দেশভাগ হয়েছে কাঁটাতারে খন্ড বিখন্ড হয়েছে বাংলা কিন্তু বেগম রোকেয়ার প্রজ্বলিত নারী জাগরণের আলোক শিখায় দুই বাংলার সরস্বতীরা আজও আলোকিত।
বেগম রোকেয়া৷
যাঁর জন্ম অখন্ড ভারতের রংপুর শহরের সাত মাইল দক্ষিণের পায়রাবন্দ গ্রামে৷ জমিদার পরিবার-বুঝতে অসুবিধা হয়না ধনাঢ্য,যাঁদের অন্তত সম্পদের অভাব নেই৷পিতা ছিলেন জ্ঞান পিপাসু কিন্তু তখনকার দিনে, স্বাভাবিক ভাবেই রক্ষণশীল ৷পর্দাপ্রথা এমনই ছিল যে ,এমনকি বহিরাগত মহিলাদের সামনেও বাড়ির মেয়েরা আসতে পারতেন না যখন-তখন৷ কঠোরতম অনুশাসনের সেই পরিবারের ছোট্ট মেয়ে রোকেয়ার লেখাপড়া শেখার অদম্য আগ্রহ দিয়েছিলেন ঈশ্বর৷মেম শিক্ষিকার কাছে তাঁর প্রাথমিক পাঠের শুরু কোলকাতায়, বড় বোনের শ্বশুরবাড়িতে!সেই যে জ্ঞানের প্রথমকলি , নিজ বাড়িতে ফিরে বড়ভাই ইব্রাহিম সাবের তাকে প্রস্ফূটিত হোতে সাহায্য করেছিলেন৷অতি গোপনে ,রাতের অন্ধকারে- মোমের আলোয় দাদার কাছে শিখতেন ইংরেজি!আদরের “রকু”কে বাংলা শিখিয়েছিলেন বড়বোন৷জ্ঞানের যে বিশাল পৃথিবী,সেখানে আরবী -ফারসী ভাষাকেও আয়াসে আপন করে নিয়ে ছিলেন
-রকু’ যখন বছর ষোলোর,মেয়েদের অনালোকিত জীবনে বিয়ের জন্যে সেটা ছিল অনেক বেশি বয়স!তাঁর বিয়ে হয়েছিল বিহারের ভাগলপুর নিবাসী সাখাওয়াত হোসেনের সাথে৷বিপত্নীক, উর্দুভাষী,চল্লিশ বছরের মানুষটি ছিলেন রংপুরের পরিবারটি থেকে অনেক আলাদা, কুসংষ্কারমুক্ত-উদার-শিক্ষানুরাগী এবং ধীর-গম্ভীর৷রোকেয়ার বিদ্যানুশীলন আর প্রতিভা বিকাশের উপযোগী পরিবেশ তৈরি আর আনুসঙ্গিক সমস্ত সহযোগিতা তিনি করেছিলেন – আমৃত্যু! সরোজিনী নাইডু সম্পাদিত “indian ladies magazine”পত্রিকায় রোকেয়ার একমাত্র উপন্যাস ‘পদ্মরাগ’সাখাওয়াতের উৎসাহেই প্রকাশিত হয়৷সাহিত্য জীবনের এই সাফল্যের মূহুর্তে স্বামীর চোখ নষ্ট হয়ে যায়৷বিহার থেকে কোলকাতা দীর্ঘ সময় স্বামীকে সুস্থ করার আপ্রাণ চেষ্টায় সাহিত্য রচনায় মন দিতে পারেননি তিনি!তারপর,তের বছরের যৌথ জীবনের সমাপ্তিতে রোকেয়া তখন একা- বড় একা!দুটি কন্যা সন্তান এসেছিল,বাঁচেনি৷তবু,ঊনত্রিশ বছরের রোকেয়ার জীবনে নতুন যাত্রা শুরু হল-ভয়হীন অন্তরে ,অচেনা জগতে৷সেখানে নিজের আসন জায়গা করে নিয়েছিল অসংখ্য বাঙালি পরিবারের মেয়েদের মনে -মননে৷
আমার দাদামশাই,অর্থাৎ মায়ের বাবা বঙ্কিম মজুমদারের বসতবাটি ছিল ফকিরহাট থানার মূলঘর গ্রামে৷ ইংরাজি শিক্ষায় শিক্ষিত এবং পাথুরেঘাটা জমিদারদের সেরেস্তার চাকুরে ছিলেন৷ নিজে গড়ে ছিলেন একক গ্রন্থাগার “সরস্বতী লাইব্রেরী৷”যেখানে কোলকাতা থেকে আনাতেন অসংখ্য বই-শুধু পড়তেন না,যাপিত জীবনে যার প্রয়োগ ছিল৷ নিজ কন্যাদের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের উঁচু ক্লাস অবধি পড়িয়েছেন৷ইংরাজী পড়াতেন,অল্প বয়সে বিয়ের বিপক্ষে ছিলেন৷ তাঁর সামনে উজ্জ্বলভাবে উপস্থিত ছিলেন “বেগম রোকেয়া!”
