কলমিলতা পাড়ের টাঙ্গাইল শাড়িতে যেন ধেয়ে গেল কৃষিভিত্তিক জীবন আর ব্রতের আলপনা

Story image

কলমিলতা পাড়ের টাঙ্গাইল শাড়ি

আদিম কৌম সমাজ থেকে প্রকৃতির সঙ্গে মানব-মানবীর প্রায় শারীরিক ভালোবাসার সম্পর্ক। এই শারীরিক ভালোবাসা এমনই যে কখনও কখনও মনে হয়েছে যে আমার মা পুকুর থেকে স্নান করে নিকোনো উঠোনে ভিজে কলসি নিয়ে হেঁটে গেছে আর তার পায়ের ছাপটা পড়েছে সেখানে। তারপর যখন মা কোজাগরী লক্ষ্মী পুজোয় লক্ষ্মীর পা এঁকেছেন, সেখানে আমার মায়ের পায়ের ছাপ দেখতে পেয়েছি। প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনার সূত্রে (BFA) অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাংলার ব্রত যখন পড়ি আমার কাছে সেই সব ছবিগুলো অচেনা লাগেনি। কারণ জন্মের পর থেকেই সেগুলো দেখে বড়ো হয়েছি — যেমন পৌষ পার্বণের আলপনা, চৈত্র সংক্রান্তির আলপনা। বাংলার ব্রত পড়ে আমার মনে হলো এটি এমন একটি প্রয়াস যে স্বদেশিয়ানাকে, দেশি লোকসমাজের ঐশ্বর্যকে লোকসমাজের মধ্যে যে এত কিছু আছে, সেই উপাদানগুলোকে আমাদের পাশ্চাত্যের শিক্ষায় শিক্ষিত বাঙালির চোখের সামনে সাজিয়ে দেওয়া। সেই সময় অবন ঠাকুর পুরোনো বাংলার দিকে চোখ ফেরাচ্ছেন আমাদের, আর আমরা এগুলো দেখে বেড়ে উঠেছি।

মাটির উঠোনে নিকোনো কলমিলতা আলপনা

পোস্ট গ্রাজুয়েশনের সময় জে.জে স্কুল অফ আর্ট-এ তখন বিদেশি সব ওয়েভিং-এর মেশিন দেখলাম এবং কাজ করলাম। কিন্তু ভেতরে আমার শেকড়টা রয়ে গেলো।কর্পোরেট ছেড়ে যখন কলকাতা এলাম, প্রথম কাজ হলো সত্যজিৎ রায়ের সিনেমার শাড়ি পুনর্নির্মাণ করা। প্রথম কাজটি ছিল সর্বজয়ার পরনের কুঞ্জলতা পাড়ের শাড়ি। আবার শেকড়ে ফেরার গল্প। পরর্বতী কালে ড. শীলা বসাক ‘বাংলার ব্রত পার্বণ’ নিয়ে গবেষণা করেছেন । উনিও অবন ঠাকুরের দেখানোকেই যেন অনেক বিস্তারে গিয়ে দেখলেন। কলমিলতা নিয়ে যখন শাড়ি করব ভাবলাম, তখন আমার গবেষণার প্রয়োজনে ড. শৈবাল বসু নিয়ে গেলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক সতী চ্যাটার্জীর বাড়িতে। ৮৬ বছর বয়সে সতীদেবী এঁকে দিলেন বাংলায় তাঁদের গ্রামের বাড়িতে যেমন কলমিলতা আলপনা দেওয়া হতো, সেই ছবি।

কিন্তু ততদিনে আমার পাশের বাড়ির এক দিদিকে পৌষসংক্রান্তির সকালে আলপনা দিতে দেখেছি। কিন্তু দিদির হাতের যে চলনটি দেখেছি তা অবন ঠাকুরের আলপনার সঙ্গে হুবহু মেলে না। অন্যদিকে যখন কলমিলতা নকশা নিয়ে সত্তর বছর বয়সি এক তাঁতশিল্পীর কাছে গেলাম, তিনি বললেন এই কলমিলতা তাঁর বাবাকে ছোটোবেলায় বুনতে দেখেছেন, যার সঙ্গেও অবন ঠাকুরের আলপনার কোনো মিল নেই।

