এ যেন একটা ঐতিহাসিক দিন। যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে একটা বিশেষ সময়কালের অমলিন ঐতিহ্য। ১২০ বছর আগে এখানেই মেয়েদের স্কুল খুলেছিলেন আইরিশ বংশোদ্ভুত এক যুবতী। বৈভব ছেড়ে সারা জীবনের মত যিনি নিজের সঙ্গে জড়িয়ে নিয়েছিলেন বঙ্গসংস্কৃতি আর হিন্দু সনাতন জীবনধারা। অনেক ঘটনার মধ্যে দিয়ে সংস্কারের শেষ হয়েছে প্রায় আড়াই বছর আগেই। এবারলশ শেষ হল ঐতিহাসিক সেই সংগ্রহশালার কাজ। যেখানে ছোট ইটের গাঁথনির ঠাকুর দালানে আজও জেগে ১৮৯৮-র ১৩ নভেম্বররবিবারের এই সকালে বাড়ির সদরে বসেছে মঙ্গলঘট। 

বাগবাজারে ১৬ নম্বর বোসপাড়া লেনের (At Bugabazar No. 16 at Bospara Lane) কিছু প্রাককথনের প্রয়োজন আছে। ১৮৯৫ সালের নভেম্বর মাস। শীতের এক অপরাহ্ণে লন্ডনে এক পারিবারিক আসরে স্বামী বিবেকানন্দ (Swami Vivekananda) গিয়েছিলেন। সেখানে তাঁর বেদান্ত দর্শনের ব্যাখ্যা শুনে প্রীত হলেন সকলেই। কিন্তু ২৮ বছরের এক শিক্ষিকার জীবনবোধ যেন এক লহমায় বদলে গেল। 

স্বামীজীর ধর্মব্যাখ্যা ও ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ এবং অভিভূত ওই যুবতী এর পর স্বামীজীর প্রতিটি বক্তৃতা ও প্রশ্নোত্তরের ক্লাসে উপস্থিত থাকেন। তারপর বিবেকানন্দকেই (Vivekananda) নিজের গুরু বলে বরণ করে নেন। তৈরি হল একটা ইতিহাস। লেখা হয়ে গেল মার্গারেট এলিজাবেথ নোবেলের জীবনের চিত্রনাট্য। 

এলিজাবেথের জন্ম ১৮৬৭ সালের ২৮ অক্টোবর উত্তর আয়ারল্যান্ডের ডানগ্যানন শহরে। তাঁর বাবা স্যামুয়েল রিচমন্ড নোবেল ছিলেন ধর্মযাজক। মা মেরি ইসাবেলা। মার্গারেটের যখন মাত্র দশ বছর বাবা মারা যান। তার পর দাদামশাই তথা আয়ারল্যান্ডের বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামী হ্যামিলটন তাঁকে লালনপালন করেন। মার্গারেট লন্ডনের চার্চ বোর্ডিং স্কুলে পড়াশুনা করেছিলেন। এরপর হ্যালিফ্যাক্স কলেজে তিনি এবং তাঁর বোন মেরি পড়াশুনা করেছিলেন। ১৮৮৪ সালে, সতেরো বছর বয়সে শিক্ষাজীবন শেষ করে মার্গারেট শিক্ষিকার পেশা গ্রহণ করেন। দুবছরের জন্য কেসউইকের একটি প্রাইভেট স্কুলে পড়ান। এরপরে একে একে রেক্সহ্যামে (১৮৮৬), চেস্টারে (১৮৮৯) এবং লন্ডনের উইম্বলডনে (১৮৯০) তিনি শিক্ষকতা করেন। কিছুদিন পরে ১৮৯৫ সালে উইম্বলডনে নিজে ‘রাস্কিন স্কুল‘ (Ruskin School) উদ্বোধন করেন। 