দাদামশাইএর কাছ থেকে সেই সময়ের অন্য অনেকের জীবনবোধ আত্মস্থ করার সাথে সাথে আমার মা রোকেয়া জীবনকেও আপন করে এক করে নিয়েছিলেন৷খুব দ্রুত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে বাংলার চিরকালীণ সমাজের পরিবর্তন হয়ে গেল৷আমার মায়ের বিবাহও সেই পরিবর্তনের প্রত্যক্ষ প্রতিফলন৷আমার মাও তাঁর স্বল্পকালের বিদ্যালয়ের পাঠের সাথে বিপুল জীবনবোধ নিয়ে নতুন সংসার শুরু করলেন৷
মায়ের জীবনেও এসেছিল অসংখ্য বাঁধা-যন্ত্রণা -দুঃখ , আর অবশ্যই “একাত্তর”! মায়ের মনে ছিলেন অসংখ্য উদাহরণময়ী নারী এবং বেগম রোকেয়া -যাঁরা হার মানতে বলেননি৷আমার মাও তাঁর কন্যাদের ইংরেজি শিক্ষার জন্যে চেষ্টা করতেন,লেখাপড়ায় এগিয়ে থাকতে বলতেন..আর অল্প বয়সে বিয়ে দেবার কথা চিন্তায়ও আনেননি৷
দাদামশাই “হিন্দুস্থানে””যাবার সময় “সরস্বতী লাইব্রেরী”র সমস্ত বই দিয়ে যান তাঁর কন্যাকে৷একাত্তরের পরে “সরস্বতী লাইব্রেরী” আর নতুন কিছু বই নিয়ে আমাদের বাড়িতে গঠিত হয় “অজিয়র লাইব্রেরী৷”অসংখ্য লেখক আর অজস্র বই৷সেই বই জোয়ারে আমার বালিকা হৃদয়ে সব থেকে চোখ টানত যাঁর ছবি,তিনি “বেগম রোকেয়া” ৷ পড়ার থেকে তাঁকে দেখতাম বেশি—এত্ত সুন্দর!অবাক চোখে ভাবতাম৷তারপর ধীরে ধীরে একদিন সংসারের জটিল আবর্তে পড়ে গিয়ে উত্তরণের পথের দিশা পরোক্ষে হয়ত তাঁর কাছ থেকেও পাওয়া৷ আমাদের পরিবারের জানিতে বা অজানিতে তিন প্রজন্মের অনুপ্রেরণা তিনি৷
বাংলার পশ্চিমে যেমন “ভগিনি নিবেদিতা”,পূর্বে তেমন বেগম রোকেয়া৷ ভাগাভাগির সীমারেখাকে ছাড়িয়ে,যাঁরা শুধু আলো দেখাননি ,নিজেরাই আজও হয়ে আছেন অন্তহীন পথের — আলোক শিখা!