ছেলেটা কখন যে কী করবে, তা কেউ জানে না। পাশের ‘প্রিয়’ মানুষটিও টের পায় না।
জীবনের অনেক বড় বড় সিদ্ধান্ত সে নিজেই নিয়েছে। কারও সঙ্গে বিন্দুমাত্র ‘আলোচনা’ করেনি। নিজের যেটা ভাল লেগেছে, সেটাই করেছে। যেটা ভাল বলে মনে করেছে, সে পথেই হেঁটেছে। সমালোচনা হবে জেনেও পিছু হটেনি। সকলের কাছে সে ‘খারাপ’ লোক হয়ে যাবে, তা বুঝেও নিজের সিদ্ধান্তের প্রতি অটল থেকেছে। মনে কোনওরকম দ্বিধা থাকেনি। কেউ হয়তো সাময়িকভাবে কিছু চাপিয়ে দিয়েছে। কিন্তু শেষপর্যন্ত নিজের ‘ভালবাসা’ এবং ‘প্যাশন’-এর দিকেই এগিয়ে গিয়েছে। আর সাফল্য তার পিছু নিয়েছে।
সকলের কাছেই তার জীবনদর্শন হয়ে উঠেছে ‘মডেল। তার ঠাণ্ডা মাথায় কাজ করার মানসিকতা হয়ে উঠেছে, সকলের কাছে ‘প্রেসক্রিপশন’।

আসলে, নিজের প্রতি বিশ্বাস কখনও সে হারায়নি। নিজের কাছে একেবারে স্বচ্ছ। জানে, তার কাজ তাকেই করতে হবে। কেউ করে দিয়ে যাবে না। তাই সে কী করবে, ভবিষ্যতে কোন পথে যাবে, তা কাউকে বুঝতেই দেয় না।

ছোট্টবেলা থেকেই ছেলেটা যে বড্ড ‘আনপ্রেডিক্টেবল’।
কখন যে কী ঝড় তুলবে, তা বিশ্বের তাবড় তাবড় বিশেষজ্ঞরা অঙ্ক কষেও বের করতে পারেন না। সমালোচকরা তাই তাকে বেশি কিছু বলতে ভয় পান। কারণ যখনই তাকে নিয়ে কেউ সমালোচনা করেছেন, তাকে একেবারে মুখের মতো জবাব দিয়েছে ছেলেটা। কথায় নয়। কখনও ব্যাটের ‘দামালপনা’ তো, কখনও ক্যাপ্টেন্সির ক্ষুরধার ‘মস্তিষ্ক’। সমালোচকদের ছক্কা হাঁকিয়ে প্যাভিলিয়নে পাঠিয়ে দিয়েছে সে। মনে মনে ‘স্যালুট’ জানিয়েছেন তাঁরা।

অন্যরা তো অনেক দূরের ব্যাপার। বাড়ির লোকও প্রথমদিকে তেমনভাবে বুঝতে পারেনি, এ ছেলেটা যে একদিন বিশ্ব কাঁপাবে! মা কিছুটা বুঝলেও ছেলেটার বাবা মাঠের লোক হয়েও সন্তানের ‘ট্যালেন্ট’ চিনতে পারেননি। বরং ব্যাটিং বা কিপিং নয়, লেখাপড়া করে যাতে জীবনে সচ্ছল হয়, সে দিকেই বারবার ঠেলে দিতেন। রেগে যেতেন ছেলের ক্রিকেটের প্রতি বড্ড ভালবাসা দেখে। আসলে, ঝাড়খণ্ড থেকে ক্রিকেটে যে কেউ বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিতে পারে, সে ধারণা তো কখনও কারও ছিল না।

কিন্তু ছেলেটা যে অন্যরকম ছিল। একেবারে অন্য ধাতুতে গড়া। ছেলেটা যে বড্ড ‘আনপ্রেডিক্টেবল’।

তাই তো মহেন্দ্র সিং ধোনি যে কখন ক্রিকেট থেকে অবসর নেবে, তা কেউ বলতে ভরসা পাচ্ছেন না। সকলেই তো চাইছেন, ধোনির উপর বিষয়টা ছেড়ে দেওয়া হোক।
কারণ সকলেই জানে যে, ছেলেটা বোঝে কখন কী সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কখন নিজেকে ক্রিকেট থেকে সরিয়ে নেওয়া উচিত। যেমনটা করেছিল টেস্ট কেরিয়ার থেকে অবসর নেওয়ার সময়। ক্রিকেট মহলে একটু কান পাতলে নাকি শোনা যায়, টেস্ট থেকে অবসরের বিষয়টা স্ত্রী সাক্ষীও আগে থেকে কিছু জানতেন না। এমনকী, অবসর ঘোষণার দিন সকালেও টের পাননি সাক্ষী।

