রেলব্রিজ দিয়ে ঘড়ঘড় শব্দে এগিয়ে চলেছে ট্রেন। নির্ভেজাল শৈশবকে উপভোগ করতে করতে রেলযাত্রীদের উদ্দেশ্যে যেন হাত নাড়ছে আজকের ‘অপু-দুর্গা’রা। সত্যিই এযেন বর্তমান সময়ের ‘অপু-দুর্গা’। ‘পথের পাঁচালী’র সঙ্গে এই অপু-দুর্গাদের পার্থক্য বলতে, সেখানে তাদের প্রথম ট্রেন দেখা,এক্ষেত্রে এরা রোজই ট্রেন দেখতে অভ্যস্ত।আর সেদিনের শরতের কাশবনের পরিবর্তে এখানে শীতের বর্ণময় ফুলবন। গন্তব্য ফুলের স্বর্গরাজ্য পূর্ব মেদিনীপুরের ‘ক্ষীরাই’।

ট্রেন ধরে ক্ষীরাই স্টেশন,তারপর ৩ নং প্ল্যাটফর্ম থেকে পাঁশকুড়া স্টেশন অভিমুখী কাঁকড়পূর্ণ লাল মাটির রাস্তা ধরে তিন বন্ধু গল্প করতে করতে হাঁটতে শুরু করা।অবশ্য,স্টেশনে নেমেই ছোট্ট একটা গুমটি থেকে বিস্কুট,চিঁড়েভাজার প্যাকেট আর জল সংগ্রহ করে নিয়েই হাঁটা শুরু করেছিলাম।

রেলট্র‍্যাকের পাশ দিয়ে সরু লালমাটির রাস্তা হঠাৎই মনে করিয়ে দিচ্ছিল বাঁকুড়া কিমবা পুরুলিয়ার প্রান্তিক গ্রামগুলোর কথা।সামনেই একটা মৃদু বাঁক।তারপরই হঠাৎই চোখে পড়ল লাল,নীল,সাদা,হলুদ রঙের চাদর।হ্যাঁ,চাদর,তবে তা প্রাকৃতিক।এক একটা বর্ণময় ফুলের বাগান।শীতের রোদ গায়ে মেখে রেললাইনের দু’পাশে এরকমই দৃষ্টিনন্দন দৃশ্য উপভোগ করতে করতে কখন যে এক কিলোমিটার পথ হেঁটে ফেলবেন বুঝতে পারবেন না।

সামনেই কাঁসাই ব্রিজ।তারপাশ দিয়ে নেমে গিয়েছে সরু রাস্তা।আর,তারপর দিগন্তবিস্তৃত রঙবেরঙের ফুলের সেই অসীম সম্ভার, ‘ক্ষীরাই’। এ যেন একটুকরো ফুলের স্বর্গরাজ্য।যেদিকে তাকাবেন সেদিকেই বর্ণময় পুষ্পসম্ভার।রামধনুর বৈচিত্র্যময় রঙের মতো বিভিন্ন বর্ণের অনিন্দ্যসুন্দর শোভায় সুশোভিত বিঘার পর বিঘা জমি।কোথাও চাষ হচ্ছে বিভিন্ন বর্ণের এষ্টার,কোথাও হলুদ গাঁদা-কমলা গাঁদা আবার কোথাও বা চেরি,সরিষা,মোরগঝুঁটির মতো শীতকালীন বিভিন্ন ফুল।পাশ দিয়েই আপন বেগে বয়ে চলেছে ‘ক্ষীরাই’ নদী।

ক্ষীরাই নদীর নামানুসারেই পাঁশকুড়া ব্লকের অধীনস্থ এই জনপদের নামকরণ।বর্ষার জলে পুষ্ট ক্ষীরাইয়ে শীতে হাঁটুজল থাকলেও বর্ষায় রুদ্রমূর্তি ধারণ করে ফুলচাষিদের মাথাব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।মাঠের মাঝে একপায়ে দাঁড়িয়ে তালগাছ।আর ফুলের ক্ষেতের ধারে চাষিরা শখ করে ফলিয়েছেন বাঁধাকপি।

ফুলবাগানে ভিড় জমিয়েছে মধুকরের দল।মৌমাছির গুঞ্জনে,প্রজাপতির অরূপ শোভায় প্রাঞ্জল রূপ ধারণ করেছে বর্ণময় ফুলের ক্ষেতগুলো।গাঁদার সৌরভে পুলকিত হয়ে উঠছে মন।এমনই সব নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে আল বরাবর এগিয়ে চলা। সঙ্গে একের পর এক দৃশ্যকে লেন্সবন্দী করা।চাষিভায়েরা ফুল গাছের পরিচর্যায় ব্যস্ত।কেউ ফুল তুলছেন,কেউবা পাতা ছাঁটছেন।তাঁদের কাজে হাত মিলিয়েছেন পরিবারের অন্যান্য সদস্য-সদস্যারাও।তাঁদের সাথে কথা বলে জানা গেল মূলত এই জমিতে শীতকালে ফুলচাষ হয়।দুর্গাপুজোর কিছুটা আগে থেকে বীজ ছড়ানো হয়।

