পশ্চিমবঙ্গে পুলিশ পেটানোর সংস্কৃতি অশনি সংকেত বয়ে আনছে

সম্প্রতি রাতে কলকাতায় মেনকা সিনেমা হলের সামনে থেকে তিন মদ্যপ বাইক আরোহীকে টালিগঞ্জ থানার পুলিশ ধরে আনে। প্রতিক্রিয়াস্বরূপ রাত ৯টা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত এই থানায় চেতলা বস্তির ৫০-৬০ জন পুরুষ ও মহিলা থানায় তাণ্ডব চালায়। তারা শুধু অপরাধীদের ছাড়িয়ে নিয়ে যায়নি, ফের দ্বিতীয়বার হামলা চালায় পুলিশ কর্মীদের ওপরে, অফিসার-ইন-চার্জের ঘরে এবং পুলিশকর্মীদের মেসে। আহত হন ৭ পুলিশকর্মী। এতবড়ো ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরও পুলিশ গুন্ডা দমনে ব্যর্থ হলো, লালবাজারে অতিরিক্ত বাহিনীও চেয়ে পাঠানো হলো না কেন, তা নিয়েই প্রশ্ন উঠছে। শুধু কলকাতাতেই নয়, মালদায় রতুয়ার পুলিশ ফাঁড়িতেও এরকম। ঘটনা ঘটেছে। যদিও রতুয়া ফঁাড়ির ঘটনায় প্রথমের দিকে পালিয়ে বাঁচার ছবি দেখা গেলেও পরে প্রতিরোধ করে পুলিশ।
ইতিপূর্বে গুন্ডাদের মারের ভয়ে থানার ভিতরে টেবিলের নীচে, আলমারির পাশে পুলিশকে আত্মরক্ষার জন্য লুকোতে দেখা গেছে। ২০১১ সালের পর থেকে সারা রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় শয়ে শয়ে হিন্দুর ঘরবাড়ির জিনিসপত্র লুট হয়েছে, নারী নির্যাতন হয়েছে, পুরুষদের বেধড়ক পেটানো হয়েছে, অগ্নিসংযোগ করে সমস্ত গ্রামের বাড়ি ভষ্মীভূত করে দেওয়া হয়েছে। পুলিশ ঠুটো। জগন্নাথের মতো দাঁড়িয়ে থেকে দেখেছে। অপরাধীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নিতে পারেনি। আর কালিয়াচক থানায় যেদিন। গুন্ডারা আক্রমণ করে থানার গাড়ি, বাড়ি, নথিপত্র পুড়িয়ে দিয়ে পুলিশের আগ্নেয়াস্ত্র কেড়ে নিয়েছিল, পুলিশ ভয়ে থানা ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল সেদিনই অপরাধীরা বুঝে গিয়েছিল এরাজ্যে জনতা পেটানোর পর পুলিশ পেটালেও আমাদের কোনো শাস্তি হবে না। কেননা পুলিশের মেরুদণ্ড বেঁকে গিয়েছে। যদিও বিরোধীদের কোনও কর্মসূচি বানচাল করার ক্ষেত্রে বা ছাত্র, শিক্ষক বা চাকরি প্রার্থীদের রাস্তায় ফেলে পেটাতে পুলিশের মেরুদণ্ড সোজাই থাকে।
কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের পুলিশের এমন করুণ অবস্থা হওয়ার তো কথা নয়। ইতিপূর্বে পশ্চিমবঙ্গের প্রশাসন গত ৭২ বছরে অনেকবার দুঃসময় অতিক্রম করেছে। এটা তারা করতে পেরেছে কেবলমাত্র অফিসারদের নির্ভীকতা ও আক্রমণকারীদের থেকে আক্রান্তদের রক্ষায় তাদের দৃঢ়চেতা ভূমিকার জন্য। তারই কয়েকটা উদাহরণ দিলে পরিষ্কার হবে।
১। ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্টের কলকাতা নরসংহারের দিনের একটি ঘটনা এই প্রজন্মের অফিসাররা জেনে রাখুন কাজে দেবে। ঘটনার আগে থেকে মুসলিম লিগ সরকারের মুখ্যমন্ত্রী (প্রিমিয়ার) সুরাবর্দি কলকাতা শহরের মুসলমান অধ্যুষিত থানাগুলিতে এমনভাবে মুসলমান অফিসারদের দিয়ে সাজিয়েছিলেন যাতে আক্রান্ত হিন্দুরা স্থানীয় পুলিশের কাছ থেকে কোনো সাহায্য না পায়। পুলিশ কমিশনার ইংরেজ হলেও ডিসি হেডকোয়াটার্স ছিলেন মুসলিম অফিসার সামসুদ হোদা। এন্টালি, কড়েয়া, বেনেপুকুর, খিদিরপুর এলাকার হিন্দু বাসিন্দারা আক্রন্ত হয়ে প্রাণরক্ষায় ওইসব থানার পুলিশের সাহায্য পেল না। ডিসি ডিডি হীরেন সরকার ডি সি হেড কোয়ার্টার্সের ঘরে গিয়ে জানতে চাইলেন, কেন আক্রান্ত নাগরিকরা পুলিশের সাহায্য পাচ্ছে না। সেখানে কোনো সদুত্তর না পেয়ে হীরেন সরকার দুটি জিপ বোঝাই গুখ আর্মড পুলিশ নিয়ে খিদিরপুর চলে গেলেন। সেখানে গিয়ে তিনি অগ্নিসংযোগ ও হত্যায় রত আক্রমণকারীদের ‘Shoot to Kill নির্দেশ দিয়ে অবরুদ্ধ অসহায় হিন্দুদের উদ্ধার করে ভবানীপুরে নিরাপদ অঞ্চলে স্থানান্তরিত করলেন। লালবাজারের কন্ট্রোলরুমেহীরেন সরকার ফিরে আসতেই বাংলার ক্রুদ্ধ মুখ্যমন্ত্রী সুরাবর্দি তাঁর মুখোমুখি। তার প্রশ্ন ছিল, “বিনা নির্দেশে হীরেন সরকার কেন খিদিরপুর গিয়েছিলেন?” ততোধিক ক্রুদ্ধ হীরেনবাবু জবাব দিয়েছিলেন যে, ‘পুলিশ আইনে নাগরিকদের জীবন ও সম্পত্তি রক্ষায় তিনি দায়বদ্ধ। সুতরাং ওই দায়িত্ব তিনি পালন করেছেন।
ঠিক এই একই দায়িত্ব কেন নোয়াখালিতে পুলিশ পালন করেনি, সেই প্রশ্ন করেছিলেন গান্ধীজী জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে। ১৯৪৬ এর নভেম্বরে নোয়াখালির মাটিতে পা দিয়ে।
২। পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস বারবার প্রত্যক্ষ করেছে হিন্দু বাঙ্গালী জাতি। পুলিশের সিভিল সার্জেন্ট হিসাবে সমাজের কাছে একটা ভূমিকা, একটা দায়বদ্ধতা আছে। এবং এই দায়বদ্ধতা কিন্তু আগাগোড়া ফৌজদারি দণ্ডবিধি আইনে নির্দিষ্ট করা আছে। পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত থানার বড়বাবুদের স্মরণ রাখা উচিত তাদেরই একজন পূর্বসুরির কথা। তিনি ছিলেন মালদহ জেলার গাজোল থানার বড়বাবু মিহিরেশ বর্মন।
