জনশ্রুতি আছে সাহেব লর্ড ক্লাইভ বলেছিলেন, “পৃথিবীর সব থেকে পাপপূর্ণ জায়গাগুলির মধ্যে অন্যতম এই কলকেতা।” তা এই পাপের ঘড়ায় জল ঢালার নেপথ্যে কিন্তু তিনিও ছিলেন! এমন অনেকেই রয়েছেন, যাঁরা মদ্যপায়ীদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেন কিন্তু ব্যক্তিজীবনে দিনে নিদেন পক্ষে এক পাত্র চাইই চাই, কেউ কেউ আবার পাঁড় মাতাল। যেমন আমাদের ঈশ্বর গুপ্ত। সুরাপ্রেমী ‘ইয়াং বেঙ্গলি’দের কটাক্ষ করে তেড়ে ছড়া কাটতেন অথচ মদ্যপান করে তিনিও দিনের বেলা চাঁদ ধরতে চেষ্টা করতেন।
জোব চার্নক নাকি তাঁরই সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন হিল’কে কলকাতা‘র সর্বপ্রথম ‘পাঞ্চ হাউস’ খোলার অনুমতি দিয়েছিলেন। আর কলকাতার প্রথম পাঞ্চ-হাউসের ‘সরকারি’ লাইসেন্সের অধিকারী ছিলেন ডেনিঙ্গো অ্যাশ নামের এক মহিলা। তারপর এই শহরে গজিয়ে উঠতে শুরু করেছিল একের পর এক পাঞ্চ হাউস, আরও কয়েক দশক পর তার জায়গা নেয় ট্যাভার্ন বা সরাইখানা। ঠিকানা লালবাজার, বউবাজার, খিদিরপুর, ডেকার্স লেন, বেন্টিংক স্ট্রিট। পসরা সাজিয়েছিলেন ইংরেজ, ফরাসি, মার্কিন, ইতালিয়ান, স্প্যানিশ শুঁড়িরা। এইসব শুঁড়িখানায় চলত কাউন্সিল সদস্যদের মিটিং, কেচ্ছার গল্প, পরকীয়া, উদ্দাম নাচ, গান, মারামারি। এইসব তখনও বাঙালি ভদ্রসমাজে ‘কালচার’ হয়ে ওঠেনি, হল উনিশ শতকে। তৈরি হল ‘বাবু’ সম্প্রদায়। এই সময়ই ডালহৌসি চত্বর, ট্যাঙ্ক স্কোয়ারে গজিয়ে উঠেছিল ‘ছোটা ব্রিস্টল’ বা ‘শ ব্রাদার্স’ (Chhota Bristol or Shaw Brothers) নামের পানশালাটি, যা ১৫০টি বছর পেরিয়ে সময়ের স্মৃতি আজও বহন করে চলেছে। ১৮৭২ থেকে এর পথ-চলা শুরু।
ঋত্বিক ঘটককে হামেশাই পাওয়া যেত এখানকার একটি টেবিলে। কখনও তিনি বন্ধুদের সঙ্গে তুমুল তর্কাতর্কিতে ব্যস্ত থাকতেন, কখনও আবার হনহন করে হেঁটে বেরিয়ে যেতেন এবং কিছুক্ষণ পরেই ফিরে এসে কোনঠাসা হয়ে বসে পড়তেন এই পানশালায়। সবথেকে পুরোনো পানশালা হিসেবে পরিচিত ছোটা ব্রিস্টল (শ ব্রাদার্স) হল কলকাতার (Kolkata’s) বড়ো আবেগের সৃষ্টিশীল একটি আখড়া, তবে তা শুধুই সুরাপ্রেমীদের জন্য নয়, ব্রিটেনের পানশালাগুলির মতো এখানে অফিসিয়াল ক্লায়েন্ট মিটিং, বন্ধুদের নিছক আড্ডা এসবও চলে নিয়মিত। সুরার সঙ্গে এখনও পুরোনো দিনের গন্ধ ম ম করে এখানে।
এখানে।
আধুনিক ‘গ্ল্যামার’ নাই থাকতে পারে, কিন্তু কয়েক শতাব্দী ধরে পরিশ্রান্ত অফিসযাত্রী থেকে শুরু করে, কলেজ পড়ুয়া, সংগ্রামী কবি-সাহিত্যিক সকলকেই পরিষেবা দিয়ে চলেছে ‘ছোটা ব্রিস্টল (শ ব্রাদার্স)’।
এসপ্ল্যানেডের মেট্রো গলির ভিতরে অবস্থিত এই পানশালা হল শহরের পুরোনো পানীয় ঠেকগুলির মধ্যে অন্যতম একটি, যেখানে এখনও অবসর সময় কাটাতে ভালবাসেন সুরাপ্রেমীরা। ১৮০০ সালে ফিরে গেলে দেখা যাবে, একসময় এই পানশালার বিল্ডিংটি ছিল কিংবদন্তি ‘ব্রিস্টল হোটেল’ এবং এই পানশালার নামকরণ সেখান থেকেই। আধুনিক ‘গ্ল্যামার’ নাই থাকতে পারে, কিন্তু কয়েক শতাব্দী ধরে পরিশ্রান্ত অফিসযাত্রী থেকে শুরু করে, কলেজ পড়ুয়া, সংগ্রামী কবি-সাহিত্যিক সকলকেই পরিষেবা দিয়ে চলেছে ছোটা ব্রিস্টল (শ ব্রাদার্স)।
সন্ধ্যে ৬টা থেকে সোয়া ৬টা অবধি এখানে পরিষেবা বন্ধ থাকে। এ ছাড়া এই পানশালার নিজস্ব কিছু নিয়ম রয়েছে। যেমন পছন্দমতো খাবার আর পানীয় অর্ডার করার সঙ্গে সঙ্গেই বিল মিটিয়ে দিতে হয়, পরে আরও কিছু অর্ডার করার থাকলে ওয়েটার এসে আবার অর্ডার নিয়ে যায় এবং একইভাবে সঙ্গে সঙ্গেই বিল মিটিয়ে দিতে হয়। এখানকার পানীয় খুবই সস্তা। পানশালাটির পরিবেশ অনেকটা বাঙালিদের মাছের বাজারের মতো হলেও সেই ‘ক্যাকোফোনি’ শহরের উষ্ণতাকে ধরে রাখে। চিনাবাদাম থেকে শুরু করে নোনতা কাজুবাদাম, চিজ, চিলি চিকেন, কাসুন্দী সহযোগে ফিসফিঙ্গার, কাঁচালঙ্কা-পিঁয়াজ সহযোগে মটন লিভার ফ্রাই অথবা মটন ভেজা-ফ্রাই, অর্ডার করা যাবতীয় খাবার আনা হয় বাইরের দোকান থেকে।
পুরোনো কলকাতার আরও একটি চিহ্ন – লেনিন সরণির ট্রামলাইন রয়েছে এই পানশালার ঠিক সামনেই। একই জায়গায়, একইরকম পরিবেশ টিকিয়ে রেখে প্রাচীন কলকাতার নস্টালজিয়াকে ধরে রেখেছে এই পানশালাটি। আর এভাবেই সারি সারি দোকান, অফিসযাত্রীদের ভিড়, বিশৃঙ্খলা, সময়ের স্মৃতি – এই সবকিছু নিয়ে আজও পথ চলছে ছোটা ব্রিস্টল (শ ব্রাদার্স)।