গ্রামবাংলার আলপনা দেওয়ার রীতি

লোকশিল্পে এটাই হয়তো স্বাভাবিক কারণ। স্থানভেদে, পরিবার ভেদে, এমনকি ঘরের মেয়েটির শরীর মনের চাওয়া-পাওয়া কল্পনার ভেদে ঘরে ঘরে উঠোনে উঠোনে এই কলমিলতা রূপ নিয়েছে নানা ছাঁদে। সব ছাঁদকে এক করে ‘একটিমাত্র’ হয়ে ওঠার কোনো আধুনিক ডিজিটাল চাপ তাঁদের মধ্যে নেই। তাই আমার শাড়িতে উঠে এলো গ্রামবাংলার ঘরের নিকোনো দেওয়ালের রং, আর পাড়ে এলো চালগুড়ি আলপনার চলাটি।

শাড়ি সৌজন্যে- শ্যাম বিশ্বাস

বেগুনি রংটি খুব পুরোনো। বেনিয়াসহকলার প্রথম রং। সত্যি বলতে এই রঙের মধ্যে কলমি ফুলের এক ছোঁয়া দেখতে পাই। যেমন সবুজ ধান খেতের আল বেয়ে যে কলমিলতা ধেয়ে যায় তার যে সাদা এবং বেগুনি রং সেটিই হয়ে উঠেছে আমার রঙের অনুপ্রেরণা। আর নৃত্যরত ময়ূর বাংলার স্থাপত্যে, আলপনায় এমনকি যদি আধুনিক ভাষায় গ্রাফিটি বলি তাতেও চিরকাল আছে যেমন বালুচরি গ্রাফিটি। আবার বিদ্যাপতি পদের ময়ূর হোক বা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উথলাকলাপি — আমার এই বেগুনি শাড়ির পাড়ে উজ্জ্বল মুক্তোর মতন সাদায় সেই ময়ূরের চলা। এমন ভাবে চলা শাড়িটি পরলে সোজায় উল্টোয় সেই নৃত্য ভঙ্গি দেখা যায়। আর পুরো শাড়ি জুড়ে দাবার ছকের মতন হাতে ঘোরানো চাটাই বুটি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

দেশভাগের পর পূর্ব-বাংলার টাঙ্গাইল জেলা থেকে ভিটে মাটি হারিয়ে বসাক, পাল প্রমুখ তাঁতী পরিবারগুলি এপারে নদিয়ার ফুলিয়ায় বসবাস শুরু করেন। আমরা বাংলার শাড়িতে একটা নতুন নাম পাই ফুলিয়ার টাঙ্গাইল। এই অপূর্ব সাংস্কৃতিক সংহতি ধীরে ধীরে ভারতের অন্য প্রদেশের শাড়ির মোটিভকেও নিজের অঙ্গীভূত করে নিতে থাকে। টাঙ্গাইল শাড়িতে আসে অসমের মেঘালয় বুটি, অঙ্গ-বঙ্গ-কলিঙ্গের প্রাচীন সংযোগ। এর ফলে একটি আধুনিক বয়ান রচিত হয়। এঁটেল মাটির রঙের ভূমিতে গঙ্গা-যমুনা পাড়ের একটি পাড়ের নাম কাজললতা, আরেকটি পোড়ামাটির রঙের। টাঙ্গাইলের সাবেকি নকশা পাড়ের উপরে রথ বা দাঁতের বদলে শাড়ির মূল চরিত্র অক্ষুণ্ণ রেখে আমি নিয়ে এলাম প্রদীপের গড়ন, অনেকটা দক্ষিণী শাড়ির ছায়ায়। নকশাকে নদীর মতো বইয়ে দেওয়া আরকি!

শাড়ি সৌজন্যে- শ্যাম বিশ্বাস

কথায় আছে, পুরোনো চাল ভাতে বাড়ে, আমার মনে হয় খুব গভীর সাংস্কৃতিক অর্থে সেটা সত্য। আসলে আমরা আজ যা নতুন বলে ধরে নিই তার ইতিহাস যদি ঘাঁটি দেখতে পাবো, তার বীজ হয়তো অনেক আগেই বুনে দেওয়া হয়েছিলো আমাদের যাপনের মাটিতে। সেটা বুনন শিল্পে হোক বা অন্য ক্ষেত্রে। আজ ‘ফ্যাশন ডিজাইনার’ আলাদা একটা পেশা এবং তা নিয়ে বিস্তর পড়াশোনা করার জায়গা আছে। আমরা যদি আজ থেকে একশো বছর আগে ফিরে দেখি দেখব, তখন ডিজাইনার বা স্টাইলার বলে কেউ ছিল না। অথচ যে সব তাঁতশিল্পীরা শাড়ি বুনতেন, তাঁদের হাতের ছোঁয়ায় এমন সব শাড়ি তৈরি হত তা আমাদের মতো পাশ করা অনেক নকশাকারদের দশ গোল দেবে।

