী বিজ্ঞাপন , সুরেলা গান সহ:

” না কণা না ঝরে, জ্বলে অনেকক্ষণ ধরে”
 শিপ দেশলাই এর ওই বিজ্ঞাপন স্পট কিন্তু উৎকর্ষতায় সমকালীন অন্য যেকোনো জাতীয় ব্র‍্যান্ড এর বিজ্ঞাপনের পাশে রাখার মতো ছিল। 


এর সাথে ছিল ওদের আরো বড় ডিলাক্স সাইজের কাঠি ওয়ালা “হোমলাইটস”, ওটা প্রিমিয়াম ব্র‍্যান্ডিং, এবং অবশ্যই তার জন্য আলাদা বিজ্ঞাপনও ছিল। তাতে দেখাতো কিভাবে একটা কাঠি দিয়েই পুজোর ঘরে অনেকগুলো ধূপবাতি জ্বালানো যায়। কিন্তু ওদের আসল হাতিয়ার ছিল শিপ। শিপ এর দাম রেখেছিল এমনভাবে যাতে কারো পকেটে আগুন ধরাবে না, কিন্তু লাভের গুড়ের স্বাদ বাজার দখল করার সাথে সাথে মিষ্টতর হতে থাকবে।


যা হোক, তো যেসব ম্যাচ বক্স বিদেশী বা দেশী কোম্পানির মাধ্যেমে ভারতে আসত সেগুলিতে দেবী কালিকা বা মহাদেব ছাড়াও দেশীয় নানা বিষয় ছাপ ও ছবি থাকত। যেমন – মা দুর্গা, দুর্গাপূজা , পৌরাণিক ধর্ম মূলক বিষয় – জন্মাষ্টমী, শকুন্তলাকে দুর্বাষা মুনির অভিশাপ, বিশ্বামিত্র মেনকা, দেশীয় পশু পাখি, কলকাতার গুরুত্বপূর্ণ দ্রষ্টব্য, বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব ইত্যাদি। 


উক্ত বহু ছবি এঁকেছেন সেসব দেশের শিল্পীরা তা অঙ্কন শৈলী দেখলেই স্পষ্ট বোঝা যায়। বেশিরভাগ পৌরাণিক লেবেলই বিখ্যাত ভারতীয় শিল্পীদের ছবি আঁকা। কোনো কোনো ছবি বিদেশী শিল্পীরা গুলিয়ে ফেলার ফলে ভুল ক্যাপশন সহ বাজারে চলে আসে। যেমন – অনুনয়নরত পুররুবা এবং অন্তর্ধান রত উর্বশীর রাজা রবি বর্মাকৃত অনন্য চিত্রটি ম্যাচবক্সের উপর  বেরিয়েছিল শকুন্তলা নামে। সেইটি ছিল অস্ট্রিয়ার এক কোম্পানি। বাক্সের উপর নাম লেখা ছিল সোল ইম্পটর এ.এম. এসসাভয় ক্যালকাটা। 

পশু পাখির মধ্যে বাঘ, সিংহ, ঘোড়া, ময়ূর এবং হাঁস থাকলেও কোনো অজানা কারণে , বিশেষ করে কলকাতায় তৈরি বা আমদানিকৃত দেশলাই বাক্সের উপর হরিণের ছবি থাকত। বহুল এবং নানা ভাবে  হরিণের উপস্থিতি লক্ষ্যনীয় বিষয় ছিল। পূর্বেই বলেছি হরিণের সঙ্গে গান্ধীজীর ছবি থাকতো এরকম অনেক দেশলাই বাক্স পাওয়া গিয়েছে এছাড়াও হরিণ ও বল, ম্যাপ হরিণ  , সাপ ও হরিণ ইত্যাদি দেখতে পাওয়া যেত ।  আর দেখা যেত তারা হলো রেডিও ,বালা,  চাঁদ, তারা,  বন্দুক ইত্যাদি।  উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে – বক্স পাল এন্ড কোম্পানির – ম্যাপ হরিণ, চৌধরী ব্রাদার্স – টু ডিয়ার্স ( ঠিকানা –  ২ পর্তুগিজ চার্চ স্ট্রীট) , ঘোষ ফ্যাক্টরি – বল হরিণ, যমুনা ম্যাচ ফ্যাক্টরি – ডিয়ার ব্র্যান্ড  ইত্যাদি। এছাড়াও ছিল ডোমেস্টিক ম্যাচ ইন্ডাস্ট্রির – হর্স ব্র্যান্ড , এস কে ঢ্যাং – জেব্রা ব্র্যান্ড , বি বি দাস – টাইগার । 
১৯৩৫ সালে ইংল্যান্ডের রাজার পঞ্চম জর্জের রাজত্বকালের রজত জয়ন্তী উপলক্ষে ভারতের কিছু দর্শনীয় বা দ্রষ্টব্য স্থানকে উল্লেখ করে সাতটি ডাক টিকিট বেরয় ।

এসবের মধ্যে দুটি কলকাতার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল এবং পরেশ নাথের জৈন মন্দির। কলকাতার বেশ কিছু দেশলাই প্রস্তুতকারক ডাকটিকিটের হুবহু অনুকরণ করে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল ও পরেশনাথ জৈন মন্দিরের দেশলাই বানালেন। না হুবহু বলাটা একটু ভুল হল । মন্দিরের লেবেলে রাজার জায়গায় দেখা গেল রাণী ভিক্টোরিয়াকে।আসলে দেশলাই লেবেলের জগৎটা হল খেয়াল খুশির । নির্মাতা তাদের পছন্দ রুচি ও ঝোঁক অনুযাই লেবেলের নকশা বানাতেন এবং সেই সময় সেই সমস্ত কিছুতে যে যুক্তি-বুদ্ধি ঐতিহাসিক সত্যতা থাকত তানয়। উদাহরন স্বরূপ বলা যায় – মোহনলাল রামচন্দ্র ম্যাচ ফ্যাক্টরি কলকাতা – ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল , হায়দারি ম্যাচ কোম্পানি – কলকাতা জৈন মন্দির , অল ইন্ডিয়া অর্ডার সাপ্লাই কোং – ট্রামগাড়ি।


মধ্য ভারতের এক কোম্পানি ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল এর অনুকরণে যে ম্যাচ বানালে তাতে রাজা র জায়গায় বসিয়ে দিয়েছিলেন  আরাধ্য শিবাজী মহারাজ কে।


ক্রমশঃ
©দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ কলকাতা ও বাংলার দেশলাই : গোপাল বিশ্বাস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.