“এই দেশটা কীভাবে টিঁকে আছে বল তো?”
বলতো পাড়ার লাল দাদা। চোখে সানগ্লাস , পরনে ব্র্যান্ডেড টি শার্ট , আর মুখে অনাগত এক দিনের স্বপ্ন।
পাড়ার সেই দাদা বোঝাতে চেষ্টা করতো, এখান থেকে অনেক দূরে এক দেশ আছে , সে দেশে কেউ নাকি না খেয়ে মরে না, সবার মাথার উপর ঘর আছে। সেসব করেছেন কাস্ত্রো নামে এক মহামানব।
দুই একজন যারা একটু খোঁজ খবর রাখতো, তারা দুই একবার জিজ্ঞাসা করার চেষ্টা করতো, তাহলে ঐ স্বর্গরাজ্য ছেড়ে এত লোক বিদেশে চলে যাচ্ছে কেন?
দাদা এক দাবড়ানিতে তাদের চুপ করিয়ে দিতেন।
ডিগ্রি শেষে সেই দাদাও বিদেশেই উড়ে গিয়েছিল, বিপ্লবের স্বপ্নে কিছু অগ্নিমান্দ্য দেখা গিয়েছিল অনুগতদের মধ্যে, সেসব আলাদা কথা।
“এই দেশটা কীভাবে টিঁকে আছে বলতো?”
বলতো অনির্বাণ। কলেজের পড়াশোনার পাট চুকে সব চাকরির পরীক্ষার জন্য আমরা পড়াশোনা শুরু করেছি। একটা পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোলো, অনির্বান নাম মেরিট লিস্টে কোথাও নেই!
অনেক পোড়া কপাল করলে এই দেশে জন্মাতে হয়। শালা সবকে সব শু*রের বাচ্চা!
বলছিল অনির্বান। পাশের দোকানে রেডিওতে নচিকেতা তখন গাইছিলেন,
“ডিগ্রির ভাঁড়ারেতে তবু কিছু মাল আছে, পকেটের ভাঁড়ারটা শূণ্য।”
“এই দেশটা কীভাবে টিঁকে আছে বল তো! “
বলেছিলাম আমি। চাকরির অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার এসে গেছে, তার আগে জমা দিতে হয়েছে পুলিশ ভেরিফিকেশন রোল। এবং জমা দিতে গিয়ে শুনতে হয়েছে,
“হেঁ হেঁ আমাদের মিষ্টি খাবার জন্য কিছু দিন! গাছে জল না দিলে কি গাছ বাড়ে?”
ফেরার পথে ঘর্মাক্ত অবস্থায় সহযাত্রীর সঙ্গে গল্প হচ্ছিল। লোকাল ট্রেন , টিকিট কাটেননি তিনি। কেন?
ধুরর মশাই। ট্রেনের টিকিট না কেটে ট্রেন চড়ায় একটা আলাদা মজা আছে। ইসমে মুঝে কিক আতা হ্যায়!
জানালা দিয়ে চোখে পড়ছিল, উন্মুক্ত রাস্তার ধারে জনৈক পথচারী সর্বসমক্ষে মূত্রত্যাগ করছেন।
পরতে পরতে দুর্নীতি , মূল্যবোধহীনতা, বিশৃঙ্খলার বেড়ি…
এই দেশটা কীভাবে টিঁকে আছে?
ভাবছিলাম আমি ।।বলছিলামও।
২০১৮ র শেষদিকে দিল্লি আগ্রা মথুরা বৃন্দাবন বেড়াতে গেলাম। মায়ের বায়না, শ্রীকৃষ্ণের ভূমিতে নিয়ে যেতে হবে।
ট্রেনে যেতে যেতে এক সাধুর সঙ্গে আলাপ। তিনিও সহযাত্রী। গন্তব্যধাম মথুরা।
“আপনিও কি মথুরায় প্রথমবার যাচ্ছেন?” মায়ের উৎসুক প্রশ্ন।
“নেহি বহেনজি। ইসসে পহলে কুল মিলাকর দস বার যা চুকা হুঁ।”
শুনে আমরা চমৎকৃত। এতবার মথুরা যাওয়ার কারণ কী?
বেরিয়ে এলো আসল কথা। সাধুর জীবনে একটাই লক্ষ্য। দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গসহ ভারতের সবক’টি মুখ্য তীর্থস্থাণ বারোবার করে দর্শন। প্রায় হয়ে এসেছে, আর দুই তিন বছরের মধ্যে সফলকাম হয়ে যাবেন।
আমি ভাবছিলাম, এরা কি পাগল? কীসের জন্য এইভাবে ঘুরপাক খাচ্ছে?