ডিসেম্বরের শেষ থেকে জানুয়ারীর শেষ সপ্তাহ পর্যন্তই মূলত ফুলের এই অপরূপ সৌন্দর্য চাক্ষুষ করা যেতে পারে।বছরের অন্যান্য সময় এই জমিতে সেভাবে ফুলচাষ হয়না।তার পরিবর্তে বাদামের চাষ হয়।ভিতরের জমিতে ফুলচাষ হলেও তা সংখ্যায় অনেক কম।কোলকাতা সহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ক্ষীরাইয়ের ফুল পৌঁছে যায় বলে জানা গেল।এই নান্দনিক দৃশ্যকে চাক্ষুষ করতে ভিড় জমিয়েছেন শহরের বেশ কিছু উৎসুক মানুষ।অনেকেই চাষিভাইদের থেকে অতি স্বল্প মূল্যের বিনিময়ে ফুল কিনছেন।যাইহোক,চোখের সামনে রঙের মেলা,আর কাঁসাই ব্রিজ দিয়ে অনবরত ট্রেনগাড়ির এগিয়ে চলা এসব দেখতে দেখতেই কেটে যাবে দিন।

ক্ষীরাইকে বিদায় জানিয়ে চলে আসুন বরফের দেশে। শুধু হিমাঙ্কের নীচে নেই এখানকার পারদ। কাঁসাই ব্রিজ ধরে পশ্চিম কোল্লা গ্রামের দিকে গেলে লালমাটির পথ। পথ ধরে একটু এগোলেই চোখে পড়বে শ্বেতশুভ্র তুষার আচ্ছাদিত বিঘার পর বিঘা জমি। এ তুষার সে তুষার নয়,এ তুষার কল্পনার তুলিতে অঙ্কিত তুষার।কাছে গিয়ে দেখা মিলবে সাদা চন্দ্রমল্লিকার।দিগন্ত বিস্তৃত।অভূতপূর্ব সৌন্দর্যের সমাহার।ক্ষেতজুড়ে বৈদ্যুতিক ল্যাম্পের ব্যবস্থা রয়েছে।কৃত্রিমভাবে দ্রুত ফুল বাড়াতেই ব্যবস্থা।ক্ষেত ধরে এগিয়ে চলতে গিয়ে এবার দেখা মিলল লাল,হলুদ বর্ণের চন্দ্রমল্লিকার।দেখা মিলবে গোলাপেরও।

জীবন গতিময়। তাই ফিরতেই হবে আপন দেশে। ফেরার পথে মন বলে উঠতে পারে, ‘হয় নাই চক্ষু মেলিয়া, ঘর হতে দুই পা ফেলিয়া একটি ধানের শিষের ওপরে একটি শিশিরবিন্দু।”

★বিশেষ সতর্কীকরণ:-

১)ক্ষীরাইয়ের ফুল বাগান সংলগ্ন সেভাবে কোনো দোকানপাট নেই।তাই আগে থেকে শুকনো খাবার ও জল নিয়ে যেতে হবে।

২)ফুল ছেঁড়া বা ফুলে হাত দেওয়া যাবেনা

৩)প্লাস্টিক,পলিথিন ও থার্মোকল জাতীয় দ্রব্য ক্ষেতে না ফেলে আসাই শ্রেয়।

৪)সকালে গিয়ে বিকেলে ফিরে আসার জন্য ক্ষীরাই আদর্শ স্থান।যদি কেউ রাত্রিযাপন করতে চান তবে সেক্ষেত্রে পাঁশকুড়া/মেচেদায় রাত্রিবাস করতে হবে।

★পথনির্দেশ:-

দক্ষিণ-পূর্ব রেলওয়ের খড়্গপুর/মেদিনীপুরগামী যেকোনো লোকাল ট্রেনে ক্ষীরাই স্টেশন>ক্ষীরাই স্টেশনের ৩ নং প্ল্যাটফর্ম থেকে লালমাটির পথ ধরে কাঁসাই ব্রীজ হাঁটা>ব্রীজের আগে সরু রাস্তা দিয়ে ফুল ক্ষেতে নেমে যাওয়া

অথবা,

পাঁশকুড়া স্টেশন থেকে টোটো রিজার্ভ করে সরাসরি পশ্চিম কোল্লা>ক্ষীরাই

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.