সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে প্রমাণ হলো বেআইনি দখলদারিত্ব অধিকারে পর্যবসিত হয় না

গত ৯ নভেম্বর, ২০১৯, রাম জন্মভূমি বাবরি মসজিদ বিতর্কিত মামলার ঐতিহাসিক রায় ঘোষণা, যে রায়ের দিকে আপামর ভারতবাসীই নয়, তাকিয়ে ছিল সমস্ত বিশ্ব। শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে, সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈয়ের নেতৃত্বে বিচারপতি এস. আব্দুল নাজির-সহ ৫ সদস্যের প্রবীণ বিচারপতি সমন্বিত সাংবিধানিক বেঞ্চ সর্বসম্মত রায় ঘোষণা করেন। রায় পড়েন মহামান্য প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ। রায়টি এক নজরে নিম্নরূপ :
(১) ২.৭৭ একর বিতর্কিত জমি পাবে ‘রামলালা বিরাজমান।
(২) ৩ মাসের মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকার একটি ট্রাস্ট গঠন করবে এবং বোর্ড অব ট্রাস্টিজ মন্দির নির্মাণ করবে।
(৩) বাবরি মসজিদের বাইরের এবং ভিতরের জমি পাবে ট্রাস্ট।
(৪) ১৯৯৩ সালে অধিকৃত ৬৭ একর জমি কেন্দ্র চাইলে ট্রাস্টের হাতে দিতে পারে।
(৫) ভালো জায়গায় অযোধ্যা শহরে ৫ একর জমি দিতে হবে মসজিদের জন্য।
(৬) বাবরি মসজিদের ভিতরের জমি যে সবসময় মুসলমানদের দখলে ছিল, তার প্রমাণ নেই।
(৭) মন্দিরের বাইরের চত্বর পুরোপুরি হিন্দুদের দখলে ছিল, তার প্রমাণ আছে।
(৮) সেবায়ত হিসাবে নির্মোহী আখড়ার দাবি খারিজ।
(৯) রামলালা আইনসিদ্ধ ব্যক্তি- রাম জন্মভূমি নয়।
(১০) মসজিদের নীচে পুরাতত্ত্ববিদদের পাওয়া কাঠামো ইসলামি স্থাপত্যের নয়।
(১১) ইলাহাবাদ হাইকোর্টের রায় বিতর্কিত মসজিদের জমি ৩ ভাগ করা আইনসম্মত ছিল না।
রায়ের প্রেক্ষিত বিশ্লেষণে মুখবন্ধেই সর্বোচ্চ আদালতের প্রধান বিচারপতি বলেছেন—এই মামলাকে জমি বিবাদ হিসাবে গণ্য করা হয়েছে। আদালত বিশ্বাস বা আস্থার ভিত্তিতে জমির মালিকানা স্থির করে না। আদালতের অভিমত ১৯৪৯ সালের ২২ ডিসেম্বর মসজিদের অভ্যন্তরে রামলালার মূর্তি স্থাপন এবং ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর মসজিদ ভাঙা বে-আইনি কাজ ছিল। প্রসঙ্গত, ১৫২৬ সালে দিল্লিতে ক্ষমতা দখলের ২ বছরের মধ্যেই বাবরের বিশ্বস্ত সেনাপতি ১৫২৮ খ্রিস্টাব্দে অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ তৈরি করে। মসজিদটি যে খালি জমিতে তৈরি হয়নি এবং এলাহাবাদ হাইকোর্টে মামলা চলাকালীন পুরাতত্ত্ব বিভাগের পেশকৃত রিপোর্টেমসজিদের নীচে যে স্থাপত্যের নিদর্শন মিলেছে তা ইসলামিক ঐতিহ্যের বা ধারার নয়, তাও সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছে। বরং মসজিদের তলা থেকে যে সমস্ত ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায়, তা হিন্দু স্থাপত্যের নিদর্শন বহন করে। মামলায় অংশগ্রহণকারী ৪টি পক্ষের মধ্যে সুন্নি ওয়াকফ বোর্ডকে বিকল্প জমিতে মসজিদ তৈরির জন্য ৫ একর জমি দেবে সরকার, নির্মোহী আখড়ার সেবায়ত হিসাবে জমির দাবি খারিজ, তৃতীয় পক্ষ গোপাল সিংহ বিশারদের পূজা করার দাবি আদালতের রায় স্বীকৃতি পেল, যদিও তিনি ১৯৮৬ সালে লোকাত্ত রিত হন। আর রামলালা বিরাজমানের দাবিকে সিলমোহর দিয়ে বিতর্কিত ২.