জঙ্গলমহল হাসছে। এই বাক্যটি মুখস্ত করে ফেলেছেন শাসক দলের নেতা নেত্রীরা। আদৌ কি হাসছে? এই প্রশ্নে যেমন শাসক দলের নেতাদের ‘স্যারিডন’ সেবন করতে হচ্ছে, তেমনই আদিবাসী বিভাজনও শিরঃপীড়ার অন্যতম কারণ। সাঁওতাল ও কুর্মি দুই সম্প্রদায়ের মেরুকরণ এই প্রথমবার ‘ফেস’ করছে জঙ্গলমহল। গত পঞ্চায়েত নির্বাচনেও যা অতটা প্রকট ছিল না। সাঁওতালদের একটা বড় অংশ ভোট ঘাসফুলে যাওয়ার সম্ভবনা। কিন্তু কুর্মিদের ভোট? কুর্মিরা সিংহভাগ ‘অ্যান্টি  তৃণমূল’ হয়ে উঠেছে। এর কি প্রভাব পড়বে? এ কারণেই ষষ্ঠ দফার ভোট গ্রহণে জঙ্গলমহলের প্রতিটি গ্রাম, মহল্লায় ইভিএমের দিকে সজাগ দৃষ্টি থাকছে সবার।

হ্যাঁ, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই, জঙ্গলমহলে এখন রক্তক্ষরণ নেই। মাওবাদীদের দ্বারা খুন, জনসাধারণ কমিটির লাগাতার বনধ, যৌথ বাহিনীর অত্যাচার নেই। জঙ্গলমহলের গরিব পরিবারগুলি পাচ্ছেন ২ টাকা কেজি দরের চাল । কিছু ছেলে-মেয়েকে সিভিক ভলান্টিয়ারের চাকরি দেওয়া হয়েছে। গত সাত বছরে অনেক পাকা সড়ক, পাকা সেতু হয়েছে। এসব কারণে মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সহ তৃণমূলের নেতারা জঙ্গলমহল প্রসঙ্গে একটি বাক্যই আওড়ান সেটা হল, ‘জঙ্গলমহল হাসছে!’ গত সাত বছরে হাসিটা কি ফিকে হয়ে গেছে না? হাসিটা উধাও হওয়ার অনেকগুলি কারণ। এখনও জঙ্গলের পাতা, জঙ্গলের শুকনো কাঠ বিক্রি করে অন্নের সংস্থান হয় অনেক পরিবারের। এখন প্রশ্ন তুলতেই পারেন, ২টাকা কেজি দরের চাল দেওয়া হয়। তাহলে কিসের পেটের টান? স্যার, জঙ্গলমহলের বাসিন্দারা দিনে চারবার ভাত খান। পরিমাণও বেশি। সপ্তাহে মাথাপিছু রেশন দোকান থেকে চাল মেলে ১ কেজি। কিন্তু একজনের সপ্তাহে চাল লাগে পাঁচ কেজি। বাকি ৪ কেজি কোথা থেকে আসবে? আর স্যার, ২ টাকার চালের ভাত আপনি একবারও খেয়েছেন? না, খাননি। এই চাল খাওয়াটাও একটা আর্ট। নেতাদের সেই আর্ট কখনও শিখতে হয়নি, ঈশ্বর সহায় থাকুন যেন কখনও শিখতেও না হয়! আর রেশনে যে চাল দেওয়া হয়, তা বেশির ভাগ সময় থাকে খাবার অযোগ্য। ছাগলকে খেতে দেওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। রেশনের চাল সরবরাহের দায়িত্ব পান আবার কেষ্টদারা!

সাঁওতালি ভাষায় পঠনপাঠন চালু হল কিন্তু কতটা গুরুত্ব পেল? সারা বছর খোঁজ নেন না বাবুরা। আদিবাসী হোস্টেলগুলি সংস্কার হচ্ছে না। জঙ্গলমহলের আদিবাসী হোস্টেলগুলি আজ প্রায় সব বন্ধ। কেন বন্ধ? তার খোঁজ নেয় না মমতময় সরকার। দিদির কাছে খবরও যায় না। কারণ উচ্চবর্ণের ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় উন্নয়ন কমিটির মাথায় থাকতে খবর যাওয়ার কথাও নয়। (এই কাজ আর যাই হোক, এলিটস্য এলিট ঋতুবাবুদের দিয়ে হবে না। কেন্দু পাতার দাম পড়ে গিয়েছে। এ খবর কি রাখেন ঋতব্রত? রাখেন না। আয়াসে অভ্যস্ত বিরাটবপু আর আদরে অভ্যস্ত জিভ নিয়ে আদিবাসী মর্মে প্রবেশের চাবিকাঠি খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়।) অথচ লাগাতার সংখ্যালঘু হোস্টেল তৈরি হয়ে চলেছে। প্রয়োজনে এবং অপ্রয়োজনে। দিদি করেছেন অনেক। হ্যাঁ, আদিবাসীদের জন্যে তিনি করেছেন। কিন্তু দিদি, তাহা হস্তের সীমা এড়াইয়া মরমে গিয়া পশিয়াছে কিনা একটু খোঁজ নেবেন, প্লিজ! আর, দিদি, আদিবাসীরা চিরদিনই আত্মমর্যাদাসম্পন্ন জন্তু। করুণা আর ভিক্ষের ফরমে দেওয়া উপহারের থালা তাঁরা নিয়েছে কিন্তু গ্রহণ করেনি। তাঁদের মর্মের সঙ্গে যোগসূত্র রচিত হয়নি, এটাই বাস্তব।

