মোদী সরকারের সাফল্য বিস্ময়কর

পাঁচ বছর আগে বিপুল ভোটে জিতে কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসে বিজেপি সরকার। বিজেপির। নির্বাচনী প্রচার সমিতির প্রধান নরেন্দ্র মোদী ভারতবাসীকে দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন, সুশাসনের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। পরবর্তী পাঁচবছর ভারতবর্ষ দেখেছে সমস্ত শক্তি দিয়ে ভারতবর্ষের উন্নয়ন ঠেকাতে বিরোধীদের কী অকল্পনীয় প্রচেষ্টা, বহিঃশত্রুদের থেকেও এমন বিরোধিতা আসে না যতটা এসেছিল বিরোধী দলগুলোর কাছ থেকে। যেন তেন প্রকারেণ দিল্লির দখল করা ছিল যাদের মূল লক্ষ্য। ভারতবাসী এদের সর্বতো ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছেন বোঝা গেল পাঁচ বছর পরে ২০১৯-এ। নির্বাচনী ফলাফল বলে দিচ্ছে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার বিগত ৫ বছরে আরও কত বিপুল পরিমাণ জনপ্রিয়তা লাভ করতে সমর্থ হয়েছে। আজ পরাজিত, হতোদ্যম, ব্যর্থ বিরোধীরা অভিযোগ তুলছে দেশপ্রেমের জিগিরেই নাকি বিজেপি এই বিপুল সাফল্য লাভ করেছে। বিরোধীরা যদি নিজেদের ঘোরতর দেশদ্রোহী প্রতিপন্ন করেন ভারতবাসীর কাছে, শুধুমাত্র তখত দখলের নেশায় মত্ত হয়ে, তবে ভারতবাসী তাদের বর্জন করবেনই। কিন্তু গত পাঁচ বছরে নরেন্দ্র মোদী যে একের পর এক সামাজিক প্রকল্পের বাস্তব রূপায়ণঘটাতে সফল হয়েছেন, তাতে বিজেপির ভোটের লাভটা বড়ো কথা নয়। ভারতবর্ষ মোদীর এই চেষ্টায় সামাজিক ভাবে আরও অনেক দুর অগ্রসর হয়েছে, যে শক্ত ও সমর্থ ভারতবর্ষ আপামর দেশবাসীর স্বপ্ন,তাও এর ফলে বাস্তবায়নের পথে। আর সেই কারণেই মোদী সরকারের জনপ্রিয়তা উত্তরোত্তর বাড়ছে।
এই কথা বোঝা দরকার সামাজিক প্রকল্পের রূপায়ণ কর্মসূচি কোনও স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনা হতে পারে না। এর জন্য উপযুক্ত পরিকল্পনা যেমন প্রয়োজন, তেমন দূরদৃষ্টিও।
মোদী সরকারের সামাজিক প্রকল্পগুলি প্রমাণ করছে ক্ষমতায় আসার আগে থেকেই সামাজিক উন্নয়নে তাদের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ছিল। মোদীর ক্ষমতায় আসার প্রথম তিন বছরে বিভিন্ন সামাজিক প্রকল্পের চালচিত্রটা দেখলেই তা মালুম হয়। ২০১৪-র ২৮ আগস্ট চালু হয়েছিল জনধন যোজনা। লক্ষ্য ছিল যত বেশি সম্ভব ভারতবাসীকে ব্যঙ্কিং পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত করা। ওই একই দিনে চালু হয়েছিল ‘স্কিল ইন্ডিয়া। মিশন’, লক্ষ্য ভারতীয় যুবক-যুবতীদের প্রতিভা খুঁজে বের করা। ২৮ সেপ্টেম্বর ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ প্রকল্পের সূত্রপাত হয়, যার লক্ষ্য দেশের শিল্পোৎপাদন ক্ষেত্রকে আরও প্রসারিত করা।
২০১৪-র ২রা অক্টোবর স্বচ্ছ ভারত মিশনের সূত্রপাত, গান্ধীজীর জন্মদিনকে স্মরণে রেখে। নির্মল ভারত গঠনের দিকে আরও একধাপ এগোনোর প্রক্রিয়া। ২০১৪-র ১১ অক্টোবর ভারতবর্ষের গ্রামের সামাজিক উন্নয়ন, সাংস্কৃতিক উন্নয়নের দিকে লক্ষ্য রেখে নতুন প্রকল্প সংসদ আদর্শ গ্রাম যোজনা। ১৬ অক্টোবর ঘোষিত হলো আরও প্রকল্প, শ্রমজীবী মানুষের দিকে লক্ষ্য রেখে, শ্রমিক জয়তে যোজনা। ২০১৫ সালের শুরুতে ২২ জানুয়ারি শুরু হলো ‘বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও’। লক্ষ্য, ছাত্রী ও যুবতীদের আর্থিকভাবে স্বনির্ভর ও শিক্ষিত করে তোলা। তার আগে ২১ জানুয়ারি শুরু হয়েছিল হৃদয় পরিকল্পনা, লক্ষ্য ছিল ভারতের অন্তর্গত বিশ্বের ঐতিহ্যবাহী স্থানগুলিকে আর্থিকভাবে স্বনির্ভর করে তোলা।
৮ এপ্রিল শুরু হলো প্রধানমন্ত্রী মুদ্রা যোজনা ! ছোটো ব্যবসায়ীদের ৫০ হাজার টাকা থেকে ১০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত ঋণদানের প্রস্তুতি। পয়লা মে ঘোষিত হলো উজ্জ্বলা যোজনা, বাড়ি বাড়ি কম দামে এল ই ডি আলো পৌঁছে দেবার পরিকল্পনা। ৯ মে চালু হলো অটল পেনশন যোজনা, অসংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মরত ১৮ থেকে ৪০ বছর বয়সীদের জন্য অবসরকালীন ভাতা পরিকল্পনা। ওই দিনেই ঘোষণা হয় প্রধানমন্ত্রী জ্যোতিবিমা যোজনা। ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সি লোকদের জন্য ২ লক্ষ টাকার জীবনবিমা প্রকল্প, ৩৩০ টাকা বার্ষিক প্রিমিয়ামের ভিত্তিতে। ওই একইদিনে প্রধানমন্ত্রী সুরক্ষা বিমা যোজনার সূত্রপাত। বছরে মাত্র ১২ টাকার প্রিমিয়ামের বিনিময়ে ১৮ থেকে ৭০ বছর বয়সী মানুষদের জন্য দুর্ঘটনা বীমা। ২০১৫-র ২৬ জুন এল স্মার্ট শহর প্রকল্প, যার লক্ষ্য আগামী পাঁচ বছরে দেশের একশোটি শহরকে স্মার্ট শহর, অর্থাৎ আধুনিক সুযোগ-সুবিধাযুক্ত যুগপোযোগী করে গড়ে তোলা। পাশাপাশি ওইদিনই ঘোষণা হলো আমৃট প্রকল্পের, যার মাধ্যমে লক্ষাধিক মানুষের বসবাসযুক্ত পাঁচশোটি শহরের উন্নয়ন কর্মসূচি ২ জুলাই ডিজিটাল ইন্ডিয়া মিশনের সূত্রপাত। আধুনিক কারিগরি জ্ঞানের প্রতিফলন এতে দেখা যায়। ৫ নভেম্বর স্বর্ণ পুনর্ব্যবহার প্রকল্পের সূচনা হয়। ঘরে বা ব্যাঙ্কের লকারে থাকা অব্যাবহৃত সোনাকে অর্থকরীভাবে কাজে লাগানোর পরিকল্পনা। একই সঙ্গে চালু হয়েছিল সার্বভৌমিক স্বর্ণ বন্ড যোজনা।
২০১৬ নতুন বছরের শুরুতে ১৬ জানুয়ারি ‘স্টার্ট আপ ইন্ডিয়া’ কর্মসূচি, নতুন উদ্যোগকে স্বাগত জানাতে নেওয়া হয়। ২০১৬-র ৪ মার্চ সেতু ভরতম্ যোজনা, জাতীয় সড়ক ও রেলওয়ে ক্রসিংয়ে সেতু নির্মাণ করে যাতায়াতের পথ সুগম করা ও দুর্ঘটনা এড়ানো ছিল এই কর্মসূচির লক্ষ্য। ৫ এপ্রিল চালু হলো ‘স্ট্যান্ড আপ ইন্ডিয়া’, তপশিলি জাতি, উপজাতি ও মহিলাদের শিল্পোদ্যোগের জন্য ১ লক্ষ থেকে ১ কোটি টাকা ঋণের ব্যবস্থা। ১৪ থেকে ২৪ এপ্রিলের মধ্যে সূচনা হলো গ্রামোদয় সে ভারত উদয়’ প্রকল্পের। লক্ষ্য দেশের উন্নয়নের জন্য গ্রামোন্নয়নে জোর দেওয়া। ১ মে প্রধানমন্ত্রী উজ্জ্বলা প্রকল্প যার লক্ষ্য দারিদ্র্য সীমার নীচে বসবাসকারীদের ঘরে ঘরে আলো পৌঁছে দেওয়া। ৭ জুলাই নির্মল গঙ্গা যোজনার মাধ্যমে গঙ্গার পরিচ্ছন্নতা রক্ষার প্রকল্প। সব মিলিয়ে ক্ষমতায় আসার বছর দুয়েকের মধ্যেই মোদী সরকার তার সামাজিক প্রকল্পগুলির কর্মসূচি হাতে নিয়ে ফেলে।
এই বিষয়টি অত্যন্ত জরুরি। ভারতেরমতো একটি তৃতীয় বিশ্বের দেশে যে কোনও সামাজিক পরিকল্পনাই দীর্ঘমেয়াদি সময়ের ভিত্তিতে নেওয়া প্রয়োজন। কারণটা সবাই বুঝতে পারবেন, তা হলো অর্থের অপ্রতুলতা। কিন্তু এই সামাজিক প্রকল্পগুলি রূপায়িত হলে আর্থিক সমস্যা ঘুচবে, সমৃদ্ধি ও শান্তি সূচক বