দ্বিতীয় পর্ব
জল জীবন। জল জীবন ধারণের সঞ্জীবনী তরল। তাই জলকে প্রাচীন ঋষিরা নানারূপে নানা ভাবে পূজা করেছেন। তাঁরা জল সংরক্ষণ , জল দূষণ প্রতিরোধ করতে, জল বাস্তুতন্ত্রের স্থিতি বজায় রাখতে সদা সতর্ক এবং যত্নবান ছিলেন । তাই বেদে উল্লিখিত হয়েছে-
পয় পৃথিব্যাং পয় ওষধীষু পয়ো দিব্যন্তরিক্ষো পয়ো ধাঃ।
পয়স্বতীঃ প্রদিশ সন্তু মহ্যম্।। ( যর্জুবেদ)
ভূগর্ভে ,ঔষধীতে , অন্তরীক্ষে পয় অর্থাৎ জল স্থাপিত হোক। জগতের কল্যাণে দিগ্ববিদিক রসযুক্ত হোক।
অর্থাৎ, জল সম্পদের উপযুক্ত সংরক্ষণের জন্য পরিবেশের প্রত্যেক অংশের তরল , বাষ্পীয় বা কঠিন অবস্থায় জলের আবর্তনচক্রকে অব্যাহত রাখা নিশ্চিত করতে হবে। ভূভাগে বা বাতাসে সর্বত্র উপস্থিত জল সম্পর্কে বৈদিক ঋষিরা শ্রদ্ধা ও সম্ভ্রমের একটি ভাব পোষণ করতেন। তার নিদর্শন আমরা বিভিন্ন শ্লোকে পাই।
শং ন আপো ধন্বন্যাঃ শমু সনত্বনূপ্যাঃ।
শং নঃ খনিত্রিমা আপঃ শমু যাঃকুম্ভ আভৃতাঃ
শিবা নঃ সন্তু বার্ষিকীঃ।
মরুদেশ সম্ভূত , অনূপ ও জলাভূমি উদ্ভূত , খননোদ্ভূত , কুম্ভে সংগৃহীত , বর্ষণ হেতুভূত সকল জল – তোমরা সকলে আমাদের প্রতি মঙ্গলপ্রদ হও।
অপ্ স্বন্তরমৃতমপসু ভেষজমপামুত প্রশস্তয়ে।
দেবা ভবত বাজিনঃ।।
জলের ভিতর অমৃত আছে। জলে আছে ভেষজ। হে ঋষিগণ , সেই জলের প্রশস্তিতে উৎসাহী হয়ে উপযুক্তভাবে জলের সঞ্চয়ভান্ডার সত্বরে গড়ে তোলা।
এখানেই সরস্বতী নদীর গুরুত্ব। সেই ব্যাখ্যা আমি পূর্ব পর্বে বিস্তারিত বলেছি। এই পর্বে আরো কিছু বলব। প্রসঙ্গত , কেবলমাত্র ঋষি বশিষ্ঠই সরস্বতী মাতৃকার মন্ত্রোচ্চারণ করেন নি, করেছিলেন আরো বহু মুনি ঋষি।
ঋগ্বেদ দ্বিতীয় মন্ডল , ৪১ তম সূক্ত, ১৬,১৭,১৮ সংখ্যক ঋক্ , সরস্বতী দেবীর মন্ত্র উচ্চারণ করেছেন ঋষি গৃহৎসমদ। মন্ত্র উচ্চারিত হয়েছে অনুষ্টুপ ছন্দে।
অম্বিতমে নদীতমে দেবিতমে সরস্বতী।
অপ্রসস্তা ইব স্মসি প্রসস্তিমম্ব নস্কৃধি।।
মাতৃকাগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ , নদীগণের শ্রেষ্ঠ, দেবীগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হে সরস্বতী আমাদের সমৃদ্ধশালী করো।
ত্বে বিশ্বা সরস্বতী শ্রিতায়ুংষি দেব্যাম্।
শুনহোত্রেষু মৎস্ব প্রজাং দেবি দিদিডঢি নঃ।।
হে দেবী , আপনিই সর্বেশ্বরী , আপনিই সোমের অধিকারিণী। আপনিই তাই সেই সোম পান করো। তুমি তুষ্ট হও। আপনিই আমাদের সম্পদ দান করো এবং আপনার প্রজাদের সুখী রাখো।
