ডাক্তারজী দেশভক্ত স্বয়ংসেবক, জ্যোতিবাবু ব্রিটিশভক্ত কমিউনিস্ট

এদেশের কমিউনিস্টরা অনেকটা ঝি ঝি পোকার মতো। কান ঝালাপালা করে দেওয়ার ক্ষেত্রে এদের জুড়ি পাওয়া যায় না। এরা ঐক্যতান ধরেছে যে, আর এস এস দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে কিছুই করেনি। এদের মধ্যে। যারা হঁচড়েপাকা এবং অশালীন ভাষা প্রয়োগে কুশলী, তারা এটাও বলেন, আর এস এস দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় ব্রিটিশদের পা চেটেছে, মুচলেকা দিয়েছে, ইত্যাদি।
আমি অত্যন্ত স্বল্প পরিসরে কমিউনিস্টদের নেতা জ্যোতিরিন্দ্র ওরফে। জ্যোতি বসু এবং আর এস এস-এর প্রতিষ্ঠাতা ডাঃ কেশব বলিরাম হেডগেওয়ারের বাল্যজীবন এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে তাদের অংশগ্রহণের উপর একটু তুলনামূলক আলোচনা করছি।
জ্যোতি বসুর জন্ম ১৯১৪ সালের ৮ জুলাই কলকাতার ৪৩/১ হ্যারিসন রোডের বাড়িতে। কিন্তু তিনি বড়ো হয়েছেন ৫৫এ হিন্দুস্থান রোডের বাড়িতে। পিতা লব্ধপ্রতিষ্ঠ ডাক্তার নিশিকান্ত বসুর ওটা সাধারণ বাড়ি নয়, বলতে গেলে এক পেল্লাই রাজপ্রসাদ। এক কথায় সোনার চামচ মুখে নিয়ে এই প্রবাদপ্রতিম কমিউনিস্ট নেতার জন্ম। তখন। দেশে ব্রিটিশ শাসন। কলকাতার লোরেটো স্কুল ব্রিটিশ রাজকর্মচারীদের ছেলে-মেয়েদের জন্য স্থাপিত। ভারতীয়দের মধ্যে যারা প্রভুভক্ত, তাদের ছেলে-মেয়েরা অবশ্য ব্রিটিশদের কৃপা পেত। এছাড়া, লরেটো হলো একটা কনভেন্ট, খ্রিস্টধর্ম সেখানে অবশ্য পাঠ্য ছিল। ভারতীয় সংস্কৃতি এবং দর্শন সেখানে বিষবৎ পরিত্যাজ্য। ১৯২০ সালে শিশু জ্যোতি ভর্তি হলেন সেই লোরেটো স্কুলে।
সাল ১৯২৫। জ্যোতি বড়ো হয়েছেন। ভর্তি হলেন সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলে। নাম দেখেই বুঝতে পারছেন যে সেটাও ব্রিটিশ রাজকর্মচারীদের ছেলে-মেয়েদের জন্য স্থাপিত। সবই লোরেটোর মতো। আজকের সেন্ট জেভিয়ার্সের সঙ্গে ভুলেও তুলনায় যাবেন না। এখন তো অতি সাধারণ মানুষের ছেলে-মেয়েরাও সেখানে পড়ে।
জ্যোতি আরও বড়ো হলেন। সাল ১৯৩৫। পাড়ি দিলেন লন্ডন। ১৯৩৯ সালের ব্যারিস্টার হলেন মিডল টেম্বল থেকে। পড়াশোনা চলাকালীন রজনী পাম দত্ত, হ্যারল্ড জে লাস্কি সমেত বাম ঘরানার রাজনৈতিক নেতাদের এবং তাদের কার্যকলাপের সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯৪০ সালের ১ জুলাই ভারতে প্রত্যাবর্তন করেন। বয়স তখন তার প্রায় ২৬ বছর।
এবার আমরা দেখে নেব এই ২৬ বছর বয়স পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবকসঙ্রে কেশব হেডগেওয়ারের জীবনের অংশ। ১৮৮৯ সালের নববর্ষের দিন যা ‘যুগাদি’ রূপে মহারাষ্ট্রে উদযাপিত হয়। সেই দিন নাগপুরের একব্রাহ্মণ পরিবারে কেশব জন্মগ্রহণ করেন। বাবা ছিলেন পুরোহিত। স্বাভাবিকভাবেই আর্থিক দিক থেকে অসচ্ছল, কিন্তু জন্মজাত দেশভক্ত। তার মতো ভাগ্যবান ক’জন?মাত্র আট বছর বয়সেই কেশব ইংল্যান্ডের রানি ভিক্টোরিয়ার সম্মানে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বিতরণ করা মিষ্টি ঘৃণাভরে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। সেটা ছিল ১৮৯৭ সাল।
