ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ তালিকায় আজও কেন ব্রাত্য বাংলার বিষ্ণুপুর

Story image

এই কাহিনির সূচনা আজ থেকে দুই দশক আগে। দুর্ভাগ্য এই যে আজও তার সন্তোষজনক নিষ্পত্তি হওয়ার আশা কম। বিশ্ব ঐতিহ্য দিবস (ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ ডে, যার পোশাকি নাম ‘ইন্টারন্যাশনাল ডে ফর মনুমেন্টস অ্যান্ড সাইটস’), যা কিনা প্রতি বছর  আজকের দিনটিতে পালিত হয়, ফের একবার আমাদের মুখোমুখি দাঁড় করায় এই প্রশ্নের: বাংলার অন্যতম ঐতিহ্যবাহী শহর বিষ্ণুপুর কেন ২০ বছর পরেও পেল না ইউনেস্কো (UNESCO)-র ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট’-এর তকমা?

ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটস-এর ওয়েব পেজে গেলে দেখতে পাবেন, ‘Tentative Lists’ অর্থাৎ সম্ভাব্য তালিকা নামে একটি বিভাগ, যার মধ্যে রয়েছে সারা পৃথিবীর ১,৭৫৬ টি হেরিটেজ সাইটের বিবরণ, যেগুলি দেশ অনুযায়ী বিভক্ত। ভারতের ভাগে রয়েছে ৪২ টি নাম, যাদের মধ্যে একটি হলো ‘Temples at Bishnupur, West Bengal’, বাংলার একমাত্র প্রার্থী। পাশেই রয়েছে তারিখ, ০৩/০৭/১৯৯৮, অর্থাৎ ১৯৯৮ সালের ৩ জুলাই থেকে ‘সম্ভাব্য’ তালিকায় ম্লানমুখে বসে রয়েছে বিষ্ণুপুর, যে তালিকা শেষবার আপডেট করা হয় ২০১৯ সালে। 

জোড় বাংলা মন্দির, বিষ্ণুপুর 

ওয়েব পেজে বলা আছে, বিষ্ণুপুরের সুপারিশ আসে ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ অর্থাৎ Archaeological Survey of India অথবা ASI-এর তরফে। অথচ আশ্চর্য এই যে, মন্দিরগুলির বিবরণে একবারও ‘টেরাকোটা’ বা পোড়ামাটি শব্দটি ব্যবহৃত হয়নি, যেখানে বিষ্ণুপুরের মন্দিরের অন্যতম বৈশিষ্ট্যই হলো টেরাকোটার ব্যবহার, যা ভারতে তো বটেই, সারা পৃথিবীতেই বিরল। 

এ ব্যাপারে একাধিক বিশিষ্ট বিশেষজ্ঞের মতামত নিয়েছি আমরা – যেমন ASI-এর প্রাক্তন ডিরেক্টর জেনারেল গৌতম সেনগুপ্ত, চিত্রকর তথা পশ্চিমবঙ্গ হেরিটেজ কমিশনের চেয়ারম্যান শুভাপ্রসন্ন, শিল্প-ইতিহাসবিদ দেবদত্ত গুপ্ত, সংরক্ষণ স্থপতি (কনজারভেশন আর্কিটেক্ট) অঞ্জন মিত্র, এবং বর্ষীয়ান সাংবাদিক ইন্দ্রজিৎ চৌধুরী। সকলেই একবাক্যে স্বীকার করেছেন যে বিষ্ণুপুরের শিল্প-সংস্কৃতির বৈচিত্র্য এবং ঐশ্বর্যের যা বহর, তাতে সহজেই তাকে বিশ্ব ঐতিহ্যের দরবারে সগর্বে তুলে ধরা যায়। গৌতমবাবু একথাও বলেছেন যে বিষ্ণুপুরের ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ তকমা না পাওয়াটা “বিশ্ব ঐতিহ্যের ক্ষতি”। 

বালুচরি শাড়ি 

বস্তুত, টেরাকোটার মন্দির শুধু নয়, টেরাকোটার তৈরি নানা সামগ্রী, এমনকি গয়নাও, ডোকরার কাজ, কাঁসার কাজ, তসর সিল্কের তৈরি বিখ্যাত বালুচরি এবং মল্লভূম শাড়ি, অভিনব গোলাকৃতি দশাবতার তাস, এবং শাঁখার সামগ্রী – সব মিলিয়ে বিষ্ণুপুর। দেবদত্তবাবুর কথায়, এগুলি হলো ‘ট্যানজিবল’ হেরিটেজ, অর্থাৎ দৃশ্যমান বা ধরাছোঁয়া যায় এমন। কিন্তু ‘ইনট্যানজিবল’, অর্থাৎ সরাসরি দৃশ্যমান নয় এমন হেরিটেজের উদাহরণ হিসেবে তিনি বলছেন বিষ্ণুপুর ঘরানার কথা, যা কিনা বাংলায় উৎপন্ন ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের একমাত্র ঘরানা। “সঙ্গে যোগ করুন অত্যন্ত সমৃদ্ধ এবং প্রাচীন স্থানীয় ইতিহাস, দলমাদল কামানের সঙ্গে জড়িত লোকায়ত ইতিহাস (বিখ্যাত সেই লোহার কামান, যা নাকি যুদ্ধে ব্যবহার করেন স্বয়ং মদনমোহন), তাহলেই পেয়ে যাবেন ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের সব উপাদান,” বলছেন দেবদত্তবাবু।