ইমা ব্রহ্ম সরস্বতী জুষস্ব বাজিনীবতি।
যা তে মস্ম গৃৎসমদা ঋতাবরি প্রিয়া দেবেষু জহ্বতি।।
হে জলবাহিনী সরস্বতী , দেবতাগণের প্রিয় হব্যসমূহ ঋষি গৃৎসমদ আপনাকে অর্পণ করছে।
অর্থাৎ, ঋষি গৃৎসমদ , তিনি সরস্বতীকে প্রসন্ন করছেন। হব্য দান করছেন। দেবী সরস্বতী মাতা এবং নদীগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠা। তিনিই সোমের অধিকারিণী। তিনি তুষ্ট হলেই সকলের মঙ্গল। তাই তাঁর উপাসনাই সকলের নিকট কাম্য। তিনি তীব্র প্রবহমানা নদী হতে মাতা ও দেবী হয়েছেন। বশিষ্ঠ তাঁকে হোম দ্বারা হব্য প্রদানের পরেও বহু বহু ত্রিকালজ্ঞ ঋষিরা দেবীর উপাসনা করেছেন। তাঁর মধ্যে অন্যতম হলেন ঋষি ভরদ্বাজ। তিনি গায়ত্রী এবং অনুষ্টুপ ছন্দে সরস্বতী স্তব উচ্চারণ করেছিলেন। ঋগ্বেদের ৬১ সূক্তের ১ থেকে ১৪ সংখ্যক ঋক্ দেবী সরস্বতীর নিমিত্ত উচ্চারিত হয়েছিল ভরদ্বাজ ঋষি দ্বারা।
সেখানে ঋষি বলেছেন – শক্তিরূপিনী দেবী সরস্বতী বেগ সম্পন্না। তিনি পবর্ত সকল ভগ্ন করে প্রবাহিতা হন। আমরা তাই তাঁর পরিচর্যা করি। তাঁর আশীর্বাদ প্রাপ্ত বলশালী সন্তান পণি সংহার করেছেন। তিনি দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনকারিণী রূপে জীবকুলকে রক্ষা করছেন। দেবী সরস্বতী কৃষির উপযুক্ত ভূমি দিয়েছেন। তিনি বৃষ্টির কারণ হয়েছেন। তিনি অন্ন দ্বারা আমাদের প্রতিপালন করছেন। মা সরস্বতী সংগ্রামে আমাদের রক্ষা করবেন এবং ধন প্রদান করবেন।
ভয়াল , রুদ্র রূপে দেবী সরস্বতী রথারূঢ়া হয়ে শত্রুবধ করবেন এবং জীবকুলকে সমৃদ্ধ করবেন। তাঁর দীপ্ত প্রচন্ড গতি জলধারা ভয়ানক শব্দকরে প্রহবাহিত হচ্ছে। সূর্য যেমন দিন সকলকে আনেন , সরস্বতী তেমনি তাঁর অন্য ভগ্নিগণকে আহ্বান করবেন ।তিনি সপ্ত নদীরূপে সপ্ত মাতৃকার আধার। তিনি সপ্ত ভগ্নি সম্পন্না। স্বর্গ মর্ত্য পাতাল লোকের বিস্তীর্ণ স্থান তিনি পূর্ণ করেছেন। তিনি আমাদের শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করবেন । তিনি প্রতিটি যুদ্ধে আহ্বান পেলে যেন আসেন। হে দেবী সরস্বতী তুমি আমাদের হীন করো না। তুমি প্লাবন বা অধিক জল দ্বারা আমাদের নিপীড়ন করো না। আমাদের সকল দোষ ক্ষমা কর। আমরা যেন তোমরা নিকট হতে নিকৃষ্ট স্থানে চলে না যাই।
