গোধন সংরক্ষণ ও গোহত্যা নিষিদ্ধকরণের প্রয়োজনীয়তা

​’গোধন সংরক্ষণ ও গোহত্যা নিষিদ্ধকরণ’ বিষয়টি নিয়ে কিছু বলতে গেলেই কিছু অপগন্ড মানুষ রে রে করে আসবেন নিশ্চিত, আমায় গোরুর বাচ্চা-টাচ্চা ইত্যাদি বলে আক্রমণ করতেও পারেন। ধর্মীয় ভাবাবেগে বাঁশ দেওয়া হচ্ছে বলেই তাদের অনুমান। ভাল কাজের জন্য বাঁশ দেওয়া নেওয়া প্রয়োজন। কিছু মানুষ তো ‘গোহত্যা’র সমর্থন প্রসঙ্গে বেদ, গীতা, পুরাণ, কোরান, রামায়ণ, মহাভারত, ইলিয়াড-ওডিসি, জেন্দাবেস্তা, বাইবেল, ত্রিপিটক, দ্বাদশাঙ্গ ইত্যাদি সবকিছু থেকে নানাবিধ তথ্য গুলিয়ে সর্বধর্মসমন্বয়ের শরবত খাইয়ে দেবেই। এপ্রসঙ্গে বলে রাখা ভাল, গোহত্যার সমর্থন সম্পর্কিত বিভিন্ন লেখায় বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ থেকে কায়দা করে যে সকল উদ্ধৃতি বা তথ্য কোট করা হয়, সেগুলোর সত্যতা সম্পর্কে ক’জনই বা যাচাই করেন জানি না। পৃথিবীর কোন ধর্মগ্রন্থেই ‘গোমাংস ভক্ষণ’ বাধ্যতামূলক লেখা নেই। ধর্মগ্রন্থগুলো গুলে খেলেও এমন তথ্য পাওয়া যাবে না।ব্যাতিক্রম – ঋকবেদ।

ঋকবেদই একমাত্র ধর্মগ্রন্থ যেখানে গোমাংস ভক্ষণ নিয়ে একাধিক নিয়মের কথা বলা আছে, যাগযজ্ঞে এবং অতিথিসেবায় গোমাংস বাধ্যতামূলক এমন নির্দেশও আছে, গোমাংস খাওয়া ও না খাওয়ার সঙ্গে পাপপুণ্যের বিধানও রয়েছে, সেইসঙ্গে গোধন সংরক্ষণের নির্দেশও কঠোরভাবে দেওয়া আছে। একটু তলিয়ে ভাবলে বোঝা যায়, সেসময়ে গোধনের প্রাচুর্য ছিল, তুলনায় ভক্ষণকারীর সংখ্যা ছিল কম। পরবর্তীকালে গোধনের প্রাচুর্য কমতে থাকে। তাছাড়া মুরগী বা ছাগলের মত গোচাষও সম্ভব ছিলনা যেহেতু গরুর বংশবিস্তারের গতি অতি ধীর (একটি গোরু কুড়ি পঁচিশ বছরের জীবনকালে তিন থেকে চারটির বেশী শাবক প্রসব করতে পারে না)… কৃষিকাজ থেকে ডেয়ারী শিল্প প্রতিটি ক্ষেত্রে গোধনের অপরিসীম গুরুত্ব অনুধাবন করেই ব্রাহ্মণ্যধর্মের হর্তাকর্তারা গোহত্যা ধর্মীয়ভাবে নিষিদ্ধ করেছিলেন।

ঋকবৈদিক পরবর্তী প্রতিটি হিন্দুধর্মগ্রন্থে গোহত্যা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা আছে। সামবেদ, যজুর্বেদ, অথর্ববেদ, অধিকাংশ পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারত প্রত্যেক গ্রন্থে গোহত্যা নিষিদ্ধ করা আছে। যজুর্বেদের একটি অধ্যায়ই রয়েছে যেখানে ঋকবৈদিক কিছু নিয়মের উপর যুক্তিসহ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা আছে যার মধ্যে গোহত্যার বিধান অন্যতম। তৎকালীন বৈদিক আইনসমুহে গোহত্যা করলে কঠোর শাস্তির বিধান ছিল। আমি এই সকল ধর্মগ্রন্থের বিভিন্ন উদ্ধৃতি কোট করে উদাহরণ দিতে পারি। কিন্তু তাতে আমার লেখা অনাবশ্যক বড় ও নীরস হবে। পাঠকরা ধৈর্য হারাবেন। কোনো কোনো যুক্তিবাদী সেয়ানা গোসংরক্ষণকে একটি হাস্যকর বিষয় প্রমাণ করার জন্য স্বামী বিবেকানন্দের একটি জনপ্রিয় হিউমরাস উক্তি (“………. নইলে কে আর এইসব কৃতী সন্তান প্রসব করবেন”) কোট করেন – ভাবখানা এমন যেন স্বামীজীর পাশে দাঁড়িয়ে তিনি শুনেছিলেন। উক্তিটির সত্যাসত্য নিয়ে কাটাছেঁড়া করার কোন অভিপ্রায় নেই, কিন্তু স্বামীজীর সেই উক্তিটি হয়ত নির্দিষ্ট কোনও ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ছিল তা বলাই বাহুল্য, তাঁর কোন রচনাতেই গোহত্যার কোনরকম সমর্থন ছিলনা। এছাড়া পৃথিবীর কোন ধর্মের ধর্মগ্রন্থেই গোমাংস ভক্ষণ নিয়ে নিষেধাজ্ঞা নেই ঠিকই, কিন্তু বাধ্যতামূলকও লেখা নেই। কেউ যদি সুনিশ্চিত প্রমাণ দেখাতে পারেন কোনো ধর্মে গোমাংস ভক্ষণ যে কোন ভাষায় ‘বাধ্যতামূলক/must’ বলা আছে, তাহলে ঠিকভুলের বিতর্কে নামতে প্রস্তুত আছি।

বর্তমান যুগের নিরিখে তো কোনও দৃষ্টিকোণ থেকেই গোহত্যা সমর্থনযোগ্য নয়। যুগের প্রয়োজনে মানুষের খাদ্যাভাস পরিবর্তন প্রয়োজন। পরিবেশ ও মানুষের স্বার্থে নিজেদের বদলাতে হবেই হবে।  আরবের অসভ্য যাযাবররা তো একসময় কাচা মাংস আগুনে ঝলসে খেত। এখনো তো খেতে পারে সেই ঐতিহ্যবাহী আধসেদ্ধ, লবনহীন মাংস, তাহলে খায়না কেন?

গরুর মত মারাত্মক অর্থকরী গুরুত্বসম্পন্ন প্রাণী হত্যা করার কোনো যৌক্তিকতা বা প্রয়োজনীয়তা থাকতে পারেনা।

সারা বিশ্বজুড়ে ডেয়ারি শিল্পকে আরও উন্নত করার প্রচেষ্টা চলছে। ভারতবর্ষে ডেয়ারি শিল্প ধুঁকছে। ডেয়ারী প্রোডাক্টের আকাশছোঁয়া দাম যা গরীব তো দূরের কথা,  মধ্যবিত্তদেরও নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। নকল ডেয়ারী প্রোডাক্টে ছেয়ে যাচ্ছে বাজার। মিষ্টান্ন স্বাদও হারাচ্ছে, দামেও বাড়ছে।

যে দেশে ২৭% শিশুরা অপুষ্টিতে ভোগে সেদেশে ডেয়ারিজাত বেবিফুডের আগুনছোঁয়া দাম। এখনো নির্দিষ্ট বয়সের পর (মাতৃদুগ্ধপান করার বয়স পেরিয়ে যাওয়ার পর) শিশুদের সুষম পুষ্টিকর খাবার হিসাবে গোদুগ্ধের কোনও বিকল্প নেই। এছাড়াও কৃষিকাজে গোধনের গুরুত্ব অপরিসীম। দু’বেলা পেট পুরে ভাত না পাওয়া মানুষগুলোকে একবাটি মাংসের লোভ না দেখিয়ে একগ্লাস দুধও খাওয়ানো যায়। গরুর দুধের পুষ্টিমুল্য এবং খাদ্য হিসাবে গ্রহণযোগ্যতা গোমাংস অপেক্ষা অনেক অনেকগুণ বেশী। গোমুত্রের ঔষধ হিসাবে যথেষ্ট ব্যাবহার আছে। যদিও গোমুত্রের ব্যাপারটা নিয়ে বিজ্ঞানসম্মত চুলকানির দোহাই দেওয়া থাকলেও গোবরের উপযোগিতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোন জায়গাই নেই।

সার আর জ্বালানী শিল্পের অন্যতম কাঁচামাল হল গোবর। গোবর গ্যাস জ্বালানি হিসাবে ব্যাবহার করলে জ্বালানির খরচ কমে, অপর্যাপ্ততার কোন প্রশ্নই আসেনা। আমাদের রামকৃষ্ণ মিশনে গোবর গ্লাসের জ্বালানিতে রান্না হতে দেখেছি, সেখানে গোবর গ্যাসের প্লান্ট ছিল। গোবর গ্যাসের ব্যাবহারে অন্যান্য জ্বালানি সাশ্রয় হয়। কম খরচে এমন বিকল্প জ্বালানি খুব কমই আছে, দূষণের মাত্রাও কম। অথচ এই বিষয়টি নিয়ে কারুরই তেমন হেলদোল নেই। আর অনুল্লিখিত বাকী প্রয়োজন অর্থাৎ গরুর চামড়া বা হাড় – সেগুলি সময়মাফিক মৃত গোধন থেকে যেটুকু মেলে সেটাই যথেষ্ট। চর্মশিল্পে গরুর চামড়ার থেকেও বেশী ব্যবহৃত হয় খাসির চামড়া, কাজেই চর্মের জন্য আলাদা করে গো-নিধনের কোনও প্রয়োজনীয়তা নেই।

অতএব কোনো দিক থেকেই গোহত্যা কোনভাবে সমর্থনযোগ্য নয়। 

বেদে কি ছিল বা কোরানে কি ছিল সেটা বড় কথা নয়, এখন যেটা প্রয়োজন সেটাকে মেনে চলতেই হবে। গোহত্যা আইনত দণ্ডনীয়, অতএব দণ্ডনীয়। আইন আবেগ নিয়ে চলেনা, যুক্তিতে চলে। হাঁস, মুরগী, শুয়োর, ছাগলের সাথে গরুকে একশ্রেনীতে যারা ফেলেন, তারা এই পাঁচটি পশুরও অধম। আর ভারতবর্ষে গোহত্যাটা লোকদেখানো ধর্মীয় উন্মাদনা এবং কারুর কারুর ক্ষেত্রে উদ্ভট সিকিউলারিজম প্রদর্শন ছাড়া কিছুই নয়। বলুন তো, গোমাংস নিয়ে এত ধেই ধেই নাচের কি প্রয়োজন? কিসের এত সিকিউলারিক আদিখ্যেতা? জানি, ঋকবেদে গোমাংস ভক্ষণের নির্দেশ ছিল। ঋকবৈদিক যুগে আশা করা যায় মানুষের চেয়ে গরুর সংখ্যাটাও অন্তত চারগুণ বেশী ছিল। 

তাছাড়া গোমাংস এমন কিছু পুষ্টিকর খাবারও নয় যে খেতেই হবে। গোমাংসের তুলনায় অনেক খাবারই উপকারী, সহজলভ্য, সুপাচ্য ও সুস্বাদু। গোদুগ্ধ তো লক্ষগুণে উপকারি বলাই বাহুল্য। যেদেশে মানুষের পেটে ভাত জোটেনা, শিশুদের দুধ জোটেনা, সেদেশে গোমাংস নিয়ে আদিখ্যেতাটা বর্বরতার নামান্তর। ভাত, ডাল, সব্জী আর শিশুর খাদ্য গোদুগ্ধে টান পড়লেই গরীবের খাদ্যে টান পড়ে। গোমাংসে টান পড়লে কোনওভাবেই খাদ্যে টান পড়েনা, জোর করে টান পড়ালে তো কিছু করার নেই। ক্রান্তীয় অঞ্চলে গোমাংস মানে সাক্ষাৎ বিষ। গোরুর মাংসে লং ফাইবার থাকে যা মারাত্মক ক্ষতিকারক। গোমাংসে টিনিয়া স্যাজিনাটা নামক ফিতাকৃমি থাকে যা মানবদেহে ভয়ানক ক্ষতিকারক প্রভাব বিস্তার করে। 

তাছাড়া ভারতে গোবধের প্রচলনটা অকারণে একটা ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত করার জন্যই হয়েছিল, এটা তো ঐতিহাসিক সত্য। সর্বোপরি একটা ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক দেশে আশি শতাংশ মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়ে কিভাবে একটা কাস্টম্ চলতে পারে জানিনা। আমার ধারণা ভারতবর্ষের দারিদ্রসীমার নীচে বসবাসকারী মানুষরা কোনো মাংসই খেয়ে দেখেনি, বলির মাংসও না, কুরবানীর মাংসও না।

সায়ন্তন মিত্র  
নিউ ব্যারাকপুর প্রশিক্ষক আধিঃ, পু.প্র.বি., কলিঃ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.