কেন জনমত পাচ্ছে না শাসকদল? তার প্রধান কারণ, যাঁদের হাতে স্থানীয় উন্নয়নের দায়িত্ব বর্তেছিল তাঁরা নিজেদের উন্নয়নে ব্যস্ত ছিলেন। বাংলা যোজনার ঘর পেতে হলে নেতাকে দিতে হয় কড়কড়ে নোট। ফেলো কড়ি মাখো তেল নীতিতে ‘উন্নয়ন’-এ সামিল নেতারা! মানুষের ছোঁয়া লাগা বাচ্চাকে যেমন হাতি ফেরায় না তেমনি দিকু হয়ে ওঠা আদিবাসীকেও তার সমাজ গ্রহণ করে না। আদিবাসীরা যূথবদ্ধ জীবনে অভ্যস্ত। পৃথিবী যতই গ্লোবাল ভিলেজ হোক, আদিবাসীদের আত্মার রঙ আজও বীরসা ভগবানের সময়েই রয়ে গেছে। এটা ব্যর্থতা নয়, একধরণের পিয়োরিটির অহং।

আদিবাসীদের ভোট ব্যাংক ফিরে পেতে ভারত জাকাত মাঝি পরগণা মহলের নেতা রবীন টুডু স্ত্রী বীরবাহা সরেনকে তৃণমূল ঝাড়গ্রাম লোকসভা কেন্দ্রে প্রার্থী করেছে। কিন্তু আদিবাসী সংগঠনের সকলের সায় ছিল না। সংগঠনের তরফে রবীন টুডুকে বহিষ্কার করা হয়। ভারত জাকাত মাঝি পরগণা মহল বীরবাহাকে সমর্থন করেননি। তবু সাঁওতালদের একটা বড় অংশ ভোট পাওয়ার সম্ভাবনা থাকছে বীরবাহার। কিন্তু ঝাড়গ্রামে সিঁদ কাটবে কুর্মি সম্প্রদায়। প্রায় তিন লক্ষ কুর্মি ভোট কার পালে? ক্যালকুলেটারে অঙ্ক কষছে পদ্ম শিবির।

জঙ্গল তো একদা আদিবাসীদেরই ছিল। জঙ্গলের অধিকার নিয়ে লড়াই আন্দোলন কম হয়নি। এখনও জঙ্গলের অধিকার ফিরে পায়নি আদিবাসীরা। এখনও বন ফরেস্টবাবুদের মৃগয়া। এখন পাতা কুড়োতে গেলে ফরেস্টবাবু বাধা দেন। অথচ কাঠ মাফিয়ারা বনের দামি কাঠ যখন বাইরে পাচার করে দেয় অবলীলায়। রঙিন হয়ে ওঠে কোনও কোনও ফরেস্টবাবুর জীবনযাপন। বাঁকুড়ার রাইপুর, রানিবাঁধ এলাকায় দামি সাদা পাথর মাফিয়াদের হাত ধরে চলে যাচ্ছে আসাম, নেপালে। ওই সাদা পাথর তো আদিবাসীরাই এতদিন রক্ষা করছিল। দামি পাথর পাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালেই মাওবাদী তকমা। আসলে যে কোনও ভাবে আদিবাসীদের জঙ্গলে ঢুকতে বাধা দাও। আদিবাসীদের উচ্ছেদ করে জমি তুলে দাও কর্পোরেট সংস্থার হাতে। পুরুলিয়ায় একের পর এক ছোট ছোট পাহাড় বেসরকারি সংস্থার হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে। পাহাড় কেটে পাথর বেচে মুনাফায় লাল হচ্ছে কর্পোরেট সংস্থা। অযোধ্যা পাহাড়ে টুরগা প্রকল্প গড়ে উঠছে লক্ষ লক্ষ গাছ ধ্বংস করে। তার প্রতিবাদে আন্দোলনে নেমেছেন আদিবাসীরা। ভোটের আগে পাহাড়ের প্রতিটি বাড়ির দেওয়া লেখা, ‘পাহাড়, জঙ্গল ধ্বংস করে টুরগা চাই না।’ কিছু দিন আগে তৃণমূলের মস্তান বাহিনী গিয়ে জোর পূর্বক সেই সব দেওয়াল লিখন মুছে দিয়েছে। এর জবাব দেবে না আদিবাসীরা? জবাব পড়বে অবশ্য‌ই ইভিএমে। আদিবাসীরা পাহাড়কে দেবতা হিসেবে পুজো করেন। চোখের সামনে আদিবাসীরা দেখছেন, তাদের দেবতার বুকে সভ্যযন্ত্রের আঁচড় ক্রমশ প্রকাণ্ড হয়ে খুবলে খুবলে খাচ্ছে। আগামী দিনে পুরুলিয়ার অযোধ্যা সহ সব পাহাড়েই চলে যাবে বেসরকারি সংস্থার হাতে। আদিবাসীদের মারাংবুরু সেঁধিয়ে যাচ্ছে সভ্যদের সভ্যতার বিরাট পেটের লেলিহান গহ্বরে।