ভরদ্বাজ ঋষির এই স্তব থেকে কিছু সংবাদ পাওয়া যায়। তিনি এখানে প্রবল সংহার রূপীনি শক্তি স্বরূপা সরস্বতীর কথা বলেছেন । যিনি প্লাবিত হন। প্লাবিত হয়ে যেমন কৃষি উপযুক্ত প্লাবন ভূমি দান করেন তেমন প্রচন্ড ভাবে প্লাবন ঘটিয়ে পাপের শাস্তি দিতেন। তাঁর প্রবল রূপকে জীব তথা মানবকুল ভয় পেত , কিন্তু তাঁর তীর পরিত্যাগ করে অন্যত্র যাবার কথা ভাবতে পারত না।
আরো একটি কথা এখানে উল্লেখ্য। দেবী সরস্বতী হলেন সপ্তমাতৃকার মিলিত রূপ। তিনি সপ্তভগ্নি বিশিষ্টা। এই সপ্ত মাতৃকা বা ভগ্নি হলেন ঝিলম, চেনাব, রাভি , বিয়াস , সতলুজ এবং সিন্ধু। সতলুজ হল বর্তমানের শতদ্রু নদী , বৈদিক নাম শুতুদ্রু। বৈদিক পরুষ্ণি হলেন ইরাবতী বা রাভি, বিপাশা হলেন বিয়াস, বৈদিক অস্কিনি হলেন চেনাব, বিতস্তা হলেন ঝিলম।
দেবী সরস্বতী শক্তি স্বরূপা , মাতৃ স্বরূপা হয়ে কোনোদিন কোনো ভক্তকে কোনো সন্তানকে তিনি নিরাশ করতেন না। তেমনি এক কাহিনী বলি এই প্রবন্ধে –
রাজা রথবিথীর এক কন্যা ছিল। রাজা রথবিথীর রাণী চেয়েছিলেন ছিলেন একজন ঋষি কে নিজের কন্যার জামাতা হিসাবে দেখতে। এক কালে রাজা শুভ রাজসুয় যজ্ঞের আয়োজন করেছিলেন এবং সেই যুগের পৌরহিত্য করেছিলেন অত্রির পুত্র অর্চনানা। তাঁর সঙ্গে এসেছিলেন তাঁর পুত্র ও অত্রির পৌত্র স্যাবাশ্ব।
সেই সময় যজ্ঞ চলত বহু কাল ধরে। তারই মধ্যে গড়ে উঠল রাজকন্যা ও সেই ঋষি পুত্রের না বলা অব্যক্ত প্রেম।
স্যাবাশ্ব একদিন রাজা রথবিথী নিকট আবেদন জানালেন রাজকন্যার কে তার হাতে বৈদিক বিবাহের মাধ্যমে সমর্পন জানানোর জন্য – সংযুজ্যস্ব ময়া রাজন।
অনুমতি দিতে রাজার আপত্তি হয়নি -স্যাবাশ্বয় সুতাং দিৎসু । কারণ কোথায় কী ঘটছিল তিনি সব খবর রাখতেন। কিন্তু রাজমহিষীর সঙ্গে আলোচনা না করে তিনি কোন নির্ণয় করতেন না। হাজার হলেও তার কন্যার ওপর রাজমহিষীর অধিকার অনেক বেশি ছিল বলে তিনি মনে করতেন ।
তিনি যখন রাজমহিষী কে জানালেন বিষয়টি তখন তার রাজমহিষী বলেছিল , মহারাজ! আমি এক রাজর্ষি ঘরের মেয়ে । নৃপর্ষিকুলজা হ্যহম। আমিও এই গৌরব মাথায় নিয়ে তোমায় জানাচ্ছি, এখনো পর্যন্ত যে যুবক বেদের একটি মন্ত্র বর্ণ দর্শন করে নি , তিনি ঋষি পদবাচ্য নন, সেরকম অঋষি র হাতে আমার কন্যাকে তুলে দেব না – নানৃষী নৌ তু জামাতা নৈষ মনত্রাণ হি দৃষ্টবান।
