পূর্ব অংশ

~~~দ্বিতীয়~~~ 
।। বিশালাক্ষী স্বরূপা বঙ্গের মাতা ঠাকুরানী ও বঙ্গেশ্বরী বিজয়া।।

তপ্ত কাঞ্চন বর্ণা বঙ্গেশ্বরী দেবী দ্বিভুজা ।ডান হাতে ছুরিকাসদৃশ খড়্গ ,বাম হাতের রুধির পাত্র, ত্রি নয়না দেবী এলোকেশী; তবে শিরোপরি মুকুটশোভিতা। দেবী বঙ্গেশ্বরী বিশাল লোচনী নন। চোখ দুটো টানা টানা অপূর্ব সুন্দর।পদতলে শায়িত মহাকাল, অহিভূষন মহাকাল শ্বেতশুভ্র ,পরনে শ্বেত বর্ণের বাঘছাল। গলদেশে ও বাহুতে রুদ্রাক্ষের মালা। ডান হাতে ধরা ডমরু, বাম হাত ভাঁজ করে জটাজুটমণ্ডিত মস্তক তলে রাখা । ধ্যান মন্ত্র অনুসারে মহাকালের রূপ হওয়া উচিত ছিল শব রূপী শিব তুল্য। কিন্তু এখানে মহাকাল অপলক দৃষ্টিতে দেবীকে প্রত্যক্ষ করছেন। দেবীর গমনোদ্যত বাম পা মহাকালের ডান বাহু ও বক্ষদেশের সন্ধি স্থলে রক্ষিত। ডান পা মহাকালের জঙ্ঘার উপর স্থাপিত।

বঙ্গেশ্বরীর গলদেশে নৃমুন্ডমালা।দেবীর মুখমণ্ডল শান্ত,সমাহিত দৃষ্টি দুটি নয়নে। এক ঝলকে বিশালাক্ষী উপলব্ধি হবে।

যদিও বিশালাক্ষী চিরাচরিত বিগ্রহের বিশুদ্ধ ধ্যানমন্ত্র অনুযায়ী বাম পা উপবিষ্ট কালভৈরব এর মাথার উপর ,ডান পা শবরূপী মহাকালের মাথার উপর থাকা উচিত। অবশ্য বিশালাক্ষীর কয়েকটি প্রাচীন মূর্তিতে দেবীর বাম পা পদ্মাসনে ও বা বজ্রাআসনে উপবিষ্ট মহাকালের মাথা বা কাঁধের উপর ও ডান পা চক্রাসনেস্থিত কালভৈরবের মাথা কাঁধের উপর থাকা উচিত। ক্ষেত্র বিশেষের পরিবর্তে বিরুপাক্ষ বাা বটুক ভৈরবের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় ।

এই যে উক্ত নাম গুলি বললাম। এনারা সবাই ক্ষেত্রবিশেষে শিবের অংশ ও সাধকচিত উপদেবতা বিশেষ। তাঁরা নীলাভ বা সবুজ বা রক্তবর্ণ হয়ে থাকেন।

কিন্তু এই শায়িত মহাকালএ সুদর্শন । তাছাড়া দেবী বঙ্গেশ্বরীর পরিকর দেবদেবী রূপে অধিষ্টান করছেন তপ্ত কাঞ্চনবর্ণা লক্ষী, শ্বেত শুভ্র উর্ধনেত্র গণেশ , শরৎজ্যোৎস্না সরস্বতী ও হরিদ্রা বর্ণের দেবসেনাপতি ময়ূরবাহন কার্তিক। একটি বাঁধান বেদীর উপর রক্ষিত মৃন্ময়ী মূর্তি । পরিকর দেবদেবীগন দেবী বঙ্গেশ্বরীর পুত্র কন্যা।

দেবী বঙ্গেশ্বরীর পিছনে বর্ণময় সুদৃশ্য চালচিত্র । চালচিত্রের উর্ধভাগে দুটি বৃহৎ ঘড়ি অঙ্কিত আছে । শারদীয় দুর্গোৎসব এখানে দুর্গা পূজার সময় বঙ্গেশ্বরী মোহৎসব হয়। মাতা বঙ্গেশ্বরী এখানে দুর্গা বা চন্ডীর আকৃত ভেদ। পূজার সময় দু একবার রাজবল্লভী নামে সম্বোধিত হলেও, রাজবলহাটের প্রসিদ্ধ রাজবল্লভী দেহবর্ণ শরৎকালীন জোৎস্নারপ্রভাসম। তিনি তপ্তকাঞ্চনবর্ণা নন। তাঁর পদতলে বিরূপাক্ষের অধিষ্ঠান । সুতরাং আর যাই, দেবী বঙ্গেশ্বরী হোন রাজবল্লভী নন। বরং দ্বিভুজা দুর্গা বা চন্ডী সঙ্গে সাদৃশ্য বেশি ।

