দাড়িভিটের বলিদান বাঙ্গালির ভাষা আন্দোলনের ক্রমিক প্রবাহ

“মৃত্যু এবং খুনের তফাত নেই তো পরিণামে।
হাওয়ায় বুলেট ঘুরছে আজকে বাংলাভাষার নামে
দাঁড়িয়েছিল কোনখানে ঠিক, ডাইনে নাকি বামে।
পাঁজর ঘেঁষে লাগল বুলেট স্বাধীনতার নামে
দ্রা-ম্! দ্রা-ম্! দ্রা-ম্! এক লহমায় শরীর ছুঁড়ে বেরিয়ে গেল। পুলিশের বুলেট! দাড়িভিট উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে নিজেদের মিষ্টির দোকানের সামনেই দাঁড়িয়েছিলেন তাপস বর্মণ।বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সকাল থেকেই গণ্ডগোল চলছিল। কৌতুহলী নজর রাখছিলেন তাপস। প্রশাসন কী তাহলে ছাত্র-ছাত্রীদের দাবির তোয়াক্কা না করেই জোর করে উর্দু মাধ্যম চালু করবে? মুহূর্তে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল সব কিছু। সহসা মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন তিনি। দেখতে পেলেন অপস্রিয়মান পুলিশের গাড়িটিকে। জানলা দিয়ে তখনও বেরিয়ে আছে ঘাতক হাতটি! ছুটে এলেন মা। হাহাকার করে ডাকতে শুরু করলেন তাপসের বাবাকে, বোন ডলিকে। কিন্তু, ততক্ষণে বীরাত্মা তাপস তাদের ছেড়ে অমরত্বের পথে। তারা এসে পৌঁছনোর আগেই মায়ের বুকে মাথা রেখে, মায়ের আঁচল রুধিরে সিক্ত করে ঝিমিয়ে পড়েন তাপস। বোন ডলি যখন এলেন, তখন রক্ত চুয়ে পড়ছে ডান হাতের কবজিতে বাঁধা রাখির ওপর। ঠিক একমাস আগে রাখি পূর্ণিমার দিনে দাদার হাতে রাখিটি বেঁধে দিয়েছিলেন তিনি। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারেন না কিশোরী ডলি। দাদাকে জড়িয়ে ধরে হাউহাউ করে কাঁদতে থাকেন তিনি।
ওদিকে বিদ্যালয় প্রাঙ্গণের মধ্যেও একই কাণ্ড। আগ্নেয়াস্ত্রের ট্রিগার টেপার শব্দ খান্খা করে দিল চলমান হইচইয়ের উচ্চ কলরব। বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে গণ্ডগোল হচ্ছেসংবাদ পেয়ে তড়িঘড়ি আইটিআই কলেজ থেকে বাড়ি ফেরেন রাজেশ সরকার। ছোট বোন মউ দাড়িভিট উচ্চবিদ্যালয়ের ছাত্রী, পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষার দাবিতে আন্দোলনে শামিল। পুলিশ নাকি সমস্ত বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ ঘিরে ফেলেছে। কিছু হয়নি তো বোনের। ভাত বেড়ে বসেছিলেন মা। বারণ করেছিলেন বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে না যেতে। মউ ঠিক চলে আসবে। মায়ের বারণ না শুনেই, বিদ্যালয়ের উদ্দেশে দৌড় দেন রাজেশ। বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে চেঁচামেচি, হইচই। এরই মধ্যে গুলির আওয়াজ। বোনকে খুঁজতে থাকেন রাজেশ। হঠাৎ গুলির আঘাতে পালটে যায় সব কিছু। বন্ধুর উপরেই লুটিয়ে পড়েন তিনি। মাঠে চাষ করছিলেন বাবা। ছুটে আসেন তিনি। রাজেশ তখন মাটিতে শুয়ে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে সারা শরীর। গলার গামছা দিয়ে ক্ষতস্থান বেঁধে রক্তক্ষরণ বন্ধ করার খানিক চেষ্টা করেন তিনি। কিন্তু তাতে কী আর হয় ? ক্ষত যে গভীর! এদিকে ক্রমশ বুজে আসছে রাজেশের চোখ ! উপস্থিত সকলে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেন তাদের হাসপাতাল নিয়ে। যাওয়ার। গুলিবিদ্ধ রাজেশ ও তাপসকে নিয়ে একদল ছাত্র রওনা হয়। হাসপাতালের দিকে। কিন্তু পথেই তাদের পথ অবরোধ করে একদল দুষ্কৃতী।রাজেশ-তাপসকে যারা হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছিল শুধু তাদেরই নয়, মৃতপ্রায় রাজেশ-তাপসকেও তারা বেধড়ক মারধোর করে। বহু কষ্ট করে স্থানীয় ইসলামপুর হাসপাতালে নিয়ে আসতে আসতে দিন কাবার হয়ে যায়। সেদিনই রাতে হাসপাতালে মৃত্যু হয় রাজেশের, পরদিন ভোরে মৃত্যু হয় তাপসের। এভাবেই মৃত্যুকে জয় করে মৃত্যুঞ্জয়ী হন বীরাত্মা রাজেশ-তাপস। ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হন আরও এক কিশোর— বিপ্লব। ডান হাতে মারাত্মকভাবে সে আঘাতপ্রাপ্ত হয়। চেন্নাইয়ের একটি হাসপাতালে এখনও তার নিয়মিত চিকিৎসা চলছে। বাহুতে গুলির ক্ষতচিহ্ন নিয়ে বিপ্লব আজও শিক্ষায় বাংলাভাষার দাবিতে এক অক্লান্ত সৈনিক।
‘ওঠ বাঙ্গালি, জাগ বাঙ্গালি ভাঙ বাঙ্গলি জিহাদ ঘাঁটি
জয় কালী জয় দুর্গা বলে গায়ে মেখে নে দেশের মাটি।
২০১৮ সালের ২০ সেপ্টেম্বরের এই লজ্জাজনক ঘটনার খবর প্রশাসনের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে শুধুমাত্র সোশ্যাল মিডিয়া নয়, বরং দেশের সবকটি প্রচারমাধ্যমে জায়গা পেয়েছে। কিন্তু পরিস্থিতির উন্নতি হলো কতটুকু?
ফিরে যাই কিছুটা পিছনে। উত্তরদিনাজপুর জেলার দাড়িভিট নামের ছোট্ট এই গ্রামটি বাংলাদেশ সীমান্ত ঘেঁষা। গ্রামের বুক চিরে তিরতির করে বয়ে চলেছে দোলঞ্চা নদী। গ্রামের অধিকাংশ মানুষই পূর্ববঙ্গ থেকে আসা উদ্বাস্তু। এলাকার বাংলাভাষী মানুষদের সঙ্গে একসঙ্গেই বাস করেন স্থানীয় সূয্যপুরি ভাষার মানুষেরা। বাংলার পাশাপাশি স্থানীয় এই লোকভাষা ব্যবহার করেন হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে। ভৌগোলিক দিক থেকে বাংলাদেশের একেবারে গা ঘেঁসে থাকায় বৃহত্তর ইসলামিক স্টেটের ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব থেকে এ এলাকাকে বাদ দেওয়ার কোনো কারণ নেই। এমতবস্থায় দাড়িভিট উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগকে কেন্দ্র করেই ধুন্ধুমার। প্রায় দু’হাজার ছাত্র-ছাত্রীর দাড়িভিট উচ্চ বিদ্যালয়ের স্থায়ী শিক্ষক সংখ্যা মাত্র চোদ্দ, পার্শ্ব শিক্ষক পাঁচজন। শিক্ষক প্রতি ছাত্র-ছাত্রী একশো। শিক্ষার অধিকারে যদিও পরিষ্কার বলা আছে এই অনুপাত হবে ৩০/৪০ ছাত্র পিছু একজন শিক্ষক। বিদ্যালয়ে বাংলা, ইংরেজি, অঙ্ক, বিজ্ঞান, ইতিহাস, ভূগোল সব বিষয়ে শিক্ষকের অভাব। অথচ প্রধান শিক্ষক একজন উর্দু শিক্ষক নিয়োগ করার জন্য ব্যগ্র। টেলিভিশনের ক্যামেরায় পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে ছাত্র-ছাত্রীরা প্রতিবাদ জানিয়ে বলছে যে, তারা উর্দু বিষয় পড়তে আগ্রহী নয়। কারণ উর্দু তাদের ভাষাই নয়! শিক্ষকের নির্বিকার উত্তর, এসব তোমরা বুঝবে না। আমরা যা করছি তোমাদের ভালোর জন্যই করছি।