এবং তিনি বলেছিলেন যে মেয়ের যদি বিয়ে দিতে হয় তাহলে একজন ঋষির সঙ্গে দাও । মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষিকে বিবাহ করলে পরবর্তী পৃথিবীর প্রজন্ম আমার মেয়েকে বেদ মাতা হিসাবে জানবে – ঋষয়ে দিয়তাং কন্যা বেদস্যাম্বা ভবিষ্যতি।
রাজমহিষী এখানে কিন্তু একজন ঋষিকে জামাই হিসাবে দেখতে চেয়েছিলেন। তিনি কিন্তু কোন উচ্চ নিচ এরম কথা বলেন নি। বৈদিক সমাজে অধিকাংশ ঋষি নিশ্চয় ব্রাহ্মণ ছিলেন । কিন্তু ব্রহ্মজ্ঞান সম্পন্ন , বিদ্যা সম্পন্ন ক্ষত্রিয় রা অনেকেই ঋষি ছিলেন এবং ক্ষত্রিয় রাজর্ষি পরবর্তীকালে অনেকের গুরু হয়েছেন ।
সে ক্ষেত্রে আমরা বলতে পারি বিশ্বামিত্রের কথা । যিনি নিজ গুন ও তপস্যা বলেই ব্রম্ভ জ্ঞান অর্জন করেছিল এবং ক্ষত্রিয় থেকে ব্রাহ্মনে রূপান্তরিত হতে সক্ষম হয়েছিলেন। শুধু তাই নয় থেকে বড় আশ্চর্যের বিষয় হল শূদ্র কিম্বা জারজ সত্বেও বৈদিক সমাজে ঋষিত্ব আটকানো যায়নি ।এর সব থেকে বড় উদাহরণ ছিল ঐলুষ কবষ।
সেকালে বৈদিক দের কাছে সরস্বতী নদীর মাহাত্ম্য ছিল সবচেয়ে বেশি । সরস্বতী নদীর তীরে এক সময় এক বিরাট যজ্ঞের আয়োজন হয়েছিল । সেই পবিত্র যোগ্য স্থল এর মাঝখানে ঐলুষপুত্র কবষ কে দেখতে পেয়ে অন্য ঋষিগন ( আমি আবারও বলছি #ঋষি , সেকালে যে কেউ ব্রহ্ম জ্ঞান অর্জন করে ঋষি হতেন। কিন্তু সেই মার্গ ছিল বড় কঠিন এবং অর্জন করতে হত ) বললেন – এই ব্যাটা দাসীপুত্র বেজন্মা কবজ। এর খুব সাহস দেখছি ?
এই বলে সেই পবিত্র স্থান থেকে তাড়িয়ে দিয়ে বললেন, তোকে এই এলাকার মধ্যে যেন না দেখি। এই সরস্বতী নদীর জল তুই খাবি না ছুঁবি না ।
কবষ ঐলুষ বিতাড়িত হলেন এক জলহীন দেশে । পিপাসায় আর্ত হলেন । মনে তার ক্ষোভ । অহংকারী ঋষিগণ তাকে তাড়িয়ে দিয়েছে । ঋষিরা তার সঙ্গে একত্র বসে পান ভজনও করবেন না বলেছেন।
সেই ক্ষোভ, সেই আকুতি থেকে তার জিহ্বায় জন্ম নিল অপূর্ব বৈদিক মন্ত্র। সরস্বতী ঢেউ তোলা জল বৈদিক ছন্দে বাঁধা পড়ল কবষ ঐলুষ এর কন্ঠে । আর সঙ্গে সঙ্গে সরস্বতী নদীর পবিত্র জলধারা তার চারিদিক দিয়ে বইয়ে দিতে লাগল কবষের উচ্ছ্বাসের সঙ্গে তাল রেখে ।
অহংকারী ঋষিদের মাথা নুইয়ে গেল। যাকে তারা এতদিন হেলাফেলা করে তাড়িয়ে দিয়েছেন, যাকে পিপাসার্ত হয়ে মেরে ফেলার জন্য কোন এক জলহীন দেশে স্থান নির্দেশ করেছেন, সেই ঐলুষ কবষ ,তাদের ভাষায় বেজন্মা জারজ দাসীপুত্র , সেই সরস্বতী মন্ত্র দর্শন করেছেন ।
