এই মেঘলা দিনে একলা ঘরে থাকে না তো মন

“গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গে চলবে দিনভর বৃষ্টি” — টেলিভিশন থেকে ভেসে আসছে সঞ্চালকের বার্তা। বাঙালি পাল্টে গেলেও, বর্ষার মেজাজ কিন্তু একই রয়ে গেছে। ছাতার আকৃতি বদলেছে, প্রেমের সংজ্ঞা বুঝে নিয়েছে নতুন মোড়, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় উন্মুক্ত হয়েছে — কিন্তু সেই যে একটা গান গুনগুনিয়ে শুরু হয়েছিল সাতের দশকে, আর থামল না। “এই মেঘলা দিনে একলা ঘরে থাকে না তো মন, কাছে যাব কবে পাব ওগো তোমার নিমন্ত্রণ” —

বর্ষামঙ্গলে চোখের নেশা লাগছে ক্রমশ। ক্রমশ পাল্টে যাচ্ছে রোজনামচার ধরন। মানুষের প্রেম জমছে রাস্তায়। কোনো এক বিকেলের বৃষ্টির ছাট গায়ে গায়ে বসে আছে। উপুর হয়ে শুয়ে আছে একান্ত আদিখ্যেতা। ঋতুপর্ণর (Rituparno Ghosh) কণ্ঠে সেই প্রথম শোনা ‘দেয়া’ মানে ‘মেঘ’। সেই মেঘ বিকেলেরও হতে পারে, আবার রাত্তিরের। মেঘাড়ম্বরে বৃষ্টি নামলে মাঠ-ঘাট-শহরের কোলাহল পার করে কোনো এক ছবিওয়ালা গন্তব্যে পৌঁছে যাবে ঠিক। ছবিওয়ালার চোখে শহর। বৃষ্টির শহর। আষাঢ়ে শহর। একালের কবি ইন্দ্রনীল ঘোষ (Indranil Ghosh) তাই লেখেন সেই শাশ্বত লাইনগুলি, “মাইরি! তুমি ওঠালে না বলে বৃষ্টি শুধু পড়েই গেল চিরদিন” —

বর্ষাকাল (Monsoon) এলে ছোটোবেলার কথা মনে পড়ে। নয়ের দশক। বাড়ির উঠোনে জল থইথই করলে মুঠো ভর্তি ছাই ছিল আমাদের মূর্তিমান বিপদতারণ। পিছল উঠোনে মায়েরা ছড়িয়ে দিতেন ছাই। আছাড় খাওয়ার হাত থেকে রক্ষা পেত সবাই। সেই উঠোনও কি আর আছে নাকি ছাই! ভেঙে টুকরো টুকরো হয়েছে। আর বর্ষাও ঢুকছে অনেক দেরিতে। তার মেজাজ ধরা যাচ্ছে না। বছর এগোচ্ছে, মানুষের মতো বর্ষার ‘মুড সুইং’-ও দেখার মতো হয়ে উঠছে।

মনে পড়ে বিভূতিভূষণ (Bibhutibhushann Bandyopadhyay) বর্ষার বর্ণনা দিচ্ছেন ‘পথের পাঁচালি’-তে (Pather Panchali)। লিখছেন, “দুই একদিনে ঘনীভূত বর্ষা নামিল। হু-হু পুবে হাওয়া-খানাডোবা সব থৈ-থৈ করিতেছে- পথেঘাটে এক হাঁটু জল, দিনরাত সোঁ সোঁ, বাঁশ বনে ঝড় বাধে- বাঁশের মাথা মাটিতে লুটাইয়া পড়ে…।” বর্ষা নামে। বর্ষার রাতে আমরা শুনতে পাই সর্বজয়া দুর্গাকে বলছেন, “পাশ ফিরে শো তো দুগ্গা, বড্ড জল পড়চে। একটু সরে পাশ ফের দিকি।” অকস্মাৎ এ সময় “হুড়ুম করিয়া বিষম কী শব্দ হয়, সর্বজয়া তাড়াতাড়ি দুয়ার খুলিয়া বাহিরের দিকে উঁকি মারিয়া দেখিল-বাঁশবাগানের দিকটা ফাঁকা ফাঁকা দেখাইতেছে- রান্নাঘরের দেওয়াল পড়িয়া গিয়াছে।”