১৯৬৯ সালের ডিসেম্বর মাসে ফসলের ভাগ-বাঁটোয়ারা নিয়ে গন্ডগোলের জন্য সি. পি. এম দলের কয়েকজন ভাগচাষি জমির মালিকের বাড়িতে সশস্ত আক্রমণ চালিয়ে দু’জন মহিলাকে ধর্ষণ করে এবং এক মহিলা সহ তিনজনকে খুন করে ওই বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়। গাজোল থানার বড়বাবু ধর্ষণ, খুন ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগে চারজনকে গ্রেপ্তার করেন। সি.পি.আই.এম নেতা জ্যোতি বসু তখন দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রীসভার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
গাজোল থানার এই ঘটনার সংবাদ পার্টি মারফত জ্যোতি বাবুর কাছে পৌঁছলে তিনি সরাসরি বড়বাবু মিহিরেশ বর্মনকে ফোন করে তাঁর দলের ধৃত ওই চারজনকে জামিনে ছেড়ে দিতে বলেন। মিহিরেশবাবু সঙ্গে সঙ্গে জ্যোতিবাবুকে জানিয়ে দেন, যে অপরাধের জন্য গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাতে আইন মোতাবেক জামিন দেওয়া যাবে না।
পরে জ্যোতিবাবু স্বরাষ্ট্র দপ্তরের তদানীন্তন জয়েন্ট সেক্রেটারি মোস্তাক মুশেদিকে দিয়ে বড়বাবুকে নির্দেশ পাঠান যে, পুলিশ যেন আদালতে অভিযুক্তদের জামিনের আবেদনের বিরোধিতা না করে। কিন্তু বড়বাবু সেই নির্দেশটিও আইনগত কারণে তামিল করতে অস্বীকার করেন। এর কয়েকদিন পরে বড়বাবু মিহিরেশ বর্মনকে দ্রুত বদলির নির্দেশ দেন মালদহের পুলিশ সুপার। মিহিরেশবাবু বদলির নির্দেশ পেয়ে হাইকোর্টে যেতেমনস্থ করেন। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখোপাধ্যায় খবরের কাগজ মারফত খবরটি দেখে মালদহ সফরে যান এবং মিহিরেশ বাবুকে মালদহের সার্কিট হাউসে ডেকে পাঠান। অজয়বাবু ঘটনার পুরো সরকারি ফাইলটি দেখে মালদহের পুলিশ সুপারকে মিহিরেশ বাবুর বদলির আদেশ বাতিলের নির্দেশ দেন এবং তিনি নিজে ওই ফাইলে সই করেন।
পরবর্তী কর্মজীবনে মিহিরেশ বর্মন সেদিন তার সেই আইন মোতাবেক দৃঢ়তার জন্য সিনিয়র অফিসারদের কাছে শ্রদ্ধার পাত্রে পরিণত হয়েছিলেন। এজন্য তিনি কখনই কোনও আর্থিক সুবিধা ভোগ করেননি। কেবলমাত্র একজন সিভিল সার্ভেন্ট হিসাবে সেদিন আইন মোতাবেক সমাজের কাছে তার দায়বদ্ধতা পালন করেছিলেন।
৩। যুক্তফ্রন্ট সরকারের আমলে জ্যোতি বসু পুলিশমন্ত্রী থাকাকালীন রাজ্য পুলিশের শীর্ষকর্তা ছিলেন উপানন্দ বাবু। আজকের মতোই পশ্চিমবঙ্গ তখন রাজনৈতিক হানাহানিতে রক্তাক্ত। আসানসোলের কোলিয়ারিতে এক শ্রমিক নেতাকে খুনের ঘটনায় পুলিশ সি.পি.এমের কয়েকজন। ক্যাডারকে গ্রেপ্তার করলে ক্ষিপ্ত পুলিশমন্ত্রী জ্যোতি বাবু উপানন্দবাবুকে ডেকে প্রশ্ন করেছিলেন, কী ব্যাপার? পুলিশ আমাদের লোকজনকে ধরছে কেন? পুলিশকর্তা উপানন্দবাবু জবাবে বলেছিলেন—‘ধৃতদের নাম এফ.আই.আর-এ আছে। পুলিশ সঠিক কাজই করেছে। জ্যোতিবাবু পাল্টা কোন প্রশ্ন করতে পারেননি।
