৭ মার্চের মধ্যে বিধানসভা নির্বাচনের দিন ঘোষণা হতে পারে, বলেছেন প্রধানমন্ত্রী

গতবারের (২০১৬) বিধানসভা নির্বাচনের নির্ঘণ্ট সম্ভবত ৪ মার্চ ঘোষিত হয়েছিল। সে অনুযায়ী এবারও সম্ভবত মার্চের প্রথম সপ্তাহ অর্থাৎ ৭ মার্চের মধ্যে বিধানসভা নির্বাচনের দিন ঘোষণা হতে পারে। এর আগে যতবার সম্ভব অসম, পশ্চিমবঙ্গ, পুদুচেরি, কেরল, তামিলনাড়ু সফর করে সংশ্লিষ্ট রাজ্যের জনসাধারণের কাছে যাবেন তিনি। বক্তা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।
সোমবার উজান অসমের ধেমাজি জেলার অন্তর্গত শিলাপথারের শীতলবাড়ি (কুলাজান পিয়াংচাপরি) ময়দানে প্রায় তিন লক্ষাধিক জনতার সমাবেশে ভাষণ দিচ্ছিলেন প্রধানমন্ত্রী। কুলাজান পিয়াংচাপরি ময়দানের সভামঞ্চ থেকে বোতাম টিপে ৩,২০৪ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত অসম পেট্রোলিয়াম ক্ষেত্রের তিনটি প্রকল্প যেমন ইন্ডিয়ান অয়েলের বঙাইগাঁও শোধনাগারে ‘ইন্ডম্যাক্স’ (আইএনডিএমএএক্স) ইউনিট (২,৫৮২ টাকায় নির্মিত রন্ধন গ্যাসের উৎপাদন ক্ষমতা বার্ষিক ৫০ হাজার মেট্রিকটন; পেট্ৰোল উৎপাদনের ক্ষমতা বার্ষিক ২১০ হাজার থেকে ৫২২ হাজার মেট্রিকটন), ডিব্রুগড়ের মধুবনে ভারতীয় তেল নিগমের সেকেন্ডারি ট্যাংক ফার্ম (৪৯০ কোটি টাকা ব্যয়ে তৈরি) এবং তিনিসুকিয়ার মাকুমে হেবেদাগাঁওয়ে নির্মিত গ্যাস কম্প্রেস স্টেশনটি (১৩২ কোটি টাকায় নির্মিত) দেশবাসীর নামে উৎসর্গ করার পাশাপাশি ধেমাজি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের শুভ উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী। এছাড়া কামরূপ গ্রামীণ জেলার শুয়ালকুচিতে প্রস্তাবিত ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের শিলান্যাস করেছেন তিনি। 
অসমিয়া ভাষায় ভাষণ শুরু করে প্ৰধানমন্ত্ৰী নরেন্দ্র মোদী বলেন, তৃতীয়বারের মতো ধেমাজিতে এসে তিনি নিজেকে সৌভাগ্যশালী বলে অনুভব করছেন। অকাল দীপাবলির মাধ্যমে ধেমাজিবাসী গতরাতেই তাঁকে আগাম স্বাগত জানানোয় তিনি আপ্লুত। অসমবাসীর আত্মীয়তাবোধ এবং আতিথেয়তায় তিনি অভিভূত। এখানকার জনতার আশীর্বাদ তাঁকে অসম সহ উত্তরপূর্বের জন্য কিছু করার জন্য অনুপ্রাণিত করে। ভাষণ দিতে গিয়ে প্ৰধানমন্ত্ৰী বলেন, ‘আগে দশকের পর দশক দেশে যাঁরা রাজত্ব করেছেন, তাঁদের কাছে প্ৰচুর সম্ভাবনাময় এই অসম বহু দূরে ছিল। পূৰ্বতন সরকারগুলো ব্ৰহ্মপুত্ৰের উত্তর পারের অসমকে মা-মাসির নজরে দেখত। কিন্তু বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর খোদ দিল্লিই চলে আসে অসমের ঘরে ঘরে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা বারবার এখানে আসেন। এসে এখানকার উন্নয়নে পরিকল্পনা তৈরি করছেন। আমিও বহুবার অসমে এসে আপনাদের উন্নয়নের অংশীদার হওয়ার চেষ্টা করছি।’ তাঁর সরকার সব ধরনের ভেদাভেদ দূর করে দিয়েছে। প্রসঙ্গক্রমে তিনি আত্মনিৰ্ভর ভারতকে গতিশীল করতে দেশের বিজ্ঞানী, ইঞ্জিনিয়ার, টেকনিশিয়ান প্রমুখকে ধন্যবাদ জানান। তাঁর দাবি, আত্মনির্ভর অসম গড়ার ক্ষেত্রে রাজ্যের জনতা যে ভাবে সহায়তা করছেন তাতে আত্মনির্ভর ভারত গড়তে বেশিদিন সময় লাগবে না। 
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি যখন ভারতীয় কৃষি ইনস্টিটিউট উদ্বোধন করতে গোগামুখ এসেছিলাম, তখন বলেছিলাম, উত্তর-পূর্বাঞ্চল দেশের জন্য উন্নয়নের ইঞ্জিন হবে। ডাবল ইঞ্জিনের সরকার অসমকে উন্নয়নের আরও শিখরে নিয়ে যাবে।’ তিনি বলেন, ‘‘আজ থেকে আট দশক আগে ‘জয়মতী’ নামে ছায়াছবির মাধ্যমে অসমিয়া চলচ্চিত্রের যাত্রা শুরু হয়েছিল এই ধেমাজি থেকে। এই অঞ্চল রূপকোঁওর জ্যোতিপ্রসাদ আগরওয়ালা, কলাগুরু বিষ্ণুপ্রসাদ রাভা এবং নটসূর্য ফণী শর্মার মতো কয়েকজন মহান ব্যক্তিত্বকে জন্ম দিয়েছে, যা অসমের জনগণকে গর্বিত করেছে।’ ভারতরত্ন ভূপেন হাজারিকার লেখা কবিতা তথা গানের উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ব্রহ্মপুত্রের উভয় পাড় প্রজ্বলিত প্রদীপ এইসব অঞ্চলকে আলোকিত করবে। স্থানীয় লোকজন গতরাতে কয়েক হাজার প্রদীপ জ্বালিয়ে দীপাবলি উদযাপন করেছেন। এটা অসমের শান্তি ও প্রগতির উদাহরণ।’ 
অসম সরকার রাজ্যের সুষম উন্নয়নে নিয়োজিত। সে প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘প্রচুর সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও ব্রহ্মপুত্রের উত্তরাঞ্চলের উন্নয়নে পূর্ববর্তী সরকারগুলি উদাসীন ছিল। এখানে যোগাযোগ, হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শিল্প ইত্যাদি জনতার প্রথমিক মৌলিক অধিকারের ক্ষেত্রগুলি পূর্ববর্তী শাসকদের নজরেই ছিল না। কেন্দ্রে আমার এবং রাজ্যের সনোয়াল সরকার সাব-কা সাথ, সাব-কা বিকাশ, সব-কা বিশ্বাসের মন্ত্র শিরোধার্য করে দিবারাত্র কাজ করছে। আমার এবং সর্বানন্দ সরকার জনসাধারণের বছরের পর বছরের বহুকাঙ্ক্ষিত বগিবিলের কাজ খুব কমদিনের মধ্যে সম্পূর্ণ করে জাতির উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করতে সক্ষম হয়েছে।’ আরও বলেন, ‘আমাদের সরকার ক্ষমতায় আসার পর এখানে ব্রডগেজ পৌঁছেছে। কলিয়াভোমরা সেতু এখানকার যোগাযোগ ব্যবস্থাকে আরও উন্নত করবে। এই কাজও দ্রুত সম্পন্ন হচ্ছে। ফোরলেন রাস্তার কাজও দ্রুতগতিতে চলছে। মহাবাহু ব্রহ্মপুত্র দিয়ে জলপথে যোগাযোগ শুরু হয়েছে। বঙ্গাইগাঁওয়ের যোগিঘোপায় একটি লজিস্টিক পার্ক স্থাপন করা হয়েছে।’ 