এসব বাদ দিয়ে দেখলেও প্রায় এক হাজার বছর ধরে মল্লভূম বা মালভূম (যার মধ্যে ছিল বাঁকুড়া, সঙ্গে বর্ধমান, বীরভূম, সাঁওতাল পরগণা, মেদিনীপুর এবং পুরুলিয়ার কিছু অংশ) শাসনকারি মল্ল বংশের রাজধানী ছিল বিষ্ণুপুর, সপ্তম শতাব্দী থেকে শুরু করে ইংরেজদের আগমন পর্যন্ত। রুক্ষ, শুষ্ক, খরা-কবলিত মালভূম অঞ্চলে মল্ল রাজারা যে অত্যাশ্চর্য জলবণ্টন ব্যবস্থা নির্মাণ করেছিলেন, তা যে পৃথিবীর শহুরে সভ্যতার ইতিহাসে খুব সুলভ নয়, সেকথা বলেছেন অঞ্জনবাবু এবং গৌতমবাবু দুজনেই। 

দশাবতার তাস 

তাহলে সমস্যাটা ঠিক কোথায়? এই প্রশ্নের সম্পূর্ণ সদুত্তর কেউই দিতে পারেননি, তবে গত দুই দশকে মাঝেমাঝে বিষয়টি এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা হয়েছে বটে। “

বিষ্ণুপুর জাদুঘর 

অর্থাৎ স্রেফ একটি মন্দির বা মন্দির সমূহ নয়, একটি গোটা শহরকে হয়তো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ তকমা দেওয়া যেতে পারে। তাও যদি হয়, সেই প্রয়াসও যে করা হয়নি এমন নয়। অঞ্জনবাবুর কথায়, ২০০০-এর দশকের গোড়ার দিকে তিনি এবং আরও কয়েকজন INTACH-এর সহযোগিতায় গোটা বিষ্ণুপুরকেই হেরিটেজ শহরের তকমা দেওয়া যায় কিনা, সেই সংক্রান্ত একটি বিস্তারিত তথ্যপঞ্জি প্রস্তুত করেছিলেন। এর প্রধান কারণ, এই শহরে আজও এমন অনেক কিছু রয়েছে, যেগুলির উৎস অতি প্রাচীন। এক কথায়, জীবন্ত ইতিহাস।

“বিষ্ণুপুর একটি আপাদমস্তক ভাবে পরিকল্পিত শহর, যার তৎকালীন অবস্থান ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক রুট-এর ওপর। মল্ল রাজারা আদতে ধীবর অর্থাৎ জেলে সম্প্রদায়ভুক্ত, তাঁরা জানতেন জলের গুরুত্ব ঠিক কতখানি। আশেপাশে দ্বারকেশ্বর নদী ছাড়া আর কোনও জলাধার নেই, চাষের উপযুক্ত জমি নেই, অনাবৃষ্টি এবং খরার ভয় বরাবর, তা সত্ত্বেও জলের ব্যবস্থাপনা এবং বণ্টনের যে ব্যবস্থা তাঁরা করেছিলেন, তা এমনই কার্যকরী যে দশ বছর ধরে মারাঠাদের অবরোধও অনায়াসে সামলে দেয় বিষ্ণুপুর। আজ আমরা ইকো-ফ্রেন্ডলি (পরিবেশ বান্ধব) শহর বা জীবনযাপন নিয়ে এত মাতামাতি করি, বিষ্ণুপুর ছিল প্রকৃত অর্থে ইকো-ফ্রেন্ডলি শহর,” বলছেন অঞ্জনবাবু।

শাঁখ শিল্প – বিষ্ণুপুর 

মন্দির বা মন্দির সমূহ সংলগ্ন এলাকায় দোকানপাটের উপস্থিতি বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে, এমন একটি জল্পনা মাঝেমাঝে প্রকাশ পেয়েছে সংবাদমাধ্যমে। তবে এই সমস্যাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া সম্ভব, বলছেন বিশেষজ্ঞরা, যাঁদের একাধিক জনের মতে প্রধান সমস্যাটা হলো “রাজনৈতিক”। গৌতমবাবু বলছেন, “একমাত্র জাতীয় সরকারের সঙ্গেই কথা বলে ইউনেস্কো, যাদের ভাষায় যে কোনও দেশের সরকার হচ্ছে ‘স্টেট পার্টি’। আমাদের কোনও রাজ্য সরকার সরাসরি তাদের সঙ্গে যোগাযোগ বা আলাপ আলোচনা করতে পারে না, কেন্দ্রের মাধ্যমেই যেতে হয়। সুতরাং কেন্দ্র-রাজ্য একসঙ্গে কাজ না করলে সমস্যার সমাধান হওয়া মুশকিল।”

ততদিন পর্যন্ত ইতিহাস, সংস্কৃতি, এবং স্তাপত্যের বিরলতম নজির নিয়ে বিষ্ণুপুর রয়ে যাবে ‘সম্ভাব্য’ হয়েই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.