৭৭ একর জমির অধিকার তাদের হাতে ন্যস্ত হয়েছে। রামমন্দির-বাবরি মসজিদ বিতর্কের সূত্র অনুসন্ধানে মধ্যযুগীয় ভারতবর্ষে উপর্যুপরি মুসলমান আগ্রাসনে হত্যা, ধর্ষণ, মন্দির ধ্বংস এবং অপবিত্রকরণের মতো ঘটনাগুলি আবার সামনে আসে। এবং বিবিধ ঘটনার অভিঘাত রামমন্দির-বাবরি মসজিদ বিবাদ। ১৫২৬ সালে দিল্লি জয়ের পরে বাবরের সেনারা দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে রাজ্য বিস্তারে—‘ধর্মের নামে রাজ্য বিস্তার। একটি পরিসংখ্যান থেকে জানা যায় ২০১৮ সালে অযোধ্যা শহরে মুসলমান জনসংখ্যা ৩৪৬১ জন। ১৫২৮ সালে মসজিদ নির্মাণের কালে ওই জনসংখ্যা ক’জন ছিলেন যে মির বাকি অযোধ্যায় একটি বিশাল মসজিদ তৈরি করল? হিন্দুধর্মের বিশ্বাসের প্রাণকেন্দ্র অযোধ্যায় মসজিদ নির্মাণের প্রেরণা কী শুধু কয়েকজন মুসলমান ধর্মালম্বীদের নমাজ পাঠ, না হিন্দুদের বিশ্বাসের মূলে কুঠারাঘাত ? ভারতবর্ষে ইসলামের বিজয় কেতন যখন পত পত করে উড়ছে–বিদেশি আক্রমণকারী সে মামলুক, খিলজি, তুঘলক, সৈয়দ, ললাদি, সুলতান বা মোগল যে বংশেরই হোক না কেন, নির্বিচারে ভারতের শিক্ষা, সংস্কৃতির পীঠস্থান, ধর্মীয় স্থানগুলি আক্রমণের নিশানা করে ভারতের ধর্ম এবং সংস্কৃতি উচ্ছেদ করে ইসলামিক তমুদ্দিন এবং সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার নেশায় মেতে ওঠে, সৃষ্টি হয় রামমন্দিরবাবরির মতো বহু বিতর্ক। রাজ্য জয়ের সঙ্গে ধর্মের পতাকা বহনকারী উজবেকিস্তান (সমরকন্দ) থেকে আগত বাবর এবং তার বিশ্বস্ত সেনাপতি কোনো ব্যতিক্রমী চরিত্র নয়। রাহুল সাংকৃত্যায়ন তার ‘ভল্লা থেকে গঙ্গায় উল্লেখ করেছেন, তুর্কি আক্রমণকারীরা তরবারির আঘাতে হিন্দুদের দেব-দেবীর মন্দির, বিগ্রহ চূর্ণ-বিচূর্ণ করে বুঝিয়ে দিয়েছে। তাদের দেবতা মিথ্যা এবং শক্তিহীন, তাদের থেকে তুর্কিরা বেশি শক্তিধর। এমনকী ভাঙাচোরা বিগ্রহগুলিকে পা-রাখার সিঁড়ির কাজে ব্যবহার করে তাদের শক্তির প্রমাণ দিয়েছে। তৈমুরের বংশধর বাবরের (মাতৃ পরিচয়ে চেংগিস খানের বংশীয়) পূর্বপুরুষরা লক্ষ লক্ষ নর হত্যায় দায়ী, তাদের আক্রমণের শিকার হয়েছে কলহলিপ্ত হিন্দু রাজন্যবর্গ।