ঋষিগন সমবেত হয়ে তাঁর কাছে এসে তাকে ঋষি বলে সম্বোধন করলেন। বললেন , প্রণাম ঋষি ! রাগ করবেন না আমাদের ওপর। নমস্তে অস্তু মা নো হিংসি।
আমাদের মধ্যে আপনি শ্রেষ্ঠ । নইলে যে সরস্বতী জল থেকে আপনাকে তাড়িয়ে দিয়েছি সেই স্বরস্বতী আপনাকে অনুগমন করছেন – ত্বয়ং বৈ নঃ শ্রেষ্ঠ সি যং ত্বেইমনেতি।
কবষ এর উদাহরণ থেকেই আমাদের আরো মনে হয় মন্ত্র দর্শন করার মানে নতুন করে শ্লোকের জন্ম । সেই শ্লোককের জন্ম রামায়ণের বাল্মিকী করেছিলেন। শ্লোক উচ্চারণ করে বাল্মিকী চমকে উঠেছিলেন – এ আমার মুখ দিয়ে কি বেরোলো। বাল্মিকী ঋষি হয়েছিলেন।
ঋগ্বেদে এমন একটি ঋক্ আছে যা থেকে তৎকালীন প্রধান নদী গুলির স্থান নির্ণয় করা সম্ভব হয়। ১০ ম মন্ডলের ৭৫ সূক্তে ৯ টি ঋকে উত্তর ও পশ্চিম ভারতের সবগুলি নদীর পরিচয় প্রদান করা আছে। ঋগ্বেদে সিন্ধু নদীর কথা বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। হ্যাঁ ,বেদে সিন্ধু মা, সিন্ধু নদী এবং কোনো ভাবেই নদ নয়। তবে সিন্ধুকে দেবত্ব প্রদান করা হয় নি। সেখানে সিন্ধু মহা বেগবতী , সরল রেখা বরাবর, স্থূলকায়া রমণীর ন্যায় চতুর্দিক পূর্ণ করে চলেছেন।
সরস্বতী, গঙ্গা ,যমুনা , শতদ্রু এমন ভাবে নদী গুলি বেদে সাজানো যে ভৌগলিক অবস্থান বুঝতে একটুও অসুবিধা হয় না ।
১০ ম মন্ডলের ১৭ সূক্তের ৭ থেকে ৯ ঋকে দেবী সরস্বতীকে আহ্বান করেছেন যজ্ঞকারীগণ। একটু সহজ করে বলি। যাঁরা যজ্ঞ করেন , তাঁরা দেবী সরস্বতীকে আহ্বান করছেন । সরস্বতী যেন তাঁদের অভীষ্ট পূর্ণ করেন । হে মা সরস্বতী , তুমি পিতৃলোকের সঙ্গে যজ্ঞের সকল বস্তুকে ভোগ করো। আমাদের আরোগ্য এবং অন্নদান করো। তুমি পিতৃলোকের দক্ষিণ দিকে বসো । যজ্ঞকর্তাকে অন্ন ও অর্থ দান করো।
এসব ঋকের মধ্যে নদীমাতৃকা সরস্বতীর অবস্থান সেই যুগে খুব স্পষ্ট করে উপলব্ধি করা যায়। কেমন করে নদীটি সকলের মনে এক মঙ্গলময়ী স্থান নিয়েছিলেন সে কথাও জানা যায় । আরো অনেক জায়গায় সরস্বতীর উল্লেখ আছে। ঋক্ সংখ্যাগুলির উল্লেখ করে তার সংক্ষিপ্ত কিছু পরিচয় দিলাম।
৭ ম মন্ডল ৩৬ সূক্ত, ৬ ঋক্ বলছেন – সপ্ত মাতৃকা স্থানীয় সরস্বতী নদী এবং সিন্ধুমাতা তাঁদের সুধারা নিয়ে আসুন।
১০ ম মন্ডল , ৬৪ সূক্ত, ৯ ঋক্ বলছেন – সরস্বতী , সিন্ধু ও সরযূ মহাশক্তিশালী নদী। জননীর ন্যায় তাঁরা ঘৃত ,মধুর মতো জল প্রদান করছেন। প্রসঙ্গত , এই সরযূ নদী সিন্ধুর একটি শাখা নদী।
