পিতৃস্মৃতি : অনিত বসু পাফের চোখে

 “প্রকৃত অর্থেই বাবা ছিলেন কমিউনিস্ট। জাত-পাত বা সাম্প্রদায়িকতার অনেক উর্দ্ধে তাঁর অবস্থান। যে সময়টায় উপমহাদেশের রাজনীতিতে ধর্ম হয়ে উঠেছিল অন্যতম প্রধান বিবেচ্য বিষয়, সেই জটিল পরিস্থিতিতে বাবা দেশের স্বাধীনতাকামী সবাইকে সাদরে কাছে ডেকে নিয়েছিলেন। হিন্দু না মুসলিম— এ প্রশ্ন করেননি কোনও পরিস্থিতিতে। এতকাল আগের এই উদারতার মর্ম আজ উপলব্ধি করা সত্যিই কষ্টকর। 
পিতৃস্মৃতির কথা বলছিলেন অনিতা। অবিভক্ত বাংলার তথা অবিভক্ত ভারতবর্ষের মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানী নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর একমাত্র কন্যা অনিত বসু পাফ। অষ্ট্রিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তিনটি নামী প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনার পর বেশ ক‘বছর শিক্ষকতা করেছেন মিশিগান, ডেট্রয়েটে ওয়েন স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৭১ সালে আউগসবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন অর্থনীতির অধ্যাপিকা হিসাবে। ডজনখানেক সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের বিশেষজ্ঞ বা পরামর্শদাতা হিসাবে জড়িত ছিলেন। এখন বয়স ৭৯। 
আউগসবুর্গে তাঁর সুদৃশ্য বাড়িতে সাক্ষাৎকারে অনিতা বলেছিলেন অনেক কথা। বছরখানেক ব্যবধানে দ্বিতীয় দেখা পেলাম জার্মানির বন-এ ভারতীয় দূতাবাসে ও জার্মান ভারত সংস্থার (ডয়েটশে ইন্ডিশে গেডালশাফট) ডাকা এক উচ্চপর্যায়ের সম্মেলনে। আজাদ হিন্দ ফৌজ (আইএনএ)-র বর্ষপূর্তি উপলক্ষে ডাকা ওই সম্মেলনে তিনি গিয়েছিলেন স্বামী মার্টিনকে নিয়ে। মার্টিনও একজন ভারতপ্রেমী, জার্মানির প্রভাবশালী দল এসপিডি-র দাপুটে নেতা। 
সুভাষচন্দ্র বা তাঁর অসাধারণ দেশপ্রেমী, বিদ্রোহী চরিত্র, অপরিসীম আত্মত্যাগ নিয়ে আজ পর্যন্ত যত লেখালেখি হয়েছে, সমগ্র উপমহাদেশে অন্য যে কারও ক্ষেত্রে তার তুলনা পাওয়া ভার। অনিতা নিজে ওই প্রতিবাদ বা হামলার নিন্দা করেননি। সমর্থন অবশ্যই করেননি। বুঝেছেন, আবেগতাড়িত কিছু লোককে দিয়ে রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধি করতে চেয়েছেন কিছু অতি বুদ্ধিমান লোক। 
তিনি যে আদপেই আবেগতাড়িত নন, এই প্রতিবেদককে অনিতা তা স্পষ্ট জানিয়েছেন। জিজ্ঞাসা করেছিলাম, বিমান দুর্ঘটনায় সুভাষচন্দ্রের মৃত্যুর বিষয়টি নিছকই কি অপপ্রচার? তাঁর মতে, তথাকথিত দুর্ঘটনাটি এমন একটা ডামাডোলের সময়ে হয়েছিল, যখন জাপানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ পর্যায় চলছে। ঠিক পরদিন মার্কিন ফৌজ হানা দিল উত্তর তাইওয়ানে। আমি এ সম্পর্কে অনেকের সঙ্গে কথা বলেছি। কোনও স্থির সিদ্ধান্তে আসতে পারিনি। আমার মা, বা কাকা-সহ অনেকে ওই দুর্ঘটনায় বাবার মৃত্যুর খবর মেনে নিতে পারেননি। তাঁদের ধারণার সঙ্গে আবেগ মিশে থাকতে পারে। নেতাজির তথাকথিত শেষ সময়টা নিয়ে নানারকম গুজবের কথাও শোনা গিয়েছে। কোনওটির সত্যতা প্রতিষ্ঠিত করার যথেষ্ঠ প্রমাণ আমি পাইনি।“