প্রসঙ্গত, Redsicovery of India বইয়ের লেখক আনসার হোসেন খানের বক্তব্য স্মতব্য, ‘Indian Muslims must remember that their forefathers, or rather their mediavel co-religionist minority rules of India were beastly frightful to the Hindus (with exception of Akbar). No Islam sanctioned their conduct. Temples were indeed demolished/ destroyed and their stones often used to construct mosque on the very site.’ (afte ভারতীয় মুসলমানদের স্মরণ রাখা উচিত যে তাদের পূর্বপুরুষরা এবংস্ব-গোত্রীয়রা হিন্দুদের প্রতি হিংস্র পশুর মতো ব্যবহার করেছে। (একমাত্র আকবর ছাড়া)। যা কখনো ইসলাম। সমর্থন করে না। মন্দির অবশ্যই ধ্বংস করা হয়েছে এবং তার পাথর দিয়ে ওই স্থানেই মসজিদ তৈরি হয়েছে)। হোসেন সাহেব তার বইয়ে মধ্যযুগের বর্বরতা উল্লেখ করলেও, অনুল্লেখিত রয়েছে নিকট অতীতে পাক সেনা দ্বারা নিজের দেশের প্রায় ২৫ লক্ষ হিন্দু নিধন, লক্ষ লক্ষ নারী ধর্ষণ এবং হাজার হাজার মন্দির ধ্বংসের ঘটনা ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে মুক্তি যুদ্ধ চলাকালীন।
১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর উন্মত্ত জনতার রোষে বিতর্কিত বাবরি ধাঁচা ধ্বংসের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই পাক – ভারত উপমহাদেশের কয়েক হাজার মন্দির ওঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ধর্মকেযারা রাজনীতির দাবার খুঁটি হিসাবে ব্যবহার করে ফায়দা তুলছেন তাদেরও খেয়াল রাখতে হবে যাতে ধর্মীয় আবেগ সভ্যতার সীমা লঙ্ঘন না করে। দীর্ঘমেয়াদি সম্প্রীতির আবহাওয়া তৈরি করতে প্রয়োজনে অতীতের ভুলভ্রান্তি গুলিও সংশোধন করতে হবে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ধূমায়িত ক্ষোভ কার্পেট চাপা না দিয়ে সর্বজনগ্রাহ্য দীর্ঘমেয়াদি সমাধান খুঁজে বের করতে হবে– হার/জিতের অঙ্ক না কষে। এ প্রসঙ্গে উত্তরপ্রদেশের শিয়া সেন্ট্রাল ওয়াকফ বোর্ডের সভাপতি ওয়াসিম রিজভির মতামত বিচার্য। তিনি মনে করেন, রামমন্দিরের পরে মথুরা এবং কাশীসহ একাধিক তীর্থস্থান-মন্দির হিন্দুদের হাতে তুলে দেওয়া উচিত। রিজভি সাহেবের বক্তব্যের পিছনে ঐতিহাসিক প্রমাণ থাকলে– সম্প্রীতির স্বার্থে সংশ্লিষ্ট ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলিকে এগিয়ে আসতে হবে সমাধানে।
রামমন্দির -বাবরি মসজিদ বিতর্কে আদালত দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ব্যক্ত করেছে। আদালতের রায় কোনো সম্প্রদায়ের বিশ্বাসের ভিত্তিতে নয়, জমির অধিকারের প্রমাণের ভিত্তিতে। আদালত মসজিদের জন্য জমি বরাদ্দ করেছে সুন্নি ওয়াকফ বোর্ডের কোনো প্রমাণের উপর নয়। যেহেতু কোনো আইনি সংস্থা মুসলমানদের মসজিদ থেকে উচ্ছেদ করেনি, জোর করে তাদের হটিয়ে দেওয়া। হয়েছে এই বিবেচনায়। বরং আদালত সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেছে, বিতর্কিত জমিতে অধিকার প্রতিষ্ঠায় মুসলমানদের তুলনায়। হিন্দুদের পেশ করা প্রমাণ জোরালো। বাবরি ধাঁচার বাইরের জমি যে হিন্দুদের দখলে ছিল তার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে, কিন্তু ভিতরের চত্বর যে