সোদপুর আশ্রম কলকাতার উত্তরে অবস্থিত একটি আশ্রম। কলকাতা থেকে প্রায় আট-নয় মাইল দুরে অতিশয় মনোরম, গাছ-গাছালি লতাপাতায় পরিপূর্ণ এই আশ্রমটি গান্ধীজির অত্যন্ত প্রিয় এতটাই যে আগের বার যখন তিনি এখানে এসেছিলেন উনি বলেছিলেন “এই আশ্রম আমার অত্যন্ত প্রিয়, সবরমতী আশ্রম এর সমকক্ষ”।
আজকে সকাল থেকেই এই আশ্রম এর বাসিন্দাদের মধ্যে অত্যন্ত চাঞ্চল্য দেখা যাচ্ছে। এই আশ্রমের বাসিন্দাদের অবশ্য এমনিতেই রাত্রে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে সকালে ওঠার নিয়ম আছে কিন্তু আজকের দিনটা একটু বিশেষ। স্বয়ং গান্ধীজি আসছেন এখানে থাকতে, আর তারই তোরজোড় চলছে প্রায় এক সপ্তাহ আগে থেকেই। সাফ-সাফাই, স্বাচ্ছতা এসব তো এখানকার রোজকার ব্যাপার, কিন্তু আজ বিশেষভাবে সবকিছুর দেখাশোনা চলছে কারণ বাপুজী আসছেন।
![](https://ritambangla.com/wp-content/uploads/2019/08/1308gandhismall.jpg)
বিশেষত সতীশবাবুর উৎসাহ চোখে পড়বার মতন। সতীশবাবু মানে সতীশচন্দ্র দাসগুপ্ত। আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় দ্বারা প্রতিষ্ঠিত ভারতের প্রথম কেমিক্যাল কোম্পানি, অর্থাৎ বেঙ্গল কেমিক্যাল ওয়ার্কস এর বেশ ভাল চাকুরী ছিল তার। সেখানে সুপারিনটেনডেন্ট পদে ছিলেন উনি। আর তাছাড়া নিজে বৈজ্ঞানিক হওয়ার দরুন নিজের থেকেও অনেক রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে থাকেন উনি। কিন্তু একদিন ওনার স্ত্রী হেমপ্রভা আর উনি স্বয়ং গান্ধীজির সংস্পর্শে আসেন আর সবকিছু ওলট-পালট হয়ে যায়। প্রায় ২৬ কি ২৭ বছর আগে একদম সঠিক ভাবে বলতে গেলে ১৯২৯ সালে সতীশবাবু নিজের সুন্দর চাকুরীটিকে ছেড়ে কলকাতার বহিরবর্তী এই মনোরম আশ্রম স্থাপন করেন। আজকাল সতীশবাবু আর হেমপ্রভাদেবী এই আশ্রমেই বসবাস করেন।
![](https://ritambangla.com/wp-content/uploads/2019/08/87558216_dpf_0150.jpg)
হেমপ্রভাদেবীর ওপর গান্ধীজির খুব গভীর প্রভাব পরেছিল। এইজন্যই একদম শুরু থেকেই গান্ধীজির আন্দোলন কে জিইয়ে রাখতে উনি ওনার নিজের কাছে যা সোনা ছিল তা যেন সব কিছুই গান্ধীজিকে দান করে দিয়েছিলেন। সতীশ বাবুর এতে কোন আপত্তি তো ছিলই না বরং তার এক প্রকার অহংকার ই ছিল নিজের অর্ধাঙ্গিনী কে নিয়ে।
সতীশবাবু এই আশ্রমে অনেক রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছিলেন। একে তো উনি মূলত বিজ্ঞানী তার ওপর গান্ধীজির স্বদেশী ভাবধারায় প্রভাবিত। উনি আসলে একরকম সস্তা এবং সরল অয়েল-প্রেস বানিয়েছিলেন। তার সাথে বাঁশের ছাল থেকে কাগজ বানানোর একটি কারখানাও তৈরি করেছিলেন আশ্রম এর মধ্যেই । এই কারখানায় তৈরি কাগজ একটু হয় বটে কিন্তু তাতে সহজেই লেখা যায় আর দেখতেও বেশ ভালো লাগে। এতে আশ্রম এর কাজ দিব্যি চলে যেত। আশ্রমের সব স্টেশনারি এই কাগজের উপরেই ছাপা হতো। কিছু কাগজ বাইরেও বিক্রি করা হতো।
![](https://ritambangla.com/wp-content/uploads/2019/08/5780a0b9fc3d0c57db351e700d49b809-orig.png)
সতীশবাবু ভালোমতোই জানতেন যে গান্ধীজি এই আশ্রমটিকে খুব ভালোবাসেন । বছর কিংবা দেড়-বছর অন্তর অন্তর গান্ধীজি এখানে এসে এক মাসের মতন কাটিয়ে যান। সেই সময় ওনার সাথে দেখা করতে নামি সব নেতারা আসেন এই আশ্রমে। এইসব ব্যাপারে আর এই মহান ব্যক্তিদের আগমনে আশ্রমের পরিবেশ আরো পবিত্র হয়ে ওঠে।
সতীশবাবু পরিষ্কার মনে আছে আট বছর আগে মানে ওই ১৯৩৯ এ ওনার সাথে সুভাষবাবুর দেখা হয়েছিল। গান্ধীজি, সুভাষবাবু আর নেহেরু এই তিনজনই শুধু ছিলেন। গান্ধীজির ইচ্ছের বিরুদ্ধে সুভাষচন্দ্র বোস, ত্রিপুরী (জবলপুর) কংগ্রেসের অধ্যক্ষ হিসেবে মনোনীত হন। কিন্তু কংগ্রেসের অন্য কিছু নেতা ওনাকে যথেষ্ট দুঃখ দিয়েছিলেন, সেই সমস্যার সমাধান করতেই ওই বৈঠক। কংগ্রেসের অধিবেশন শেষ হওয়ার সাথেসাথেই ওই বৈঠক।
ওই বৈঠকে সমস্যার কোন সমাধান তো বেরোলই না, উল্টে সুভাষবাবুই কংগ্রেস ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। সতীশবাবু গান্ধীজীর যতবড়ই ভক্ত হোন না কেন, এই ব্যাপারে উনি যারপরনাই দুঃখ পেয়েছিলেন। সে যাই হোক, সতীশবাবু নিজের এইসব চিন্তাগুলোকে ঝাড়া দিয়ে উঠলেন কারণ গান্ধীজির আসবার সময় হয়ে এসেছে এমনিতেই কলকাতায় সূর্যোদয় খুব তাড়াতাড়ি হয়। এই জন্যই পৌনে পাঁচটার মধ্যেই বাইরে আলো ফুটে গেছে।
![](https://ritambangla.com/wp-content/uploads/2019/08/1308gandhi11.jpg)
ব্যাস আর কয়েক ঘন্টার মধ্যেই গান্ধীজি এসে পড়বেন।