অনেকের ধারণা, সুভাষচন্দ্রের জীবনের শেষ সময়টা কেটেছে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের এক কারাগারে। মিত্রশক্তির অন্যতম শরিক ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। কিন্তু সে দেশে রাজনৈতিক পালাবদলের পর সত্যি কি এই রহস্য উদ্ঘাটনের ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়া যেত না? উত্তরে অনিতা জানান, “রুশ সরকার যদি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সংক্রান্ত দলিল মহাফেজখানা থেকে বার করে সমীক্ষা করাতে পারেন, তাহলে এ বিষয়ে কিছু তথ্য মিলতে পারে। এ ব্যাপারে ভারত সরকারের অবকাশ ছিল রুশ সরকারের সঙ্গে আন্তরিকভাবে কথা বলার। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, ভারত সরকারের এ ব্যাপারে উদ্যোগী হওয়া উচিত ছিল।”
কাজটা যে খুব একটা সহজ নয়, এ কথাও জানিয়েছিলেন অনিতা। তাঁর কথায়, ভারত সরকার এতকাল বাদে কেন এ নিয়ে উদ্যোগী হবে? তাঁদের স্বার্থ কোথায়? রুশ ভাষা ভাল জানেন এমন কোনও সুভাষপ্রেমীকে সেখানে গবেষণার জন্য পাঠাতে হত।“ নেতাজির সংগ্রামী জীবনে জার্মানির ভূমিকার কথা নানা সময়ে অনেকে লিখেছেন। সুভাষচন্দ্রের জার্মানিতে আসার সময় এখানে এক আমলা ছিলেন আলেকজান্ডার রেথ। ‘নেতাজি ইন জার্মানি’ বইতে তিনি লিখেছেন, “অন এইটিন্থ মার্চ নাইন্টিন ফর্টিওয়ান, নেতাজি কন্টিনিউড অন হিজ রুট টু মস্কো ভায়া বোখরা অ্যান্ড সমরখন্দ। নেতাজি লেফট মস্কো বাই প্লেন অন মার্চ টোয়েন্টিএইট, নাইন্টিন ফর্টিওয়ান। দি সোভিয়েত ইউনিয়ন ডিড নট হিন্ডার নেতাজি ক্রশিং হার টেরিটরি অন হিজ ওয়ে টু বার্লিন, হোয়ার হি এরাইভ্ড এপ্রিল নাইন্টিন ফর্টিওয়ান।“
বইটিতে তিনি জার্মানিতে সুভাষচন্দ্রের কর্মকান্ডের অনেকটা লিখেছেন। এর আগে ১৯৬৯-এ তিনি নেতাজি ভবনে এনিয়ে বক্তৃতা দেন। আমি অনিতাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, হিটলারের সঙ্গে নেতাজির বন্ধুত্ব পাতানোর চেষ্টা নিয়ে নানারকম বিতর্ক হয়েছে। সে ব্যাপারে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গী কী? অনিতার কথায়, “দেখুন একটা কথা আগে অনেকবার অনেকভাবে বলেছি, হিটলারের সঙ্গে নেতাজির সম্পর্কটা ছিল নিছকই দেওয়া নেওয়ার (গিভ অ্যান্ড টেক)। সে সময় কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলারনীতিতে বিশ্বাস করেছিলেন বাবা। অর্থাৎ তিনি মনে করতেন, শত্রুর শত্রু আমার মিত্র। তিনি কখনও জার্মান শাসকদের সঙ্গে আত্মিক সম্পর্ক তৈরি করতে চাননি। তিনি ছিলেন পুরোদস্তুর বামপন্থী এবং সমাজতন্ত্রী, কোনওভাবে ফাসিস্ত বা নাৎসি নন। তিনি ছিলেন প্রকৃত অর্থেই একজন দেশপ্রেমিক, একজন জাতীয়তাবাদী নেতা। বিচ্ছিন্নতাবাদী নন।“
অনিতার কথায়, “জার্মানির সঙ্গে ভারতের একটা দীর্ঘচালের সাংস্কৃতিক যোগসূত্র ছিল। একসময়ে জার্মান শাসকরা ভেবেছিলেন, আফ্রিকার যুদ্ধে জিতে সেখান থেকে ব্রিটিশদের ওপর আক্রমণ হানবে। যাতে জার্মানদের জয় অনিবার্য হয়। শেষ পর্যন্ত ওই আক্রমণ আর হয়নি। হলে ইংরেজরা অবশ্যই চরম বিপাকে পড়ত। হয়ত ইতিহাস লেখা হত অন্যভাবে।” 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.