বৃন্দাবনে পৌঁছে গেলাম প্রেম মন্দিরে। মন্দির দর্শন সেরে বেরিয়ে আসছি, এমন সময় এক বৃদ্ধার পিছু ডাক,
” আইয়ে বাবু , থোড়িসি শরবত পি লিজিয়ে!'”
কত দাম এক এক গ্লাসের? উত্তর শুনে আবার আমরা থ।
“মুফত কে হ্যায় বাবুজি। আপ পি লিজিয়ে , ওহি মের সৌভাগ্য হ্যায়!”
শুনলাম বৃদ্ধা ধনী বাড়ির বধূ। স্বামীর মৃত্যুর পরে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে এই বৃন্দাবনে ঘাঁটি গেঁড়েছেন। পেনশন যা পান, নিজের সামান্য গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য খরচ করে বাকি টাকা দিয়ে এইভাবে তীর্থযাত্রীদের সেবা করেন।
আমি আবার ভাবছিলাম, এরা কি পাগল? কেন কেন এরা এসব করে? কী লাভ?
এরিয়ার, প্রমোশন, ইএমআই এর হিসাব কষতে অভ্যস্ত আমার মস্তিষ্ক বুঝতে পারতো না ওদের লাভ কী, কোথায়, কীভাবে?
দেখা পেয়েছিলাম এক বৃদ্ধ অধ্যাপকের। নদীয়া জেলার কৃষ্ণ নগরে। অবসরের পরে নিজের বাড়ি ছেড়ে ভারত তত্ত্ব সাধনায় ডুবে আছেন। দিনে একবেলা খান। আর মহাপ্রভুর জীবনী নিয়ে গবেষণায় ব্যাপৃত।
তাঁর কাছে শুনলাম, আমাদের দেশে কোনোদিন গ্লাসনস্ত পেরেস্ত্রৈকা হয়নি। কারণ
আমাদের দেশে গ্লাসনস্ত পেরেস্ত্রৈকার কোনোদিন দরকারই ছিল না।
এদেশে জন্মেছিলেন এক কিশোর। ষোল বছর বয়সের মধ্যে এই কিশোর ভারত ভ্রমণ করেছিলেন, তর্কে পরাস্ত করেছিলেন বৌদ্ধ শ্রমণদের। বিনা রক্তপাতে তার পদতলে নত হয়েছিল আপামর ভারতবাসী।
তিনি শঙ্কর। ভারতের আত্মা, ভারতের উপাস্য সর্বত্যাগী শঙ্কর।
এদেশে মার্ক্স সাহেব কথিত ক্লাস স্ট্রাগল কোনোদিন হয়নি। কারণ দরকারই পড়েনি।
যখনই এদেশে ধর্মের সংকট উপনীত হয়েছে, যখনই নিরন্ন জনসাধারণের ধর্মবিশ্বাসে আঘাত হেনে শাসক তার অত্যাচারের চাবুক চালাতে উদ্যত হয়েছে,
তখনই জন্ম হয়েছে এক একজন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের, হরিহর , বুক্কার, শিবাজির।
তারা অনেকেই দরিদ্রতম পরিবার থেকে উঠে আসা। তারা মানুষের হৃদয়ে চিরস্থায়ী আসন করে নিয়েছেন।
তার জন্য তাদের গিলোটিন যন্ত্রে মারতে হয়নি কোনো ল্যাভয়সিয়েঁকে।
বৈদান্তিক সমাজতন্ত্রের বাণী নিয়ে এক সন্ন্যাসী যোদ্ধা সাগরপাড়ে পাড়ি দিয়েছিলেন এদেশ থেকেই। নত হয়েছিল পাশ্চাত্য। ভারতের শ্রমজীবীর জন্য, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কাজেও নিজেকে নিঃস্বার্থভাবে বিলিয়ে দিতে পারে যে শ্রমজীবী, তাদের মুক্তির জন্য দুয়ারে দুয়ারে ঘুরেছিলেন তিনি। তার সেই স্ট্রাগলের জন্য কোনো হলডেমার নামক নৃশংসতা চলেনি, ডক্টরস প্লট নাম দিয়ে জাতিগত নৃশংসতার পরিচয় তাকে দিতে হয়নি, স্তালিনের মতো।
তিনি স্বামী বিবেকানন্দ।
বৃদ্ধ প্রফেসরের মুখে আমি শুনছিলাম। আমার মস্তিষ্কে আস্তে আস্তে ঢুকছিল।
এ দেশ এভাবে টিঁকে আছে। এদের জন্য টিঁকে আছে। এই আধ্যাত্মিকতার জন্য টিঁকে আছে।
আমার মগজে আগে ঢুকতো না , একজন সাধারণ পুলিশ কনস্টেবল, মাইনে কহতব্য নয়। কোনো লাভ ক্ষতির পরোয়া না করে কীভাবে গুলিবর্ষণ করা বন্দুকের সামনে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে, সহকর্মীদের বলতে পারে
“গোলি মত চালানা। ইয়ে প্রুফ হ্যায়।”
এই কথা যখন বলছিলেন তিনি, কাসভকে বজ্রআটুঁনির মধ্যে আটকে। কিছুতেই নিজেকে ছাড়াতে পারছিল না কাসভ, না পেরে হাতের কার্বাইন থেকে গুলির ম্যাগাজিন খালি করে দিচ্ছিল সেই কনস্টেবলের উপরে, যে হাতে তখনও লাল সুতো বাঁধা। উদ্দেশ্য, দুনিয়াকে হিন্দু সন্ত্রাসবাদ নামক একটি আজব গল্পকথা শুনিয়ে দেওয়ার।
আস্তে আস্তে নিথর হয়ে যাওয়া তুকারাম ওম্বলে নিজের জীবন দিয়ে সেই চক্রান্ত ব্যর্থ করে দিলেন। গোটা বিশ্ব জানলো, ২৬/১১ আই এস আই ,লস্কর এ তৈবার যৌথ ষড়যন্ত্র।
তুকারাম ওম্বলে মরে গিয়েও জিতে গেলেন।
তুকারাম স্যার, আমি খুব বড় দেশপ্রেমিক নই। কিন্তু আপনি আমায় এবং আমার মতো আরও হাজার হাজার লোককে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে দেশ কেন টিঁকে আছে।।
এ দেশে বেইমানের ফল থাকবে, যারা ঘরের খেয়ে চীনের গুণ গেয়ে বেড়াবে।
এ দেশে দুষ্কৃতিদল থাকবে, লুঙ্গিবাহিনী থাকবে। একটা আইনের প্রতিবাদ করতে নেমে যারা ট্রেন জ্বালিয়ে দেয়, বাস ভাঙচুর করে, জনজীবন স্তব্ধ করে দেয়। লালকেল্লায় জাতীয় পতাকার অবমাননা করে খলিস্তানি পতাকা উড়িয়ে দেয়
এ দেশে কুলাঙ্গার রাজনীতিকরা থাকবে। ভোটব্যাঙ্কের জন্য , ২৬/১১ আর এস এস এর কাজ, একথা প্ৰমাণ করতে লেখা বইয়ের প্রকাশ করতে যারা ছোটে।
কিন্তু এদেশে আপনারাদের মত মানুষও থাকবেন, অনেক বেশি সংখ্যায় থাকবেন।
আপনারা কমোন ম্যান, পুওর কমোন ম্যান।
কোনো কিছুর পরোয়া না করে যারা উদ্যত বন্দুকের সমানে ঝাঁপিয়ে পড়বেন, লাভ ক্ষতির পরোয়া না করে, কোনো গ্রেট বা গ্রেটার মতো ফুটেজ না খেয়ে, সারা জীবন ধরে বৃক্ষরোপণ করে যারা দেশকে সবুজ সুন্দর করার সাধনায় রত থাকবেন, ট্রাইবাল মানুষকে, ভুল বুঝে দূরে সরে যাওয়া ট্রাইবাল মানুষকে স্বধর্মে ফেরানোর জন্য জীবন উৎসর্গ করে দেবেন।
আপনারা থাকতে আমাদের হারায় কে? আপনারা থাকতে এই দেশ না টিঁকে যায় কোথায়?
“তোমরা রয়েছো আমরা রয়েছি দুর্জয় দুর্বার
পদঘাতেই ভাঙবো আজ মুক্তির শেষ দ্বার
আবার জ্বালাবো বাতি
হাজার সেলাম নিও তাই আজ, শেষ যুদ্ধের সাথী।”
কবিতাটি একুশ বছরেই মারা যাওয়া এক কবির লেখা, স্মৃতি থেকে উদ্ধৃত। সেই কবির জীবনের প্রথম লেখা ছিল “বিবেকানন্দের জীবনী”????
- ✍️ Chayan Mukherjee ❤️