দিনটি ছিল ১৯৭১-এর ১৮ আগস্ট ভারতীয় সেনাদের সাহায্য করতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারিয়েছিলেন এলাকার আদিবাসী তরজাতা যুবক। পাকিস্তানি খান সেনাদের আক্রমণের মুখে সেনাদের সাহস যুগিয়েছিলেন এই চুড়কাই। এলাকার মানুষদের কাছে চুড়কা শহীদের আসন পেলেও কোনও এক অজানা কারণে সরকারি স্বীকৃতি পায়নি চুড়কার পরিবার। শহীদ হয়েও কেন চুড়কা পেল না শহীদের সন্মান এই প্রশ্ন থেকেই গেল। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের স্বয়ংসেবক ছিল বলেই কি তাঁর নাম বাদ পড়েছে তালিকা থেকে?- প্রশ্ন তুলেছেন চুড়কার বন্ধু অরুণ কুমার মহন্ত।নাকি আঞ্চলিক ইতিহাস বলেই আজও সরকারের কাছে উপেক্ষিত?- বললেন দক্ষিণ দিনাজপুরের এক ইতিহাসবিদ। ইতিহাসবিদ সমিত ঘোষ বলেন, চুড়কা দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছে যা প্রমাণিত। তাকে নিয়ে অনেক বই রয়েছে। চুড়কা শহীদের দাবিদার। বিষয়টির সরকারি তদন্ত হওয়া জরুরি।
বালুরঘাট শহর থেকে সামান্য দূরে বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া চকরাম এলাকা। যে গ্রামে ১৯৫১ সালের ২রা জুলাই কৃষক আদিবাসী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন চুড়কা মুর্মু। ছোট থেকেই পড়াশুনার পাশাপাশি যে কোনও কাজেই চরম উৎসাহ ও উদ্দীপনা ছিল চুড়কার। শিশু কার থেকেই রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের শাখায় যায় চুড়কা। ছেলে বেলায় চকরাম প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গণ্ডি অতিক্রম করে বালুরঘাট জেএলপি উচ্চ বিদ্যালয়ের একাদশ শ্রেণির ছাত্র তখন চুড়কা এবং সঙ্ঘের শাখার মুখ্য শিক্ষকের দায়িত্ব। সালটা ১৯৭১-এর ১৮ আগস্ট। যে সময় চলছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ। সাত সকালে প্রাতঃভ্রমণে বেড়িয়ে চুড়কা দেখতে পায় গ্রামের লোকেরা দৌড়ে পালিয়ে গ্রাম ছাড়ছে। তাতে বিন্দুমাত্র সে বিচলিত না হয়ে গ্রামের লোকেদের কাছে জানবার চেষ্টা করে তাদের পালাবার কারণ। তাঁরা জানান পাকিস্তানি খান সেনারা চকদুর্গা এলাকায় ঢুকে পড়েছে। সেই খবর শুনতে পেয়েই পার্শ্ববর্তী বিএসএফ ক্যাম্পে দৌড়ে গিয়ে খবর দেয় চুড়কা। কিন্তু সে সময় ক্যাম্পে উপস্থিত ছিল হাতে গোনা মাত্র কয়েকজন সেনা জওয়ান। যাদের তুলনায় পাকিস্তানি খান সেনার সংখ্যা অনেক বেশি ছিল। সংখ্যা কম থাকায় সেনা জওয়ানদের গোলাবারুদের বাক্স কে নিয়ে যাবে তা নিয়ে কিছুটা দ্বিধায় পড়েন সেনা জওয়ানরা। যে কথা শুনে বিন্দুমাত্র পিছু না হটে নিজেই কাঁধে গোলাবারুদের বাক্স তুলে নিয়ে সেনা জওয়ানদের উত্সাহিত করেন চুড়কা। কিছু দূরে এগোতেই খান সেনারা ঘিরে ফেলে ওই সেনা জওয়ানদের। কিন্তু তখনও হাল ছাড়েনি চুড়কা। তাঁর দেশের গোলাবারুদ যেন কোনও ভাবেই শত্রু পক্ষের হাতে না যায় সেই জন্য কিছুটা লুকিয়ে পাশের একটি পুকুরে ফেলতে যান চুড়কা। সেই সময় পা পিছলে পুকুরে পড়তেই তার শব্দ শুনেই খান সেনারা চুড়কাকে লক্ষ্য করে চালায় এলোপাথাড়ি গুলি। মুহুর্তের মধ্যে প্রাণ চলে যায় তরতাজা ওই আদিবাসী যুবকের। দেশের জন্য প্রাণ দেওয়ায় এলাকার মানুষেরা ১৮ আগস্ট দিনকে শুধু মাত্র শহীদ দিবস পালন করায় নয়, এলাকায় স্থাপন হয়েছে তাঁর শহীদ বেদী, রয়েছে তাঁর সমাধিও। চুড়কার স্কুলে আজও সাড়ম্বরে পালিত হয় শহীদ দিবস। স্কুলের আদিবাসী হোস্টেলের নাম করণও হয়েছে চুড়কার নামানুসারে।প্রতিবছর রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের পক্ষ থেকে ১৮ আগস্ট চুড়কা মুর্মু স্মৃতি রক্ষা কমিটির নামে কাবাডি, তীরন্দাজি প্রতিযোগিতা ও দুস্থ ছাত্রদের আর্থিক সাহায্যের মাধ্যমে চুড়কার সেদিনের সেই বলিদান স্মরণ করা হয়। সেদিনের এক প্রত্যক্ষদর্শী পুলিন বর্মন বলেন, গ্রামের সবাই পালিয়ে গিয়েছিল। আমি একটি জায়গায় লুকিয়ে দেখেছিলাম চুড়কা সাহস করে বিএসএফদের নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার সময়ই খান সেনাদের গুলিতে তাঁর দেহ ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। তাকে আজও দেওয়া হয়নি সরকারি ভাবে শহীদের মর্যাদা। চুড়কার আত্মীয় মোহন টুডু বলেন, দেশের জন্য শহীদ হয়েও মর্যাদা পায়নি সে। তাঁর বন্ধু অরুণ কুমার মহন্ত বলেন, একই সঙ্গে পড়াশুনা করতাম। অত্যন্ত সাহস ও উদ্দীপনা ছিল তাঁর। সে একজন স্বয়ংসেবকও ছিল। তাকে আজও কেন শহীদের সম্মান দেওয়া হয়নি তা তাদের কাছে এক অজানা প্রশ্ন। বিষয়টির তদন্ত হওয়া জরুরি।
2022-08-18