দুর্গাদাসকে নিয়ে আছে কত না মজার ঘটনা, তারই একটি ১৯৩৯ সালের কথা। বিহারের পাটনা রেল স্টশন। পাটনা থেকে কলকাতায় আসবেন তখনকার মহানায়ক দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। রেল কর্মচারীরা তাকে বললেন, বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ফজলুল হক সাহেব কলকাতা যাবেন, আপনার কামরায় তুলে দিই। দুর্গাদাস বললেন, এ কামরা তো আমি রিজার্ভ করেছি।। শুনুন, ফজলুল হক যাবেন, আপনি বাধা দেবেন না। আমি ফজলুল হককে চিনি না। গায়ে কি নাম লেখা আছে? শুনুন, আপনাকে আবার বলছি। উনাকে উঠতে দিন। না, এটা আমার নামে রিজার্ভ করা কামরা। ফজলুল হক মরলে আরো হবে, কিন্তু দুর্গাদাস মরলে আর দ্বিতীয়টি হবে না। যান আমি এ কামরায় আর কাউকে উঠতে দেব না। এই দাম্ভিকতার জন্য দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়কে জরিমানাও দিতে হয়েছিল।

উপমহাদেশ ভাগাভাগির আগে বাঙালির ম্যাটিনি আইডল বলতে তিনি-ই। দুর্গাদাসের জন্ম ২৪ পরগনার কালিকাপুরের জমিদার বংশে ১৮৯১ সালে। নট শেখর নরেশ চন্দ্র মিত্র এই তরুণ সপ্রতিভ সুদর্শন দুর্গাদাসকে ১৯২৫ সালে নিয়ে গেলেন মঞ্চ অভিনয়ে। প্রথম ‘কর্নার্জুন’ নাটকে বিকর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেন। অল্প দিনের মধ্যেই নায়কোচিত চেহারা, উদাত্ত মধুর কণ্ঠেস্বর, অভিজাত চলন-বলন, সুকান্তি-সবটা মিলিয়ে তিনি এক প্রবল ব্যক্তিত্বরূপে পাদপ্রদীপের আলোয় দেখা দিলেন। সেই প্রবল ব্যক্তিত্বের বহিপ্রকাশ ছিল আত্মপ্রত্যয়ে, যা প্রায়শই দাম্ভিকতা বলে মনে হত। ১৯২৮ থেকে ১৯৪২ পর্যন্ত বাংলা মঞ্চ এবং রূপালী পর্দায় দুর্গাদাসের ছিল একচ্ছত্র রাজত্ব। ওই সময়ে তিনি যা দাবী করতেন, তাই পেতেন।

দুর্গাদাস অভিনীত নির্বাক ছবিগুলোর সংখ্যা ছিলো প্রায় কুড়িটি। নির্বাক চলচ্চিত্রে প্রথম অভিনয় ‘মান ভঞ্জন’ ছবিতে। এরপরে – চন্দ্রনাথ, মিশর রাণী, জেলের মেয়ে, ধর্মপত্নী, সরলা, রজনী, বুকের বোঝা, কণ্ঠহার, ইন্দিরা, রাধারানী, ভাগ্যলক্ষীতে অভিনয় করেন। এ সব ছবিতে তিনি ঈর্শ্বনীয় সাফল্য লাভ করেন।

সবাক যুগে দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ১৫টি ছবিতে অভিনয় করেছিলেন, ছবিগুলো হলো – ১. দেনা পাওনা (নায়িকা – নিভাননী,১৯৩২) ২. কৃষ্ণ কান্তের উইল (নায়িকা- শান্তি গুপ্তা, ১৯৩২) ৩. চিরকুমার সভা (নায়িকা-মলিনা দেবী, ১৯৩২) ৪. চন্ডীদাস (নায়িকা- উমাশশী,১৯৩২) ৫. কপালকুণ্ডলা (নায়িকা- উমাশশী, ১৯৩৩) ৬. মীরাবাঈ (নায়িকা-চন্দ্রাবতী, ১৯৩৩) ৭. মহুয়া (নায়িকা- মলিনা দেবী, ১৯৩৪) ৮.ভাগ্যচক্র (নায়িকা- উমাশশী, ১৯৩৫) ৯. দিদি (নায়িকা- চন্দ্রাবতী, ১৯৩৭) ১০. বিদ্যাপতি (নায়িকা ছায়াদেবী, ১৯৩৮) ১১. দেশের মাটি (নায়িকা-চন্দ্রাবতী, ১৯৩৮) ১২. পরশমনি (নায়িকা রানীবালা, ১৯৩৯) ১৩. ঠিকাদার (নায়িকা রেনুকা রায়ের বাবার ভূমিকায়, ১৯৪০) ১৪. অবতার (নায়িকা-জ্যোস্না গুপ্তা, ১৯৪১) ১৫. প্রিয় বান্ধবী (নায়িকা চন্দ্রাবতী, ১৯৪৩)।

ভারতলক্ষ্মী পিকচার্সের মালিক বাবুলাল চোখানির সঙ্গে নানা কারণে মতবিরোধ হওয়ায় দুর্গাদাস ‘জীবনসঙ্গিনী’ ছবিতে নায়কের ভূমিকায় কাজ শুরু করেও ছেড়ে দিলেন (১৯৩৬)। সেই শূণ্যস্থান পূরণ করেই ছবি বিশ্বাস সিনেমা দর্শকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। অসাধারণ আত্মপ্রত্যয়ী দাম্ভিক দুর্গাদাস বলেছিলেন, ‘আমি ছেড়ে দিলে বাবুলাল চোখানির ভারতলক্ষ্মী পিকচার্সের কিছুই থাকবে না – থাকবে শুধু বাবুলালজী আর হনুমানজী।’ ভারতলক্ষ্মী পিকচার্সের আয়ু শেষ হয়ে গেল। এদিকে দুর্গাদাসের প্রতিভাময় শিল্পী-জীবনের আয়ু দ্রুত ফুরিয়ে আসছিল। তার শেষ ছবি-‘প্রিয় বান্ধবী’। এই ছবিতে নায়িকা চন্দ্রাবতীর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তিনি যখন নায়কের ভূমিকা করছেন তখন রোগে অমিতাচারে তার শরীর জীর্ণ হয়ে এসেছে। প্রচুর মদ্যপানে ও প্রচুরতর অমিতাচারে প্রতিভাবান নট দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যয়ের জীবনদীপ নির্বাপিত হল (১৯৪৩)। কিন্তু জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি প্রতিভার আত্মপ্রত্যয় ও আভিজাত্য পরিত্যাগ করেননি। দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলা মঞ্চ ও চিত্রজগতে এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক, যার তুলনা সহজে মেলে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.