ধোনিই বলতে পারবে, অন্য কেউ নয় ধোনির প্রতিভা নিয়ে পরিবার তেমন একটা ওয়াকিবহাল না থাকলেও একজন কিন্তু ছোট্ট বেলাতেই ‘হিরে’ চিনতে ভুল করেননি। প্রথম দেখাতেই বুঝতে পেরেছিলেন, এ ছেলে ‘অন্যরকম’। এ ছেলে ‘রত্ন’। বিস্মিত হয়ে যান ছেলেটার খেলাধুলার প্রতি প্যাশন দেখে। অবাক হয়ে যান ছেলেটার কোনও কিছুতেই হতাশ না হওয়ার মানসিকতা দেখে। ধোনির স্কুলের সেই ‘গেম টিচার’ স্যর কেশব বন্দ্যোপাধায় তো তাই বলেই ফেললেন, “ধোনির মানসিকতা বোঝা এত সোজা নয়। আমি তো অনেকসময় বুঝতে পারতাম না ও কী করবে। কী করতে চায়। ও একেবারে অন্যরকম।” ইংল্যান্ড-বিশ্বকাপে টিম কোহলির বিদায়ের পরেই একদিনের ক্রিকেট থেকে কবে ধোনি অবসর নেবে, তা নিয়ে জল্পনাও চলছে। তা কবে নিতে পারে ধোনি অবসর ? ধোনির মতোই তার স্যরের সটান জবাব, “আমি কেন, কেউ বলতে পারবে না। একমাত্র ধোনি জানে ও কবে অবসর নেবে। এসব জল্পনা, আলোচনা করে কোনও লাভ হবে না। হঠাৎ সিদ্ধান্ত নেবে। কাউকে বুঝতেই দেবে না। মাহি (ধোনির ডাকনাম) যে খুব ‘আনপ্রেডিক্টেবল।”

অনেককেই বলতে শোনা যাচ্ছে, ধোনি যে সেনাবাহিনীতে গিয়েছে, তা নাকি অবসরের ইঙ্গিত। এটা সত্যি? একেবারে সোজা ব্যাটে খেললেন স্যর। বললেন, “ওর দায়িত্ববোধ অসম্ভব। তাই ওকে যখন সেনাবাহিনী থেকে সাম্মানিক লেফটেন্যান্ট কর্নেল দেওয়া হয়েছে, ও সেই কাজটাও মন দিয়ে করবে। একটা কথা মানতে হবে, ফিটনেসের জন্য সেনাবাহিনীর মতো ভাল জায়গা আর কোথাও নেই। কে বলতে পারে, সেনাবাহিনীতে গিয়ে ধোনির ফিটনেস আরও দারুণ হয়ে গেল। সামনে প্রচুর খেলা রয়েছে। হয়তো তখন ওকে একদম অন্যরকম লাগতেও পারে। ওই যে বললাম, ধোনিকে বোঝা সত্যিই কঠিন। বড় ‘আনপ্রেডিক্টেবল’ ম্যান ধোনি।”

শুধু ধোনির স্যর নন, ভারতীয় দলের বহু প্রাক্তন ক্রিকেটারও চান, কবে ধোনি অবসর নেবে, তা নির্বাচকরা নন, সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব যেন পুরোপুরি মাহির হাতেই তুলে দেওয়া হয়। আর সবচেয়ে বড় কথা, দলের সকলে চাইছে এখনই যেন ধোনিভাই অবসর না নেয়। কেননা, সে যতদিন খেলবে, লাভবান হবে তরুণরা। খুব কাছ থেকে দেখতে পাবে ক্রিকেট বিশ্বের ‘অমুল্য’ রত্নকে। শিখতে পারবে বিপক্ষকে বধ করার নতুন নতুন কৌশল।
আর প্রাক্তনরা তো জানেন, ধোনিকে কিছু বলতে হয় না। কখন কী করতে হয়, তা ভাল করে জানে সে। তাই তো বিশ্বকাপের পর ওয়েস্ট ইন্ডিজে ধোনি যাবে কি না, তা নিয়ে দোটানায় ছিলেন নির্বাচকরা, তখন হঠাৎ মাহি জানায় যে সে ক্যারিবিয়ান সফরে যাবে না।
আসলে, স্যরের কথাই ঠিক, ধোনি কখন যে কী করবে, তা কেউ বলতে পারবে না। একমাত্র ধোনিই জানে।