এবার প্রশ্ন ওঠাই কী স্বাভাবিক নয়, যে এই ভালো কার জন্য, কী উদ্দেশ্যে ? কোন অলক্ষ্য শক্তির অঙ্গুলি হেলনে প্রধান শিক্ষক ও তার সাঙ্গোপাঙ্গরা এই ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করছেন? যে সমস্ত শিশুর অবোধ বোলে আমরা দূরে সরিয়ে রাখি, তারাই কিন্তু এই ষড়যন্ত্রর পর্দাফাঁস করে দিল। ধমক ধমক দিয়েও যখন তাদের থামাতে পারেনি, তখনই পুলিশ—গুলিধরপাকড়। গ্রামের প্রতিটি কিশোর-যুবক দিনের পর দিন বাড়ির বাইরে থেকেছে। রাতে নিজের বাড়িতে না থেকে ধানখেত বা নদীর ধারে ঘুরে বেড়িয়েছে। পুলিশের উৎপাত ঠেকাতে বাড়ির মহিলারা অন্দরমহল ছেড়ে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছেন।রাজেশ-তাপসের মৃত্যুর যথাযথ তদন্তের দাবি করা কি সন্তান হারানো মায়ের অন্যায় আবদার? তবুও জেলা প্রশাসনের ভুলভাল রিপোর্টে আদালত মায়েদের বিরুদ্ধেই সরব হয়েছে। মজার ব্যাপার, যে ভয়ানক ঘটনার সাক্ষী গ্রামের হাজার হাজার মানুষ, অতি উৎসাহী অসংখ্য মানুষের মোবাইল ক্যামেরা, তা সত্ত্বেও রাজ্য প্রশাসনের অদ্ভুত নীরবতা। রাজেশ-তাপসের ডেথ সার্টিফিকেটে গুলিবিদ্ধ হওয়ার কোনও ঘটনার উল্লেখই নেই। উলটে চোর কোতোয়াল ধরে’— এই প্রবাদই এখানে সত্য হচ্ছে। গ্রামবাসীদেরই সরকার দোষী সাব্যস্ত করেছে।
এটা বলার আর অপেক্ষা রাখে না যে, বাংলাভাষা ও সংস্কৃতি আজ আবারও আক্রান্ত। খুব ধীরে এবং সুপরিকল্পিতভাবে ভাষাসন্ত্রাস চালানো হচ্ছে। পাঠ্যপুস্তক থেকে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে অসংখ্য প্রাকৃত শব্দ। সেখানে কৌশলে ঢোকানো হচ্ছে আরবি শব্দ এবং ইসলামি সংস্কৃতি। দাড়িভিটের ঘটনা এই বৃহৎ ষড়যন্ত্রেরই একটি অঙ্গ।
‘বাংলা আমার মাতৃভাষা বাংলা আমার গান
বাংলামায়ের সবুজ আঁচল জুড়ায়ে আমার প্রাণ।
বাংলাভাষার শিক্ষার দাবিতে বাঙ্গালির এই আত্মবলিদান, এতো নতুন কিছু নয়! দেশভাগের পর থেকেই বাঙ্গালিকে দফায় দফায় আন্দোলন করতে হয়েছে, বাংলাভাষায় শিক্ষালাভের জন্য। দিতে হয়েছে রক্ত, দিতে হয়েছে প্রাণ। পাকিস্তানের গণপরিষদে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষার ঘোষণা করার প্রস্তাবনা করা হয়, এর প্রত্যুত্তরে ২৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮ পাকিস্তানের গণপরিষদের দ্বিতীয় অধিবেশনে জনগণের ভাষা বাংলাকে ইংরেজি ও উর্দুর পাশাপাশি রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতির দাবি তোলেন পূর্ববঙ্গ থেকে গণপরিষদে নির্বাচিত সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। তাকে পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছিলেন পূর্ববঙ্গ থেকে নির্বাচিত অপর তিন বাঙ্গালি হিন্দু সদস্য প্রেমহরি বর্মণ, ভূপেন্দ্রকুমার বর্মণ ও শ্রীশ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। এর তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খান, পূর্ববঙ্গের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন, ডেপুটি স্পিকার এবং গণপরিষদে পূর্ববঙ্গের বিশিষ্ট সদস্য মৌলবি তমিজুদ্দিন খান। কারণ এরা কেউই বাংলা পড়তে জানতেন না। গণপরিষদে সেদিন এই প্রস্তাব খারিজ হলেও কিন্তু পরবর্তীকালে এই দাবিতে গণআন্দোলন শুরু হয়। আন্দোলনে বাঙ্গালি হিন্দুর সম্পৃক্ততা ছিল সর্বত্র। কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মী পরিষদ ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২-তে একটি প্রতিবাদ কর্মসূচি নেয়। সেদিন পুলিশের গুলিতে অনেকের মৃত্যু হয়, পুলিশ ও মিলিটারি রাতে মর্গ থেকে বহু মৃতদেহ গুম করে। দেশভাগের পর স্বাধীন ভারতেও বাঙ্গালিকে তার ভাষিক অধিকারের জন্য আন্দোলন করতে হয়েছে, রক্ত দিতে হয়েছে, প্রাণ দিতে হয়েছে। এই পটভূমি বুঝতে গেলে পিছিয়ে যেতে হবে অতীতে।
বিংশ শতাব্দীর উষালগ্নে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শাসনের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত বাঙ্গালি বিপ্লবীরা। সুচতুর ব্রিটিশ শত্রুকে চিনতে ভুল করেনি। মার্শাল রেস থিয়োরি’ নামে এক অসার তত্ত্ব খাড়া করে সেনাবাহিনীতে বাঙ্গালির প্রবেশ বন্ধ করেছিল। বঙ্গভঙ্গের পরিকল্পনাও এই একই কারণে। বাঙ্গালি হিন্দুর কোমর ভেঙ্গে দিতে বঙ্গপ্রদেশকে তারা এমনভাবে ভাগ করল যাতে উভয় ভাগেই বাঙ্গালি হিন্দু সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়। বঙ্গপ্রদেশের একাধিক বাঙ্গালি হিন্দু অধ্যুষিত সীমান্ত জেলাকে পার্শ্ববর্তী প্রদেশের সঙ্গে যুক্ত করা হয়। এইভাবে সিলেট, কাছাড় ও গোয়ালপাড়া জেলাকে অসমের সঙ্গে যুক্ত করা হয়। মানভূম, সাঁওতাল পরগনা, সেরাইকেল্লা-থরসাওয়া, সিংভূম ও ময়ূরভঞ্জ জেলাকে বিহার-ওড়িশার সঙ্গে যুক্ত করা হয়।
১৯১২ সালে মানভূম বিহার রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়, যদিও ১৯৩১-এর জনগণনায় দেখা যায় যে, জেলার সদর মহকুমায় ৮৭ শতাংশ বাংলাভাষী। বাংলাকে সরকারি ভাষা ঘোষণার দাবিতে ১৯৪৮ সালের ১৪ জুন কংগ্রেসের বাঙ্গালি নেতৃবৃন্দ অতুলচন্দ্র ঘোষের নেতৃত্বে লোকসেবক সঙ্ প্রতিষ্ঠা করে সত্যাগ্রহ শুরু করে। ৫২-এর নির্বাচনের পর সঙ্ঘের নির্বাচিত প্রতিনিধিরামানভূম জেলায় বাংলাভাষীদের ভাষিক অধিকারের কথাই বিধানসভা ও লোকসভায় তুলে