জঙ্গলমহলে এখন নতুন চাষের ধুম, পদ্মচাষ। আনকো আলোয় নয়, দিনের আলোয় দেখা যাচ্ছে পদ্মকলি শুধু হাই তুলছে মাত্র নয় খিলখিলিয়ে সংসার করছে। বালবাচ্চা নিয়ে রীতিমতো একান্নবর্তী পরিবারের কর্তার মতো কোঁচাটি সামলে গুছিয়ে বসেছে। পুরুলিয়া জেলার গত পঞ্চায়েত নির্বাচনের ফলাফল দেখলেই তা স্পষ্ট হবে। পুরুলিয়া লোকসভা কেন্দ্রে ৪২ শতাংশ কুর্মি ভোট। এবার কুর্মিরা সিংহভাগ ‘অ্যান্টি তৃণমূল’ হয়ে উঠেছে। কারণ মোটা টাকার বিনিময়ে বহিরাগতদের প্রাথমিক শিক্ষককের চাকরি আর কুর্মি সম্প্রদায়ের আন্দোলনকে বিরোধিতা করায় জঙ্গলমহলে মাশুল গুনতে হচ্ছে শাসক দলকে। ‘উন্নয়ন’ দেখিয়েও পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৃণমূলের আদিবাসী ভোট ব্যাংকে ব্যাপক ধ্বস নেমেছিল। শাসক দলকে সবক শিখিয়ে ‘দ্যাখ কেমন লাগে’ মেজাজে জঙ্গলমহলের বাসিন্দারা। কেউ কেউ একধাপ এগিয়ে বলছেন,‘আগে নগরে পরিবর্তনের সূচনা হত। এখন উল্টোটা। প্রত্যন্ত জঙ্গলমহল থেকে পরিবর্তনের সূচনা। জঙ্গলমহল আগে ভাবে, পরে ভাবে কলকাতা!’ গত চার বছরের বেশি সময় ধরে জঙ্গলমহলে কুর্মি আন্দোলন চলছে। ভাষা, সংস্কৃতি, এসটি তালিকায় পুনরায় অর্ন্তভুক্তির দাবিতে কুর্মিরা পথে নেমেছে। ‘ডহর ছেঁকা’, ‘জিগিড় জিটা গবচন’, ‘রেল ছেঁকা’ একাধিক আন্দোলনে সামিল। এই কুর্মি আন্দোলনকে ভেস্তে দিতে সরাসরি বিরোধিতায় নামে শাসক দল। শ্রীকান্ত মাহাত, চূড়ামণি মাহাত, শান্তিরাম মাহাত, কুর্মি আন্দোলনকে দমাতে সশরীরে পথে নামেন। নিজেদের জাতিস্বত্বার আন্দোলনে কুর্মি সম্প্রদায় জোট বদ্ধ। ফলে শাসক দলের এই নেতারা চক্ষুশূল হয়ে যান। তাছাড়া বলরামপুর থানার সুপুরডি গ্রামে ত্রিলোচন মাহাত ও দুলাল কুমারের মৃত্যু কুর্মিদের সংঘবদ্ধ করেছে। দেওয়াল লিখন এখনও জ্বলজ্বল কবছে, ‘পুঁতেছিলাম ঘাস, হয়ে গেল বাঁশ!’ কুর্মিদের ভোট পেতে সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়, পার্থ চট্টোপাধ্যায়। কিন্তু ‘মনস্থির’ করা ভোটারকে কি সহজে পাল্টানো যায়?

আগামী ২৩ মে হাজারো প্রশ্নের উত্তর মিলবে। জঙ্গলমহল হাসছে? নাকি আদিবাসীরা উত্তর দিতে প্রস্তুত নব প্রজন্মের সিধু কানহু বীরসা ভজহরিদের হাত ধরে?

মারাংবুরু মাহাত

জল জমি জঙ্গল পাহাড় রক্ষায় আদিবাসীদের পক্ষে এই লেখকের কলম গর্জে ওঠে। একাধিক আদিবাসী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন। বন ভূমি পাহাড়ের জন্য তিনি সদা জাগ্রত। জঙ্গলমহলে জন্মে জঙ্গলমহলেই বিচরণ করেন এই লেখক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.