কেশবের বয়স মাত্র ১২। সপ্তম এডোয়ার্ড রাজা হয়েছেন। ইংল্যান্ড এবং তার উপনিবেশগুলো জুড়ে চলছে উৎসবের জোয়ার। নাগপুরে তখন ইম্প্রেস মিল নামে একটি কারখানার উদ্যোগে রাজ্যাভিষেক পালন হচ্ছে। উৎসবের মুখ্য আকর্ষণ মিষ্টি বিতরণ। অথচ, এই বয়সেই বালক সঙ্গীদের নিয়ে দল তৈরি করলেন কেশব যাতে কোনো বালক সেই অনুষ্ঠানে না যায়। সেটা ১৯০১ সালের ঘটনা।
১৯০৫ সাল। কেশব তখন নিল সিটি হাইস্কুলের ছাত্র। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে সারা ভারতবর্ষ উত্তাল। দেশপ্রেমিকদের মুখে একটাই স্লোগান, ‘বন্দে মাতরম্। কেশব ছাত্রদের মধ্যে দেশপ্রেমের আগুন জ্বালানোর পুরোহিত হয়ে উঠলেন। স্কুলে পরিদর্শক এলেন স্কুল পরিদর্শনে। কিন্তু পরিদর্শক যে। বিদ্যালয় কক্ষে যান সেখানেই একটিই স্লোগান,… বন্দে মাতরম্। শাস্তি অনুমেয়। কেশব স্কুল থেকে বিতাড়িত হলেন।
কেশব এবার যাবেন কোথায় ? তার বাবার তো অগাধ টাকা নেই। সেসময় মহারাষ্ট্রের কিছু জাতীয়তাবাদী নেতা বিদর্ভের জেলা শহরে একটা বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন। নাম বিদ্যাগৃহ। বিদ্যাগৃহ নামটির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে ভারতীয় সংস্কৃতি এবং পরম্পরা। অতি আনন্দে কেশব সেই স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিলেন। কিন্তু ব্রিটিশদের নেকনজরে পড়ে এই স্কুল বন্ধ হয়ে গেল। দেশেপ্রেমের মূল্য কীভাবে কেশব দিয়েছেন, এর চেয়ে আর কী বড়ো প্রমাণ হতে পারে? অন্য একটি স্কুল থেকে পাশ করলেন।
বন্ধুদের সঙ্গে পুনে বেড়াতে গিয়ে জানলেন যে কলকাতায় ন্যাশনাল মেডিক্যাল স্কুল নামে একটি প্রতিষ্ঠান স্থাপতি হয়েছে। বঙ্গের জাতীয়তাবাদী নেতারা এর প্রতিষ্ঠাতা। ভর্তি হলেন সেখানে। সেখান থেকে ডাক্তারি পাশ করলেন। কে স্বাক্ষর করেছিলেন ওই সার্টিফিকেটে, জানেন? আমি জানি, আপনারা অনেকে জানেন না। না, না জ্যোতিবাবুর সার্টিফিকেটে যেমন রাজা-রানির সই আছে, তেমনটি নয়। ওই সার্টিফিকেটে স্বাক্ষর করেছিলেন বিপ্লবী ডাঃ রাসবিহারী ঘোষ। সালটা ছিল ১৯০৯। তখন কেশবের বয়স ২০ বছর। এসেছিলেন তো ডাক্তারি পড়তে। কিন্তু রক্তে যার রয়েছে জন্মজাত দেশপ্রেম, তাকে কি শিক্ষায়তনের নিগড় আটকে রাখতে পারে? গোপনে যোগ দিলেন অনুশীলন। সমিতিতে। তার ছদ্মনাম হলো ‘কোকেন। ব্রিটিশ পুলিশের চোখ এড়িয়ে কোকেন হয়ে। উঠলেন মহারাষ্ট্র এবং বঙ্গপ্রদেশের বিপ্লবীদের যোগসূত্র। ন্যাশনাল মেডিকেল স্কুল থেকে সসম্মানে ডাক্তারি পাশ করলেন। তার নাম হলো তখন ডাঃ কেশব বলিরাম হেডগেওয়ার। ফিরে এলেন নাগপুরে। তিনি তখন ২৫ বছরের তরুণ। কোটি কোটি দেশভক্তদের নয়নের মণি ডাক্তারজী।
অজয় সরকার

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.