পুলিশের সঙ্গে প্রশাসন সহযোগিতা করলে এবং পুলিশকে অপরাধ দমনে ব্যবস্থা নেওয়ার স্বাধীনতা দিলে অপরাধীদের শায়েস্তা করার মানসিকতা এবং যোগ্যতা অনেক পুলিশের মধ্যেই এখনও আছে।
এখানে আরও দুটি উদাহরণ তুলে ধরছি। প্রশাসনিক কর্তাদের অবগতির জন্য।
১। ১৯৬১ সালে সিপি (আই) এম নেতা হরেকৃষ্ণ কোঙার একজন মন্ত্রী ছিলেন। রাইটার্স বিল্ডিংয়ে তার ঘরে সাংবাদিকরা উপস্থিত থাকাকালে মেদিনীপুর থেকে সরকারি সূত্রে খবর এল, মন্ত্রীর দলের কিছু লোক ঝাড়গ্রাম অঞ্চলে কিছু দাবিতে পথ অবরোধ করে বসে আছে।
হরেকৃষ্ণবাবুর মনে পাপ থাকলে তিনি পুলিশকে নিস্ক্রিয় থাকার ইঙ্গিত দিতে পারতেন। কিন্তু তিনি দুর্নীতিগ্রস্থ রাজনীতিবিদ ছিলেন না। তাই তিনি সরাসরি হুমকি দিলেন; “আমার নাম করে ওদের বলুন, ১৫ মিনিটের মধ্যে উঠে যেতে। তার পরেও যদি ওরা অবরোধ না তোলে,পিটিয়ে তুলে দেবেন।”
২। ১৯৭২ সালে পুলিশ বিভাগের প্রতিমন্ত্রী হয়েছিলেন তখনকার ছাত্র পরিষদ নেতা সুব্রত মুখোপাধ্যায়। এখন যিনি পঞ্চায়েত মন্ত্রী। হাওড়া শহরের ছাত্র পরিষদের কিছু ছেলে জেলাশাসকের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার জন্য তার অফিসের সামনে পথ অবরোধ করে। সুব্রতবাবু সেকথা জানতে পেরেই মহাকরণ থেকে সোজা হাওড়ায় চলে গেলেন। ছাত্র পরিষদ কর্মীদের কথা শুনে তাঁদের বক্তব্য বিবেচনা করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাদের অবরোধ তুলে নিতে বলে মহাকরণে ফিরে এলেন।
সুব্রতবাবু প্রতারক ছিলেন না। তিনিও সোজা-সাপ্টা মানুষ। তাই রাইটার্সে ফিরে এসে খবর নিয়ে জানলেন, অবরোধ ওঠেনি। তখন তিনি পুলিশকে বললেন, “এবার পুলিশ যেমন করে পারে অবরোধ তুলে দিক।” এই দুটি ঘটনাও বুঝিয়ে দিচ্ছে, সরকারের সদিচ্ছা থাকলে পুলিশেরও যোগ্যতার অভাব হয় না।
আমরা মনে করি পুলিশের পিটুনি খাওয়া শুধু পুলিশের লজ্জা নয়, এ লজ্জা শাসকেরও। কারণ পুলিশকে মেরুদণ্ডহীন করে তোলার পিছনে সবচেয়ে বেশি দায়ী এই শাসকই। আমরা আশা রাখি, স্বকীয়তা বজায় রাখতে ও নিজেদের ভাবমূর্তি ফেরাতে কড়া পদক্ষেপে অটল থেকে এই লজ্জাজনক ঘটনার বিহিত করবে বর্তমান প্রশাসন। এটা শুধু রাজ্যের জন্য নয়, গোটা সমাজের জন্যই অত্যন্ত জরুরি।
মনীন্দ্রনাথ সাহা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.