অনামীদের নিয়ে বিশ্বজয়সত্যি বোঝা কঠিন ছেলেটাকে।
দেশের মানুষও তো ২০০৭ বিশ্বকাপে টিম ইন্ডিয়ার বিপর্যয়ের পর বুঝতে পারেনি, কোন ‘তারা’-র হাতে দলের দায়িত্ব তুলে দেওয়া হল। অল্প সময়ের মধ্যেই অন্ধকার থেকে আলোর পথ দেখিয়েছিল দলটাকে। যখন টিমের তারকারা বিশ্রামের জন্য দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রথমবার টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপে যেতে চায়নি, তখন একেবারে আনকোরা টিম নিয়ে বিশ্বের দরবারে ধোনি দেখিয়েছিল, দেশ পেয়ে গিয়েছে অন্যতম সেরা ‘ক্যাপ্টেন’ । চাপের মধ্যে তার ‘কুল’ মানসিকতায় মুগ্ধ হয়েছিল বিশ্বের ক্রিকেট বিশেষজ্ঞ মহল। সেলাম করেছিল তার দুর্দান্ত ক্রিকেট মস্তিষ্কের। আর ক্রিকেট-বিশ্ব টের পেয়ে যায়, ভারতীয় ক্রিকেট দলের ভবিষ্যৎ সঠিক ‘ক্যাপ্টেন’-এর হাতে পড়েছে। সুরক্ষিত ভারতীয় দলের তরুণ ক্রিকেটাররা।

যখন সকলে হাল ছেড়ে দেয়। যখন সকলে ভেবে নেয়, আর সম্ভব নয়। হার নিশ্চিত। তখন কিন্তু মাহি আরও দৃঢ়। আরও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। ঠাণ্ডা মাথা। লড়াই থেকে এতটুকু জমি ছাড়তে নারাজ। ধোনির বন্ধুরাই বলে, মাহি সহজে হাল ছাড়ার ‘বান্দা’ নয়। হারের মুখ থেকেও জিতে আসতে জানে ধোনি। শেষ বলে ম্যাচ ঘুরিয়ে দিতে পারে।

তাই তো টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে শেষ ওভারে চমকে দিয়ে যোগিন্দার শর্মার হাতে অনায়াসে বল তুলে দিতে পারে ধোনি। যখন সকলে ভেবে নিয়েছিল পাকিস্তান জিতছে, তখন মাহির ছোট্ট একটা ফিল্ডিং চেঞ্জ ম্যাচের রংটাই বদল করে দিল। যোগিন্দারের বল মিসবার ব্যাটে লেগে শ্রীসন্তের তালুবন্দি হতেই আনন্দে ফেটে পড়ল ভারত। কিন্তু তার মুখে তেমন হাসি নেই। শান্ত, স্থির।

এটাই তো স্বাভাবিক ধোনির কাছে। কেননা, বিপক্ষের জিতকে কেমন করে হারে পরিণত করতে হয়, সেটা তো স্কুল বয়স থেকেই জানা। যখন বিপক্ষ জিতে গিয়েছে ধরে নিয়ে সেলিব্রেশনের আয়োজন করতে থাকে, তখনই ধোনি কামাল দেখায়। ঠাণ্ডা মাথায় ম্যাচ বের করে নেয়। ধোনিকে কী সাধে বলা হয় ভারতের সেরা ‘ফিনিশার’?

স্কুল থেকেই অন্যরকম ক্রিকেটের প্রতি কোনওদিনও তেমন ভালবাসা ছিল না ছেলেটার। ফুটবল নিয়ে মেতে থাকত সে। স্কুলের ফুটবল দলের সে ছিল গোলকিপার। কিন্তু তার ভাগ্যে যে ক্রিকেটার হওয়া লেখা ছিল। স্কুলেই একদিন চোখে পড়ে যায় গেম টিচার কেশব স্যরের। ব্যাটিং নয়, ধোনি হবে উইকেটকিপার—এটাই ছিল কেশব স্যরের নির্দেশ। কিন্তু তার ব্যাটিং হাতও দারুণ। আর ছোট্ট থেকেই ছিল। অসম্ভব সাহস। দুর্বল নয়, ‘বেস্ট’ টিমের বিরুদ্ধেই ভাল খেলতে ভালবাসত সে। আসলে স্কুল বয়স থেকেই যে সে ছিল সেরা। কিন্তু স্যরের নির্দেশেই স্কুল টিমে একেবারে শেষের দিকে ব্যাটিং করতে নামতে হত তাকে। যতই আটকানোর চেষ্টা হোক। প্রতিভা কখনও সুপ্ত থাকে না। সেটাই হল। একটা ম্যাচে ধোনির ‘ব্যাটিং’ জেতাল টিমকে। ব্যস, আর কে দেখে তাকে। এরপরই স্যারের কাছে ধোনির আবদার সে ওপেন করতে চায়। স্যরও মানতে বাধ্য হলেন। তারপর তো ইতিহাস। ধোনির জন্য সেই সময় তার স্কুল টিম প্রচুর ট্রফি জেতে। কখনও তার ব্যাটিং কখনও আবার ধোনির কিপিংয়ে কাত হয়ে গিয়েছিল বিপক্ষের সব দল। সবচেয়ে বড় কথা, অনেক হারা ম্যাচ না কি জিতিয়ে এনেছিল ধোনি। আসলে স্কুল জীবন থেকেই মাহি যে একেবারে অন্যরকম। হারতে মোটে জানে না সে।

তাই তো ধোনি যতক্ষণ ক্রিজে রয়েছে, ততক্ষণ কোনও অসম্ভবই ‘অসম্ভব’ লাগে না ক্রিকেট ভক্তদের। আর তা হবেই বা না কেন!

ধোনিই যে সেই প্রত্যাশা তৈরি করেছে। তার ব্যাটেই তো দীর্ঘ দু’দশক পর ভারতবাসী আবার বিশ্বকাপের স্বাদ পেয়েছে। তাও আবার দেশের মাঠে।

ধোনির বুদ্ধিতেই ইতিহাস ভাল ফল করতে পারে, সেই আশা একটা ছিল। কিন্তু অতি বড় ক্রিকেট সমর্থকও ভাবতে পারেনি বিশ্বকাপটাই ভারতের হাতে চলে আসবে।
ক্যাপ্টেন ধোনির তুলনা নেই। কিন্তু বিশ্বকাপে ফাইনালের আগে ব্যাটসম্যান ধোনি তো পুরো ‘ফ্লপ’। ব্যাটে তার রান নেই বললেই চলে।

ওই যে একই কথা। সকলে যখন ভেবে নেয়, হারা কেউ আটকাতে পারবে না, তখন ধোনি অন্য কিছু ভাবে। তার জন্যই তো ওকে বলা হয় চ্যাম্পিয়ন। মহাতারকা।

শ্রীলঙ্কার বিশাল রানের সামনে তখন খারাপ অবস্থা ভারতের। প্যাভিলিয়নে শচীন, শেহবাগ। মুরলীধরনের বিষাক্ত স্পিনে বেশ কিছুটা ব্যাকফুটে। তখনই ধোনির মাস্টারস্ট্রোক। প্যাড পরে বসে টুর্নামেন্টের সেরা ক্রিকেটার যুবরাজ। তখনই ধোনি কোচ গ্যারি কার্স্টেনকে বলল, যুবরাজ সিং নয়, বিরাট কোহলি আউট হলে সে যাবে। অবাক হয়ে যান কোচও। ধোনিকে নামতে দেখে তখন ক্রিকেট দর্শক থেকে বিশেষজ্ঞ, সকলে হতবাক হয়েছিলেন।

কিন্তু ধোনি যে একেবারেই নিজের সিদ্ধান্তে অটল। আর তারপর দুনিয়া তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করল ধোনির ব্যাটিং সৌন্দর্য। আর শেষ ওভারে সেই ছক্কা তো ইতিহাসের পাতায়। যতদিন বিশ্বকাপ থাকবে, ধোনির শট ততদিন উজ্জ্বল হয়ে থাকবে।
তাই ধোনির ক্রিকেট বুদ্ধি নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেমন একেবারে ভুল, তেমন সে কবে অবসর নেবে, সেটা তার উপর ছেড়ে দেওয়া ভাল। কারণ, ধোনি জানে কবে, কখন, কী সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.