স্বতন্ত্র, সার্বভৌম বাঙালি-হিন্দু সাম্রাজ্যের অধীশ্বর গৌড়াধিপতি শশাঙ্ক ভারতবর্ষের ইতিহাসে এক বিস্মৃতপ্রায় নাম। প্রায় সোওয়া চৌদ্দশো বছর আগে ভারতবর্ষের পূর্বাংশে শুরু হয়েছিল তাঁর বিজয়যাত্রা। তিনি বর্তমান মুর্শিদাবাদের কর্ণসুবর্ণে (বর্তমান বহরমপুরের কাছে রাঙ্গামাটিতে) তাঁর রাজধানী স্থাপন করেছিলেন। কেউ কেউ বলেন, তিনি গুপ্ত বংশীয় এক নরপতি, ‘নরেন্দ্রগুপ্ত’ বা ‘নরেন্দ্রাদিত্য’ তাঁর প্রকৃত নাম। বাণভট্ট রচিত ‘হর্ষচরিত’-এ ‘নরেন্দ্রগুপ্ত’ নামটি পাওয়া যায়। কোনো কোনো ঐতিহাসিক সূত্রে ‘শ্রীনরেন্দ্র বিনত’ — এমন কথা পাওয়া গেছে। হতে পারে তিনি মগধের গুপ্তবংশজাত মহাসেনগুপ্তের পুত্র বা ভ্রাতুষ্পুত্র। কারও মতে এই মহাসেনগুপ্ত ছিলেন দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের কনিষ্ঠপুত্র গোবিন্দগুপ্তের বংশ-শাখা। গুপ্তসম্রাটগণ যেখানে ভাগবত-মতাবলম্বী বৈষ্ণব, শশাঙ্ক ছিলেন শৈবপন্থী সম্রাট। শশাঙ্কের আমলের স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রার একপিঠে রয়েছে নন্দীর পৃষ্ঠে উপবিষ্ট মহাদেবের মূর্তি, অন্য পৃষ্ঠে দেখা যায় কমলাত্মিকা অর্থাৎ পদ্মাসনে সমাসীনা লক্ষ্মীমূর্তি।
শশাঙ্ক বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পুষ্যভূতি বংশের সম্রাট হর্ষবর্ধনের সমসাময়িক ছিলেন। চীনদেশীয় শ্রমণ ও পর্যটক হিউয়েন সাং-এর ‘সি-ইউ-কি’ গ্রন্থে এবং হর্ষবর্ধনের অনুগামী বাণভট্ট রচিত ‘হর্ষচরিত’-এ যে সমস্ত বিবরণ আছে, তা শশাঙ্ক সম্পর্কে সঠিক নাও হতে পারে। বহু ঐতিহাসিক মনে করেন, বৌদ্ধধর্মের সামীপ্যে অবস্থানকারী কোনো ব্যক্তি আপন ধর্মাবলম্বী রাজার শত্রুরাজা সম্পর্কে সুবিচার নাও করতে পারেন। শশাঙ্ক সম্পর্কে প্রচার আছে, তিনি সন্ধির নিমিত্তে আগত নিরস্ত্র রাজা রাজ্যবর্ধন (হর্ষবর্ধনের জ্যেষ্ঠভ্রাতা)-কে হত্যা করেছিলেন এবং রাজ্যবর্ধনের ভগ্নীপতি মৌখরীরাজ গ্রহবর্মাকে হত্যার নিমিত্তে মালবরাজ দেবগুপ্তের সঙ্গে সন্ধিবদ্ধ হন এবং ভগিনী রাজ্যশ্রীকে জঙ্গলে কারারুদ্ধ করার আদেশ দেন। শশাঙ্ক সম্পর্কে এও প্রচলিত আছে, তিনি নাকি বহু বৌদ্ধ মন্দির ধ্বংস করেছিলেন। তবে বহু ঐতিহাসিক মত প্রকাশ করে বলেছেন, শশাঙ্কের রাজধানী কর্ণসুবর্ণের কাছেই বহু বৌদ্ধ মন্দির অক্ষত ছিল, এটা সম্ভব হল কীভাবে? আরও তথ্য এই, তাঁর সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়েও তিনি শিক্ষার প্রসারে রাজ-সহযোগিতা বজায় রেখেছিলেন।