১৮৯৮ সালের ২৮ জানুয়ারি স্বদেশ ও পরিবার-পরিজন ছেড়ে মার্গারেট চলে আসেন ভারতে। এই সময় বিবেকানন্দের কাছে ভারতের ইতিহাস, দর্শন, সাহিত্য, জনজীবন, সমাজতত্ত্ব, প্রাচীন ও আধুনিক মহাপুরুষদের জীবনকথা শুনে মার্গারেট ভারতকে চিনে নেন। কয়েক দিন পর রামকৃষ্ণ পরমহংসের স্ত্রী সারদা দেবীর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। এরপর ২৫ মার্চ স্বামী বিবেকানন্দ (Swami Vivekananda) তাঁকে ব্রহ্মচর্য ব্রতে দীক্ষা দেন। তিনিই মার্গারেটের নতুন নাম রাখেন ‘নিবেদিতা’।

মেয়েদের লেখাপড়া শেখানোর জন্য নিবেদিতা (Nivedita) উত্তর কলকাতায় এখানে, মানে বোসপাড়া লেনে একটি মেয়েদের স্কুল খোলেন। সব কিছুর তদারকিতে ছিলেন ভগিনী নিবেদিতা। কালীপুজোর তিথিতে সেই ঠাকুর দালানে স্বামী বিবেকানন্দ, স্বামী ব্রহ্মানন্দ ও স্বামী সারদানন্দের উপস্থিতিতে নিবেদিতা বালিকা বিদ্যালয়ের উদ্বোধন করেছিলেন মা সারদা। 

পরে সেটির নাম হয় রামকৃষ্ণ সারদা মিশন (Ramakrishna Sarada Mission) ভগিনী নিবেদিতা (Sister Nivedita) বালিকা বিদ্যালয়। ১৮৯৯ সালে কলকাতায় মহামারী দেখা দিলে তিনি স্থানীয় যুবকদের সহায়তায় রোগীদের সেবাশুশ্রুষা ও পল্লী-পরিষ্কারের কাজ করেন।  

মিস জোসেফিন ম্যাকলাউডকে (Miss Josephine Mcleod) লেখা এক চিঠিতে ১৬ নম্বর বোসপাড়া লেনের বাড়ির কথা নিবেদিতা জানিয়েছিলেন।  নিবেদিতার আহ্বানে বাড়ির উঠোনের চা-চক্রে গান গেয়েছিলেন যুবক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সামনে তখন মন্ত্রমুগ্ধ স্বামী বিবেকানন্দ, মহেন্দ্রলাল সরকার, মোহিনীমোহন চট্টোপাধ্যায়-সহ আরও কয়েক জন।

১৮৯৮-র নভেম্বরে নিবেদিতা বাড়িটি ভাড়া নেওয়ার পরে তাঁর ডাকে একাধিক বার সেখানে এসেছিলেন মা সারদা (Mother sarda)। ১৮৯৯-র জুনে স্কুলের জন্য অর্থ সংগ্রহের উদ্দেশে স্বামী বিবেকানন্দের সঙ্গে নিবেদিতা বিদেশে যান। ১৯০০-র নভেম্বর থেকে প্রায় এক বছর এক মাস ওই বাড়িতে ভাড়া ছিলেন মা সারদা। আড়াই বছর পরে শহরে এসে পাশের ১৭ নম্বর বাড়ি ভাড়া নিলেও নিজের কর্মকাণ্ডের প্রসার ঘটাতে ১৯০৪-এ ফের ১৬ নম্বর বোসপাড়া লেনের বাড়িটি ভাড়া নেন নিবেদিতা। 

বাগবাজারের ১৬ নম্বর বাড়িকে ঘিরে মার্গারেট এলিজাবেথ নোবেলের সব স্মৃতিই আজও জাগিয়ে রাখতে চায় রামকৃষ্ণ সারদা মিশন।  নিবেদিতাও তাঁর লেখায় বাড়িটিকে হিন্দু স্থাপত্যকলার অনন্য নিদর্শন বলেই উল্লেখ করেছেন।