শুধু মুসলমানদের দখলে ছিল তার প্রমাণ দিতে ব্যর্থ হয়েছে সুন্নি ওয়াকফ বোর্ড। তাই তাদের দাবি খারিজ হয়েছে দীর্ঘদিন নমাজ পড়ায় তাদের আইনি অধিকার জন্মায় না। একইভাবে, দীর্ঘদিন সেবাইত হিসাবে কাজ করলেও নির্মোহী আখড়ার দাবিকেও নস্যাৎ করেছে সুপ্রিম কোর্ট। এমনকী ১৯৯২ সালে ক্ষিপ্ত হিন্দু জনতার দ্বারা বাবরি ধ্বংস বেআইনি ছিল রায়ে উল্লেখ করে বাবরি ধ্বংসের সঙ্গে জড়িতদের বিচারের মুখোমুখি এনে দিলেন, যদিও আলাদাভাবে ওই মামলা চলছে। আদালতের এই রায়ে কয়েক শতাব্দী পুরাতন একটি বিবাদের মিমাংসা হলো। অথচ ভারতের মুক্ত গণতন্ত্রের সুযোগ নিয়ে এক শ্রেণীর সংবাদমাধ্যম এবং তথাকথিত মেকি ধর্মনিরপেক্ষতার কারবারিরা সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের খুঁত বের করে আদালতের সমাধান ভণ্ডুল করার প্রচেষ্টায় রত। শুনা যাচেছ মুসলমান পার্সনাল ল’ বোর্ড পুনর্বিচারের রাস্তা খুঁজছে, অযোধ্যা শহরে ভালো জায়গায় ৫ একর জমি বরাদ্দের পরেও। রায়ের পুনর্বিবেচনা চাওয়া গণতান্ত্রিক অধিকারের আওতায় পড়ে। তবে দেখতে হবে। বাড়াবাড়িতে যাতে পুনরায় সংঘর্ষের পরিস্থিতি তৈরি না হয়। সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে আর একবার প্রমাণ হলো বেআইনি দখলদারিত্ব আইনি অধিকারে পর্যবসিত হয় না। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বা প্রার্থনার স্থল তা মন্দির-মসজিদ যাই হোক না কেন—তার সঙ্গে বিরাট সংখ্যক মানুষের ভাবাবেগ জড়িত। আর এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের উপর আঘাত অতীতেও জাতিদাঙ্গার কারণ হয়েছে। ভারতবর্ষ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হলেও, ধর্মই ভারতীয় সমাজের ভিত্তি এবং প্রেরণার উৎস। এই ভাবাবেগ বিপথে চালিত হলে জাতি সমন্বিত না হয়ে বিভাজিত হয়, পাকিস্তানের জন্মই তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। সুতরাং অতীতের সংঘাত এবং ইতিহাসকে ভবিষ্যতের কলহের হাতিয়ার না করে, অতীতের ভুলগুলি শুধরে নিয়ে সকলে মিলে শক্তিশালী ভারত গঠনে ব্রতী হলে সমৃদ্ধ হবে জাতীয় সংহতি। আর এই দৃষ্টিকোণ থেকে সর্বোচ্চ আদালতের রায়কে দেখতে হবে। মনে রাখতে হবে, অযোধ্যা রাম জন্মভূমি— বাবরি মসজিদ বিতর্কিত মামলাটি অত্যন্ত জটিল এবং স্পর্শকাতর, এর রায় দানের বিষয়টি বিচারকদের কাছে জটিলতার সমস্যা ছিল। তা সত্ত্বেও বিচারকদের সর্বসম্মত রায় একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। বিচারকেরা ধৈর্য ধরে মামলাটির নানা দিক— অভিমুখ বিচার-বিশ্লেষণ করে সমগ্র জাতির কাছে একটি গ্রহণযোগ্য সমাধান দিয়েছেন— আসুন, আমরা এই সমাধানকে স্বাগত জানাই।
কে. এন. মণ্ডল
(লেখক ভারতীয় স্টেট ব্যাঙ্কের অবসরপ্রাপ্ত মুখ্য প্রবন্ধক)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.