মোদী বলেন, ‘এই সমস্ত প্রকল্প অসম এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মানুষের জীবনকে আরও সহজ ও সরল করে তুলবে। তরুণদের কর্মসংস্থান বাড়বে। যখন প্রাথমিক সুবিধা পাওয়া যায়, তখন আত্মবিশ্বাস বাড়ে। এই আত্মবিশ্বাসের সাথে সংশ্লিষ্ট অঞ্চল এবং দেশের উন্নয়নও ঘটে। আজ আমাদের সরকার সেই সকল জনতার কাছে পৌঁছনোর চেষ্টা করছে, যেখানে পূর্ববর্তী সরকারগুলি এতদিন পৌঁছয়নি। আমরা সকলের সুবিধার লক্ষ্যে জোর দিচ্ছি।’ তিনি বলেন, ‘২০১৪ সালের আগে দেশে প্রতি ১০০টি পরিবারের মধ্যে কেবল ৫০/৫৫ পরিবারে এলপিজি (রান্নার গ্যাস) সংযোগ ছিল। অসমে শোধনাগার এবং সর্বসুবিধা থাকা সত্ত্বেও প্রতি ১০০ পরিবারের মধ্যে মাত্র ৪০ পরিবারের গ্যাস সংযোগ ছিল। দরিদ্র মানুষ তথা গৃহিণীরা রান্নাঘরের ধোঁয়ায় নানা রোগের কোপে পড়ে তার মধ্যেও কোনও রকম জীবনধারণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। এখন অসমে গ্যাস সংযোগ বেড়েছে প্রায় ১০০ শতাংশ। বঙ্গাইগাঁও রিফাইনারির আশপাশের জেলাগুলিতে তিনগুণেরও বেশি এলপিজি সংযোগ বেড়েছে। এবারের বাজেটে আরও এক কোটি বিনামূল্যে গ্যাস সংযোগ দেওয়ার প্রস্তাব রাখা হয়েছে।’ 
প্ৰধানমন্ত্ৰী বলেন, ‘আমাদের দেশে দরিদ্র ও ক্ষুদ্র কৃষকদের বিদ্যুৎ, গ্যাস, সার উৎপাদনের অভাবে লোকসান বহন করতে হয়েছিল। স্বাধীনতার পর বিদ্যুৎ ছিল না এমন ১৮,০০০ গ্রামের বেশিরভাগই অসমের। গ্যাসের অভাবে সার কারখানা বন্ধ ছিল। আমাদের সরকার পূর্বসুরিদের ভুলগুলি সংশোধন করছে।’ তিনি বলেন, আজ পূর্ব ভারতকে প্রধানমন্ত্রী উর্জা যোজনার আওতায় এনে গ্যাস পাইপলাইনে সংযুক্ত করা হচ্ছে। নীতি যদি সঠিক ও পরিষ্কার থাকে তা-হলে ভাগ্যের পরিবর্তন হয়। গ্যাস পাইপ, অপটিক্যাল ফাইবার, প্রতিটি বাড়িতে জল পৌঁছে দেওয়ার কাজ চলছে। এ সমস্ত বুনিয়াদি কাঠামো প্রস্তুত করা হচ্ছে। এতে সরাসরি সাধারণ মানুষ উপকৃত হচ্ছেন। 
নরেন্দ্র মোদী আরও বলেন, আত্মনির্ভর ভারতকে গোটা বিশ্ব দেখছে। ভারতের ইঞ্জিনিয়ার এবং টেকনোক্র্যাটদের ক্ষমতাকে স্বীকৃতি দিচ্ছে বিশ্ব। অসমের জনগণের সক্ষমতা অতুলনীয়। এখানে ২০টিরও বেশি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ রয়েছে। আরও তিনটি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ নির্মাণের প্রক্রিয়া চলছে। অসম