বর্মা-সেগুন কাঠের সদর দরজা পেরিয়ে ভিতরে ঢুকেই ডান হাতে নিবেদিতার পড়ার ঘর। তার পরেই ঠাকুর দালানের সামনে ছোট্ট উঠোন। যেখানে গান গেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সামনে আরও দু’টি ঘর পেরিয়ে অন্দরমহলে ঢোকার আগেই ফের ছোট্ট উঠোন ও ঘর। সেখান দিয়েই উঠেছে দোতলায় ওঠার অপরিসর সিঁড়ি। সংগ্রশালায় আসা দর্শকদের জন্য অবশ্য নতুন সিঁড়ি বানানো হয়েছে। দোতলা থেকে একতলা সর্বত্রই থাকছে নিবেদিতার জীবন ও সমাজসংস্কারের বিভিন্ন দিক এবং স্মৃতির নিদর্শন। রয়েছে সারদা মঠ তৈরির ইতিহাসও। সংগ্রহশালায় ঢোকার মুখেই টিকিটের পাশাপাশি দর্শনার্থীদের হাতে দেওয়া হবে একটি ‘অডিও গাইড’ যন্ত্র। হেডফোন কানে লাগিয়ে সেই যন্ত্রের বাংলা ও ইংরাজি ধারাভাষ্য মেনেই নিবেদিতার পড়ার ঘর, বারান্দা, ঠাকুর দালান, অন্দরমহল-সহ বিভিন্ন ঘর অর্থাৎ গ্যালারিতে পর্যায়ক্রমে পৌঁছতে পারবেন দর্শকেরা। প্রতিটি গ্যালারিতে ঢোকার মুখেই দেওয়ালে লাগানো কিউআর-কোডটি হাতে থাকা যন্ত্র দিয়ে স্ক্যান করলেই শোনা যাবে সেই ঘরের বৈশিষ্ট্য। আবার বেশ কয়েকটি গ্যালারিতেই ঢুকে ডিজিটাল স্ক্রিনে আঙুল ছোঁয়ালেই ফুটে উঠবে নিবেদিতার জীবন, কর্মকাণ্ডের বিবরণ-সহ স্কুল তৈরির ইতিহাস।

ইতিহাসকে জীবন্ত করে তুলতে প্রযুক্তিকেও কাজে লাগানো হয়েছে এই হেরিটেজ সংগ্রহশালায়। যেমন ঠাকুরদালানের দু’দিকের মুরালের সামনে থাকা ‘ট্যাব’-এ চোখ রাখলেই জীবন্ত হয়ে উঠবে গঙ্গাপথে গিয়ে নৌকা থেকে নিবেদিতাকে (Nivedita) মহিলাদের নিজস্ব মঠ তৈরির জন্য স্বামী বিবেকানন্দের (Swami Vivekananda) জায়গা দেখানোর ঘটনার মতো অন্য বিষয়ও। দোতলায় নিবেদিতার শোওয়ার ঘরটি অবশ্য রাখা হয়েছে ধ্যানের জন্য। 

১৫ মার্চ ওই সংগ্রহশালা উদ্বোধন করা হল। ২০ মার্চ প্রথম সংগ্রশালায় ঢুকতে পারবেন দর্শনার্থীরা। সপ্তাহের প্রতি শুক্র, শনি ও রবিবার খোলা থাকবে সংগ্রহশালাটি। প্রথম কয়েক মাস এমন চলার পরে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। ওই দিনগুলিতে সকাল ১১টা থেকে বিকেল ৪টে পর্যন্ত খোলা থাকবে সংগ্রহশালাটি। নিবেদিতা সংগ্রহশালা সূত্রের খবর, সাধারণের জন্য ৫০ টাকা ও স্কুল-কলেজের পড়ুয়াদের জন্য ২০ টাকার টিকিট করা হচ্ছে। একসঙ্গে কুড়ি জন ঢুকতে পারবেন সংগ্রহশালায়। 

শহরের বুকে নিবেদিতার স্মৃতি জাগিয়ে রাখতে প্রস্তুত ১৬ নম্বর, বোসপাড়া লেন। ১২০ বছরের পুরনো স্মৃতি বয়ে চলেছে বোসপাড়া লেনের এই বাড়িতে। 

অশোক সেনগুপ্ত (Ashok Sengupta)।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.