৬ মন্ডল , ৫২ সূক্ত, ৬ ঋক্ বলছেন – জল দ্বারা স্ফীত সরস্বতী যেন আমাদের রক্ষা করার জন্য আসেন।
১০ মন্ডল, ৩০ সূক্ত, ১২ ঋক্ – হে জলগণ , আপনারা অমৃত আনুন, যজ্ঞে সাহায্য করুন, সরস্বতী স্তবকর্তাকে অন্নদান করুন।
বলতে গেলে প্রায় সমগ্র বেদ জুড়ে ( ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ ও অথর্ববেদ ) সরস্বতীর উপাসনার কথা উল্লেখ আছে নানা শ্লোকে। কেবল সরস্বতীই নয় সরস্বতী সমেত সপ্ত নদী মাতৃকার উপাসনার কথাও উল্লেখ আছে। যেমন – সুদাস এবং দশরাজার যুদ্ধের সময় এই সপ্তনদী মাতৃকার উপাসনা করা হয়েছে । সে ভারী সুন্দর বর্ণনা আছে –
দশ রাজার দল অর্থাৎ, পুরু, যদু, দ্রুহ্য প্রমুখরা শতদ্রু বিপাশার বেলাভূমিতে উপনীত হয়েছেন, আর বিশ্বামিত্র
এই দুই নদীর কবিকল্প স্থাপন করেছেন , তা ভাবলে আশ্চর্য হতে হয়। সেখানে বলেছেন –
জলপ্রবাহবতী বিপাশা আর শুতুদ্রু ! আপনারা কেমন জন্ম নিয়ে সাগর সঙ্গমের অভিলাষে লাগাম ছাড়া ঘোটকীর মতো, বৎসলেহনাভিলাষিণী গাভীর মতো ছুটে চলেছেন –
প্র পর্বতানামুশতী উপস্থাদশ্বে ইব বিষিতে হাসমানে।
ঋষি বিশ্বামিত্র বহু স্তব করে নদী মাতৃকাগণকে বলছেন –
আমি ভূ দূর হতে রথ , অশ্ব ইত্যাদি নিয়ে এসেছি। আপনারা আমার আপনজন। তাই আপনারা একটু বেগ কমিয়ে নিচু হয়ে বও। আপনাদের বিপুলা স্রোত যেন কিছু সময়ের জন্য আমাদের রথের নীচে দিয়ে প্রবাহিত হয়। আমরা যেন আপনাদের অতিক্রম করতে পারি।
নি ষূ নমধ্বং ভবতা সুপারা অধো অক্ষাঃ সিন্ধবঃ স্রোত্যাভিঃ।
সেই স্তবে বিপাশা এবং শতদ্রু নদী সন্তুষ্ট হয়ে বিশ্বামিত্রকে বললেন , ” মাতা যেরূপ আপনা সন্তানকে ভালোবাসার জন্য অবনত হন আমরাও তেমন নিচু হলাম। “
নি তে নংসৈ পীপ্যানেব যোষা মর্যাষেব কন্যা শশ্বচৈ তে।
এরপর বিশ্বামিত্র দেখলেন তাঁর আরাধনায় তুষ্ট দুই নদী কিয়দ্ কালের জন্য ক্ষীন ধারায় প্রবাহমানা হলেন। বিশ্বামিত্র বললেন , ভরত গোষ্ঠীর রাজারা আপনাদের উপর দিয়ে অতিক্রম করবেন । আপনারা তাই আমাদের চির পূজ্য হয়ে থাকবেন। তিনি ও বিপ্রগণ পুনরায় স্তবস্তুতি করলেন –
অতারির্ষুভরতা গব্যবঃ সমভক্ত বিপ্রঃ সুমতিং নদীনাম্।
মনুসংহিতা, মহাভারত সকল গ্রন্থে নদীমাতৃকা দেবী সরস্বতী স্বমহিমায় অবস্থান করছেন। বেদে আরব সাগর সিন্ধু সাগর নামে পরিচিত ছিল। সেই সুপ্রাচীন জম্বুদ্বীপ হতে কত হাজার হাজার হাজার বৎসর আমরা পেরিয়ে এসেছি। পেরিয়ে এসেছি সেই সময়ের নদী গুলির গতিপ্রকৃতি।
বেদে ৫০০০০ বৎসর পূর্বেরও সময়কালের সরস্বতীর সময়ের বর্ণনা পাওয়া যাচ্ছে সেখানে। বেদে দেবাসুর যুদ্ধের উল্লেখ করার সময় বলা হয়েছে , ” অগ্নি দ্বারা সমস্ত পর্বতাদি শিহরিত হচ্ছে….” ; অর্থাৎ , কোনো আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত এবং ভূমিকম্পের ইঙ্গিত করা হয়েছে। সিরমুর অঞ্চলে এমন ঘটনা ঘটেছিল বলে জানা যায়।
প্রমাণিত হয়েছে যে , দশহাজার বৎসর পূর্বে যে সকল স্থান দিয়ে সরস্বতী প্রবাহিতা হতেন সে সকল স্থান শস্য শ্যামলা ছিল। কয়েক হাজার বছর ধরে সরস্বতী কুলে মানব বসতি গড়ে উঠেছিল। গড়ে উঠেছিল সরস্বতী সভ্যতা। নগর, বন্দর ,শহর ,গ্রাম …. সে ছিল নদী মাতৃকা দেবী সরস্বতীর এক গৌরবময় অধ্যায়। যেসব ,নগর ,গ্রাম , বন্দরাদি প্রত্নতাত্ত্বিক খননের ফলে আজ আবিষ্কার হয় তার চেহারা থেকে প্রমাণিত হয় যে সরস্বতী সভ্যতার মানুষ ছিলেন অধিক প্রাজ্ঞ , বিদ্যায় ও বুদ্ধিতে উন্নত। তাই দেবী সরস্বতী হলে বিদ্যা ,বুদ্ধি, প্রজ্ঞা এবং তৎসহ সম্পদেরও দেবী।
সারস্বত সমভূমি ছিল অতি ঊর্বরা। কৃষিজ সম্পদে পরিপূর্ণ। এই কারণে সরস্বতী একসময় কৃষিদেবী হিসাবে পূজিত হয়েছেন। মেয়েরা “সারস্বতব্রত” পালন করতেন উত্তম ফসল প্রাপ্তির আশায়। আবার সরস্বতী আরোগ্য শুশ্রুষা অর্থাৎ ওষধি দেবী, শুক্লাযজুর্বেদে তার উল্লেখ আছে।
একদশ শতকে রচিত কথাসরিৎসাগর গ্রন্থ থেকে জানা যায় পাটুলীপুত্রের নাগরিকরা রুগ্নব্যক্তির চিকিৎসার জন্য যে ঔষধ ব্যবহার করতেন তার নাম ছিল সারস্বত। দেবীর সঙ্গে চিকিৎসাশাস্ত্রের এখনো যোগ লক্ষ্য করা যায়। পূজার উপকরণে বাসক ফুল ও যবের শিষ, আম্রমুকুল প্রদানে। আয়ুর্বেদে এগুলির ভেষজ মূল্য অপরিসীম।
কাজেই এক উন্নত সভ্যতার প্রাণকেন্দ্র হয়ে উঠেছিল সরস্বতী নদী। সেখানে গড়ে উঠেছিল লতাকুঞ্জে ঘেরা সারস্বত তপোবন। ঋষিরা সেখানে বেদপাঠ করতেন। সূচনা ও সমাপ্তিতে করতেন সরস্বতীনদীর বন্দনা। রচনা করতেন বৈদিক সূক্ত। মহাজাগতিক ভাবরসে পুষ্ট মন্ত্রগাথা। কালক্রমে নদী হয়ে গেলেন বিদ্যার দেবী। বেদের দেবী। একসময় অভিনয়ের দেবী হিসাবেও সরস্বতী পূজিত হতেন। তৎকালীন রঙ্গমঞ্চের সাধারণ নাম ছিল সারস্বতভবন।
তরুণশকলমিন্দোর্বিভ্রতী শুভ্রকান্তিঃ