সরকার দৃঢ়তার সঙ্গে কাজ করছে। রাজ্য সরকার এখানে নয়া জাতীয় শিক্ষানীতি শীঘ্র বাস্তবায়নের চেষ্টা করছে। এর ফলে উপজাতীয় সমাজ, চা বাগানের বাচ্চাদের ব্যাপক উপকার হবে। এতে স্থানীয় ভাষায় অধ্যয়ন এবং দক্ষতার উপর জোর দেওয়া হয়েছে। কেননা, যখন স্থানীয় ভাষায় চিকিৎসা গবেষণা, প্রযুক্তিগত পড়াশোনা হবে, তখন দরিদ্রতম দরিদ্র শিশুরাও ডাক্তার এবং ইঞ্জিনিয়ার হয়ে উঠবে। অসমের মতো একটি রাজ্য, যেখানে চা, পর্যটন, তাঁত ও হস্তশিল্প আত্মনির্ভরতার একটি প্রধান শক্তি। এখানকার যুবকরা যদি স্কুলে নিজেই এই দক্ষতা আয়ত্ত করেন তবে স্বনির্ভরতার ভিত্তি এখান থেকেই শুরু হবে। একলব্য বিদ্যালয়েরও সুবিধা পাবে অসম। 
তিনি বলেন, অসমের জমি খুব উর্বর। কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকার এখানে কৃষকদের আধুনিক সুযোগ সুবিধা প্রদানের জন্য একত্রে কাজ করছে। সরাসরি কৃষকদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অর্থ জমা, কৃষকদের জন্য অন্যান্য প্রকল্প, ভালো বীজ প্রদান, স্বাস্থ্যবিমা কার্ড প্রদানের মতো বহু জনহিতকর কাজ চলছে। রাজ্যের ক্ষুদ্র চা চাষিদের ভূমিপাট্টা প্রদানের জন্য সর্বানন্দ সরকারের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। 
মৎস্য ব্যবসার ওপর বিশেষ জোর দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এর জন্য ইতোমধ্যে একটি পৃথক মন্ত্রক গঠন করা হয়েছে। ‘স্বাধীনতার পর যা খরচ করা হয়নি, আমার সরকার এ ক্ষেত্রে বেশি ব্যয় করছে। বাজেটে মাছ উৎপাদনের জন্য ২০ হাজার কোটি টাকা ধার্য করা হয়েছে। এতে অসম পাবে বিপুল সুবিধা। বলেন, কৃষির সাথে সম্পর্কিত আইন সংস্কার করা হয়েছে। ফলে কৃষকরা বহুগুণে লাভান্বিত হবেন। এছাড়া বলেন, অসমের উন্নয়নে চা বাগানগুলির একটি বড় ভূমিকা রয়েছে। চা বাগানে যাঁরা কাজ করেন তাঁদের জীবনশৈলিকে বিকশিত করতে বহু পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। ক্ষুদ্র চা চাষিদের জমি ইজারা দেওয়ার কাজ আরও ভালো পদক্ষেপ। 
আজকের সমাবেশে অসমের বহু দফতরের মন্ত্রী হিমন্তবিশ্ব শর্মার স্বাগত ভাষণের পর বক্তব্য পেশ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সনোয়াল, পেট্রোলিয়াম মন্ত্রী ধর্মেন্দ্র প্রধান। সভামঞ্চে ছিলেন রাজ্যপাল আধ্যাপক জগদীশ মুখি, কেন্দ্রীয় খাদ্য সংসাধন দফতরের প্রতিমন্ত্রী রামেশ্বর তেলি, রাজ্যের কৃষিমন্ত্রী অতুল বরা, জলসম্পদ মন্ত্রী কেশব মহন্ত সহ কয়েকজন সাংসদ বিধায়ক। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.