দুর্গা ভিজছে

তাই বর্ষা মানে খানিক বিষণ্ণতাও। দুর্গা চলে যাচ্ছে এ ধরাভূমি ত্যাগ করে৷ অপুর সেই প্রথম একা হওয়া। সত্যজিৎ রায় কী সাবলীলভাবে এ সব দৃশ্য ফুটিয়ে তুলেছিলেন। বাংলা চলচ্চিত্রে আমরা বৃষ্টি পেয়েছি ভিন্ন আঙ্গিকে, ভিন্ন মেজাজে। ‘পথের পাঁচালি’ ছবিতে বৃষ্টি যেমন খুবই ইঙ্গিতবহ। বৃষ্টিতে ভিজেই মৃত্যু হবে দুর্গার। পণ্ডিত রবিশংকর (Pt. Ravi Shankar) দুর্গার বৃষ্টিতে ভেজার দৃশ্যে ব্যবহার করবেন ‘দেশ’ রাগ। বিভূতিভূষণের মূল উপন্যাস পড়ে আমরা যা কল্পনা করেছিলাম, সত্যজিৎ (Satyajit Ray) তাই-ই ফ্রেমবদ্ধ করলেন। বাংলা সাহিত্য কিংবা চলচ্চিত্রের আবেগ থেকে দুর্গার অল্পবয়সী মৃত্যুর জন্য হয়তো অবশ্যম্ভাবী ছিল ঝমঝমিয়ে হঠাৎ বৃষ্টি।

মেঘে ঢাকা তারা-য় নীতার হাত থেকে পড়ে ভেঙে যাওয়া দাদা-বোনের ফ্রেম

পাশাপাশি ঋত্বিক ঘটকের (Ritwik Ghatak) ‘মেঘে ঢাকা তারা’-র সেই অমোঘ দৃশ্য, যেখানে নীতা বাড়ি ছাড়া হচ্ছে। পিছনে দাঁড়িয়ে রয়েছে তার দাদা। সেদিনও বৃষ্টি হয়েছিল খুব। নীতার জীবনের আরেক অধ্যায়ের সূচনা নাকি কোনোকিছুর সমাপ্তি! বৃষ্টি নিয়ে এসেছিল এমনই অনেক সিনেম্যাটিক প্রশ্ন। আসলে আমরা ভাবি বৃষ্টি আমাদের আদতে কী কী দিয়েছে! শুধুই কি খিচুড়ির উত্তাপ, মশার গুনগুন আর উপচে পড়া নর্দমার জল! বর্ষা আমাদের আস্ত একটা মেঘদূত দিয়েছে। মেঘকে সেখানে প্রিয় বন্ধু বলা হয়েছিল। তাকেই আবার বুদ্ধদেব বসু বলেছিলেন, “বিরক্ত বর্ষার মাস অবিরল সমস্ত শহর/ অফুরন্ত পাত্র থেকে ঢালে তার ঠান্ডা অন্ধকার।” কালিদাসের সমাধিতেও কি বর্ষা ঝরে? ‘আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে মেঘমাশ্লিষ্টসানুং’ যদি না রামগিরি পর্বতের উপর দিয়ে উড়ে যেত, আর মেঘ দেখে যক্ষের মনে না জাগতো প্রিয়া বিরহের যাতনা, তবে কি মেঘ কিংবা এই বর্ষা কাব্যের শ্রেষ্ঠ সাধনা হতে পারত? বুদ্ধদেব বসু এ প্রসঙ্গে লিখেছিলেন, “বর্ষা ও বিরহ এই বিষয় দুটি ভারতীয় কাব্যে আজ পর্যন্ত প্রধান হয়ে আছে; তার একটি মুখ্য কারণ, সন্দেহ নেই, মেঘদূতের আবহমান প্রতিপত্তি। উভয়ের উৎসমূল বাল্মীকি হতে পারেন, কিন্তু অন্য নানা প্রসঙ্গ থেকে কালিদাস এই দুটিকে বিযুক্ত করে নিয়েছিলেন বলেই তারা উত্তর সাধকের পক্ষে বিশেষভাবে ব্যবহার্য হল।”

কিংবা শঙ্খ ঘোষ (Shankha Ghosh) যখন নিজেকে বলেন, “এমন বৃষ্টির দিনে আমার জন্মের কোনো শেষ নেই”, তখন কবির মুখোমুখি বসি আমরা। মনে মনে সংকল্প নিই। অন্যদিকে বেখেয়ালে অমর সেই গায়ক গেয়ে উঠবেন, “শুধু ঝরে ঝর ঝর আজ বারি সারাদিন/ আজ যেন মেঘে মেঘে হল মন যে উদাসীন” — গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের লেখা ‘শেষ পর্যন্ত’ ছবির এই গান হেমন্ত মুখোপাধ্যায় (Hemanta Mukherjee) যখন সুর দিচ্ছেন, বর্ষা হয়তো তখন তাঁর প্রিয় বন্ধু হয়ে যাচ্ছে। মেঘদূতের সেই উড়ে আসা মেঘগুলোর মতো।

তিতাস একটি নদীর নাম-এর অমোঘ সেই দৃশ্য

বর্ষার বৃষ্টি আসলে কোথাও গিয়ে নিজেকে হাতড়ে বেড়ানো। সেখানে গান-সিনেমা-কবিতা মিলেমিশে একাকার হয়ে থইথই করে। খাস গল্প হয় বেশ। দুঃখ একটাই, আজকাল আর তেমন বর্ষার দাপট নেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.