কুচভরনমিতাঙ্গী সন্নিষন্না সিতাব্জে ।
নিজকরকমলোদ্যল্লেখনীপুস্তকশ্রীঃ
সকলবিভবসিন্ধ্যৈ পাতু বাগদেবতা নঃ ।।
অর্থাৎ, চন্দ্রের তরুণ অংশের ন্যায় যাঁর কান্তি শুভ্র, যিনি কুচভরে অবনতাঙ্গী, যিনি শ্বেত পদ্মাস্থনা , যাঁর নিজ কর কমলে উদ্যত লেখনী ও পুস্তক শোভিত , সকল ঐশ্বর্য সিদ্ধির নিমিত্ত সেই বাগদেবী আমাদিগকে রক্ষা করুন ।
বেদে সরস্বতী নদী জ্যোতিরূপে বর্ণনা করা হয়েছে। সরস্বতী নদীর তীরে বসে যে বৈদিক মন্ত্র উচ্চারিত হোতো- সেটা লেখা আছে । বেদের সরস্বতীর ত্রয়ী মূর্তি। ভূঃ বা ভূলোকে ইলা, ভুবঃ বা অন্তরীক্ষে লোক সরস্বতী, এবং স্বর্ বা স্বর্গলোকে ভারতী। ভূ র্ভুবঃ স্বঃ – এই তিনে মিলে সামগ্রিক জগত । ভূলোকে অগ্নি, অন্তরীক্ষ লোকে হিরণ্য দ্যুতি ইন্দ্র এবং স্ব- লোকে সূর্য – এই তিনের যে জ্যোতি রাশি – তাঁহা সরস্বতীর জ্যোতি। জ্ঞানময়ী বা চিন্ময়ী রূপে তিনি সর্বত্র , সর্ব ব্যাপিনী। তাঁর জ্যোতি সর্বত্র পরিব্যাপ্ত । শুধু এই ত্রিলোক নয় ঊর্ধ্ব সপ্ত লোক নিম্ন সপ্ত লোক পর্যন্ত চতুর্দশ ভুবনে স্তরে স্তরে সেই জ্যোতি বিরাজিতা। সেই জ্যোতি অজ্ঞান রূপী তমসা কে নিবারন করে। যোগী হৃদয়ে যখন সেই আলো জ্বলে – তখন সকল প্রকার অন্ধকার নাশ হয়।
জীবনে যত পূজা
হল না সারা,
জানি হে জানি তাও
হয় নি হারা।
যে ফুল না ফুটিতে
ঝরেছে ধরণীতে,
যে নদী মরুপথে
হারালো ধারা,
জানি হে জানি তাও
হয় নি হারা।
ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে আজও দেবী সরস্বতীর নাড়ির টান অটুট। তিনি কেবল বিদ্যার দেবী ছিলেন না। তিনি আদি পরাশক্তির এক অনন্য রূপ। তিনি বিদ্যা ,প্রজ্ঞা ও বুদ্ধি রূপে নিরাকারে সর্বত্র আজও বিরাজমান । তাই তাঁকে ডাকলেও আসেন না ডাকলেও আসেন, যেথায় তিনি শ্রদ্ধা পান। তিনি দনুজদলনী দেবী। সমগ্র কাশ্মীর জুড়ে তিনি শক্তি রূপে উপাসিতা হতেন। তিনি জটামুকুট ধারিনী। তাই আজও মন্ত্র উচ্চারিত হয় – ভদ্রকাল্যৈ নমো নিত্যং সরস্বত্যৈ নমো নমঃ ।
বেদ –বেদাঙ্গ বেদান্তবিদ্যাস্থানেভ্য এব চ ।।
জীবনে আজো যাহা
রয়েছে পিছে,
জানি হে জানি তাও
হয় নি মিছে।
আমার অনাগত
আমার অনাহত
তোমার বীণা-তারে
বাজিছে তারা–
জানি হে জানি তাও
হয় নি হারা।
#সমাপ্ত
©দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ ১) লুপ্ত সরস্বতী
২) প্রাচীন ভারতের পরিবেশ চিন্তা