ধরেন। ১৯৫৪ সালে বিহার সরকার টুসু গানকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। অতুল্য ঘোষ, লাবণ্যপ্রভা সরকার, ভজহরিমাহাতো প্রমুখ নেতাকে কারাগারেও প্রেরণ করে সরকার। অসমের কাছাড় ও গোয়ালপাড়া জেলায় বাঙ্গালির ভাষা আন্দোলনের সূচনা হয়। অসম সরকার নানা কৌশলে জেলায় বাংলামাধ্যমে পঠন-পাঠনের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করতে থাকে। ১৯৬০-এর এপ্রিলে অসম সরকার অসমীয়কেই একমাত্র সরকারি ভাষা ঘোষণা করার প্রস্তাবনা করে এবং ১০ অক্টোবর মুখ্যমন্ত্রী বিমলপ্রসাদ চালিহা বিধানসভায় অসমীয়কে একমাত্র সরকারি ভাষার স্বীকৃতির দাবিতে বিল পেশ করেন। এর ফলে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় শুরু হয়। বাঙ্গালি খেদাও অভিযান। রাজ্যের এক তৃতীয়াংশ মানুষের ভাষাকে বাকিদের বিরুদ্ধে অন্যায়ভাবে চাপিয়ে দেওয়ায় গণসংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। বরাক উপত্যকায় বাংলাকে সরকারি ভাষার স্বীকৃতির দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলেন পরিষদ নেতৃবৃন্দ। ১৯ মে পূর্ণ হরতালের ডাক দেন তাঁরা। শিলচরে শান্তিপূর্ণভাবে রেল অবরোধ করেন। অসম রাইফেলসের জওয়ানরা একদল সত্যাগ্রহীকে ট্রাকে করে নিয়ে যাওয়ার সময় বাকিরা প্রতিবাদে দৌড়ে এলে গুলি চালায়। গুলিতে এগারো জন বাংলা ভাষায় শিক্ষার দাবিতে বলিদান দেন। এর মধ্যে ছিল দুই কিশোর-কিশোরী শচীন্দ্রচন্দ্র পাল ও কমলা ভট্টাচার্য। এই ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ডের পর অবশ্য অসম সরকার বরাক উপত্যকায় জেলাস্তর পর্যন্ত সরকারি ও প্রশাসনিক কাজে বাংলা ভাষা ব্যবহারের স্বীকৃতি দেয়।
নিজের মাতৃভাষায় শিক্ষালাভের অধিকারের দাবিতে বাঙ্গালি সবসময় সরব। কেউ কখনও তাকে দাবিয়ে রাখতে পারেনি। মানভূম, শিলচরের মতো দাড়িভিটের এই বলিদান, বাঙ্গালির ভাষা আন্দোলনের এক ধারাবাহিক প্রবাহ।
ভাষা মানে শুধু মুখ থেকে উৎসারিত কিছু আঞ্চলিক শব্দগুচ্ছ নয়, ভাষা মানে সেই অঞ্চলের সংস্কৃতির প্রকাশও। বাংলাভাষায় কথা বললেই শুধুমাত্র কাউকে বাঙ্গালি বলা যায় না, বরং হাজার হাজার বছরের প্রাচীন এই ভুখণ্ডের যে সংস্কৃতি যা ভারতীয় মূল সংস্কৃতিরই অঙ্গ, তাকে নির্ভর করে যে সমৃদ্ধ ভাষাগোষ্ঠী গড়ে উঠেছে, তাকেই বাঙ্গালি বলা চলে। দাড়ি ভিটের বাঙ্গালি ছাত্র-ছাত্রীরা মাতৃভাষায় শিক্ষালাভের অধিকারের দাবিতে যে গণআন্দোলন গড়ে তুলেছে, ১৯-এর পথ ধরে ২০ সেপ্টেম্বর পশ্চিমবঙ্গের মানুষের কাছে সেটিই মাতৃভাষা দিবস। দারিভিটের মানুষ আজও রাজেশ-তাপসের মৃতদেহ আগলে রেখেছেন মাটির নীচে দোলঞ্চা নদীর শীতল স্পর্শে। রাজেশ তাপসের এই আত্মবলিদান আমরা বৃথা হতে দেব না।
প্রবীর ভট্টাচার্য

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.