বঙ্গেশ্বরী দেবী দুর্গা রূপে, রণরঙ্গিনী কালীর মত মুন্ডমালা পরিধান করেছেন । তন্ত্রসারে উগ্রচন্ডার মূর্তিতে দুর্গা ও কালী সমন্বিত হয়েছেন। মৎস্যপুরাণ ,কালিকাপুরাণ , বিদ্যাপতি রচিত দুর্গাভক্তিতরঙ্গিনী তপ্তকাঞ্চনবর্ণা দেবী দুর্গা মাচন্ডী রূপে কখনো অষ্টভুজা, কখনো দ্বিভুজা । গিরিরাজের অনুরোধে দেবী দ্বিভুজা শৈল্যসুতা, নীলোৎপল বর্ণা।

মুণ্ডমালাতন্ত্র থেকে প্রাণতোষিনী মন্ত্রে উদ্ধৃত দেবী চণ্ডী, উমা , গৌরী প্রমুখ নাম পাওয়া যায় । কালিকাপুরানে উমা দ্বিভুজা, সুবর্ণতুল্য, গৌরবর্ণা । তবে তিনি ব্যাঘ্রচর্মস্থিত পদ্মের উপর পদ্মাসনে উপবিষ্টা । তৈত্তিরীয় আরণ্যকে দুর্গাকে অগ্নিরুপা তপপ্রজ্জ্বলিত রুপে বর্ণনা করা হয়েছে । আবার বঙ্গদেশে তন্ত্রের বিশালাক্ষী দেবী চন্ডী- চামুণ্ডা – কালীর সঙ্গে অভিন্না। তন্ত্রসারে এ বর্ণিত বিশালাক্ষী ধ্যানমন্ত্র অনুসারে দেবী তপ্ত কাঞ্চনবর্ণা দ্বিভূজা , খড়গহস্ত , রক্তবর্ণা , মুণ্ডমালাভূষিতা , মুকুটশোভিতা । এই বর্ণনার সঙ্গে সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয় । তাই বঙ্গেশ্বরীর পূজা তাই বিশালাক্ষীর ধ্যানমন্ত্রই করা হয়।

এক শ্রেণীর গবেষকরা মনে করেন দুর্গা শব্দের দুর্গাধীষ্ঠাত্রী দেবী কে বোঝানো হয়েছে । দেবীপুরানে দেবীকে দুর্গে বিরাজমান রূপে উল্লেখ করা হয়েছে । অবশ্য তিনি দেবী ভাগবত জনগণ, নগর ও সাধারণ মানুষের রক্ষাকর্তী । বঙ্গেশ্বরী এই রূপে বঙ্গের ঈশ্বরী। তিনি বঙ্গ দেশের রক্ষায়িত্রি। তিনি বঙ্গবাসীর মাতা ঠাকুরানী। তিনি বোমনগর গ্রামের পালনকর্তী গ্রাম দেবী । তিনি অভিনব লৌকিক দেবী । সারা বছর তিনি ইস্টক নির্মিত দেউলে অধিষ্ঠান করেন । তিনি বিশালাক্ষী সদৃশ্যা। “দুর্গা – চন্ডী” সদৃশ্যা হলেও মহিষাসুরমর্দিনী সিংহবাহিনী দশভূজা নন । এমনকি তিনি চন্ডীও নন। তিনি আদি অকৃত্রিম বঙ্গেশ্বরী। গ্রাম্য লোকসমাজের হৃদয়জাত দেবী।

শারদীয় মহাপূজায় তিনি মহাপূজিতা হন কিন্তু তাঁর বিসর্জন হয় না। কেবল প্রয়োজনে গঙ্গা মাটি দিয়ে নবকলেবর নির্মাণ হয়। তখন পুরাতন বিগ্রহ গ্রামস্থ হাজরা পুকুরে বিসর্জন দেওয়া হয়। একে বলে “বঙ্গেশ্বরী বিজয়া”।

দুর্গেশনন্দিনী

(ক্রমশ)

(পরবর্তি অংশ)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.