জানা যায়, বৌদ্ধ সম্রাট হর্ষবর্ধনের পূর্বাপর রাজত্বকালে উত্তর ভারতের ব্রাহ্মণেরা অসম্মনিত হলে, সরযূ তীরবর্তী অঞ্চলের গ্রহবিপ্রদের গৌড় অভিমুখী অভিবাসনের ব্যবস্থা করেছিলেন শশাঙ্ক। তিনি সুশাসক ছিলেন এমন পরিচয় পাওয়া যায়। প্রজাবর্গকে জলকষ্ট থেকে রেহাই দিতে মেদিনীপুরের কাছে দাঁতনে দেড়শো একর জমির উপর ‘শরশঙ্ক’ নামক বৃহৎ দিঘী খনন করিয়েছিলেন। তাঁর আমলে গৌড় সাম্রাজ্য কৃষি-শিল্প-বাণিজ্য-শিক্ষাক্ষেত্রে অগ্রগতি লাভ করে।
জানা যায়, রাজা শশাঙ্ক কালগণনার ক্ষেত্রে সূর্য সিদ্ধান্ত পদ্ধতি ‘বঙ্গাব্দ’ চালু করেন। ৫৯২/৫৯৩ খ্রীস্টাব্দে এই সৌরভিত্তিক কালগণনার শুরু। সম্ভবত এই বঙ্গাব্দ চালুর প্রথম বৈশাখের প্রথম দিনে তাঁর রাজ্যাভিষেক। আনুমানিক ৫৯০ থেকে ৬২৫ খ্রীস্টাব্দ ছিল তাঁর শাসনকাল। তাঁর রাজকার্যের প্রচলিত ভাষা ছিল বাংলা এবং রাজধর্ম ছিল হিন্দু। তিনিই প্রথম অপরাজিত এবং বিস্তৃত বঙ্গের একচ্ছত্র শাসক। ছিলেন ধর্মসংরক্ষক এবং পরধর্মসহিষ্ণু। বাঙালি কৃতবিদ্যদের মধ্যে তিনি এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক, কিন্তু কালের গর্ভে তাঁর সমস্ত ইতিহাস হারিয়ে গেছে, যা আছে তাও পক্ষপাতদুষ্ট বলে ঐতিহাসিকদের মতামত।
জয়, মহারাজ শশাঙ্কের জয়।
কল্যাণ চক্রবর্তী।
অপরাজিত বঙ্গাধিপতি
শশাঙ্ক মহারাজ
কানসোনাতে রাজধানী হতে
হর্ষে দিয়েছে বাজ।
মগধ, গৌড়, রাঢ় দেশ গাঁথে
উড়িষ্যা ভুবনেশ্বর
রাজনৈতিক সম্প্রসারে
কেঁপে ওঠে স্থানেশ্বর।
একদিকে তিনি রক্ষা করেন
হিন্দুত্বের ওই মতি
পরমতসহিষ্ণু তবু
মহাবিহারেরও স্থিতি।
জলকষ্টে দীঘির জল
শরশঙ্ক খোঁড়েন
নালন্দাতে বাড়ান হাত
ঐতিহ্যতে মোড়েন।
কৃষি শিল্প জ্ঞানচর্চা
বাণিজ্যে অগ্রগতি
এমন রাজ্য শাসন করেন
গৌড়ের অধিপতি।
বঙ্গাব্দের সূচনা খানা
হয়ে যায় তাঁর হস্তে
পাঁচশত তিরানব্বই সাল
বিয়োগ করার ন্যস্তে।
বাদ দাও যদি অঙ্কটা ওই
দু’হাজার পার একুশ
চৌদ্দোশ আটাশ এলো
এলো বাঙালির হুঁশ।
( ছবি এঁকেছেন শীর্ষ আচার্য )
. কল্যাণ চক্রবর্তী