আসলে সৃষ্টিশীল যেকোনো কাজই জীবন থেকে উঠে আসে। আমাদের দৈনন্দিন যাপনের স্বপ্ন, কামনা, অনুরাগ, ব্যথা থেকে উঠে আসে। সেটাই হয়তো দেখতে পাই পুরোনো দিনের শাড়ির নকশাতে। সে সব অলংকরণে জড়িয়ে থাকত তাদের জীবনের গল্প, মেয়েদের না বলা কথা। সেগুলো হয়ে ওঠে একটা সময়কালের সাংস্কৃতিক দলিল বা জীবনধারার ইতিহাস। সত্যজিৎ রায়ের শতবর্ষে তার সিনেমার চরিত্রদের শাড়ি নিয়ে যখন কাজ করলাম সেখানে দেখতে পেলাম কুঞ্জলতা পাড়ের শাড়ি, খড়কে ডুরে শাড়ি। পরবর্তীকালে করেছি পাছাপেড়ে শাড়ি। এইসব শাড়ি একান্ত এই বাংলার নিজস্ব বলে মনে হয়েছে। ব্রতের আলপনা আর শাড়ির পাড় দুই-ই উঠে এসেছে কৃষিভিত্তিক বাংলার লোকজীবনের মাটি থেকে। আমি এবারও যে সব শাড়ি তৈরি করেছি সেগুলো সম্পূর্ণ ভাবে তার শুদ্ধতাকে মাথায় রেখে। পুরোনোকে ফিরিয়ে আনা বা শেকড়ে ফিরে যাওয়া বা ফিরে তাকানোর প্রয়োজন আছে বলে বারবার মনে হয়। এই সর্বহারা, আত্মপরিচয় হীন  সময়ে দাঁড়িয়ে আরও বেশি করে মনে হয়। মনে হয় আশাকর্মী দিদির জ্যালজ্যালে পলিয়েস্টার শাড়ি দেখে। মনে হয় জন্মগ্রামের ইস্কুল ছাত্রীর পলিয়েস্টার ইউনিফর্ম দেখে। সেই জায়গা থেকেই এ কাজ করা। এবং প্রতিটি নকশাই সেই সময়কালের শুদ্ধ সৌন্দর্য আর খাঁটি আরামকে মনে করিয়ে দেবে। যেখানে কোনো বোমকাই পাড়ের সঙ্গে বালুচরি বা পৈঠানির আঁচলের ঢাকাই, শান্তিপুরি নকশার হযবরল মিশেল থাকবে না। এ শাড়ির নকশা আমাদের মনে করাবে ঠাকুমা, জেঠিমাদের তোরঙ্গে গুটি পাকিয়ে শাড়ির আমুট ছিঁড়ে রাখাকে।

শাড়ি সৌজন্যে- শ্যাম বিশ্বাস

কাজ এমনই হওয়া উচিত, যার গ্রহণযোগ্যতা থাকবে। একজন নকশাকার হিসাবে একটি সেতুর কাজ করছি মাত্র পুরোনো নকশাকে আবার ফিরিয়ে এনে আধুনিক সময়ের সঙ্গে তার যোগসূত্র তৈরি করা। আর এইসব শাড়িতে রঙের ব্যবহার এমন ভাবে করা হয়েছে যেখানে ‘আট থেকে আশি’ সবাই অনায়াসে জড়িয়ে নিয়ে পারবেন গায়ে এই শাড়ি। সেইসঙ্গে আজ জাতীয় হস্তচালিত তাঁত দিবস-এ আমরা স্মরণ করি হাতে বোনা তাঁতশিল্পীদের। তাঁদের শিল্পকে যেন আমরা মাথায় তুলে রাখতে পারি।

শ্যাম বিশ্বাস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.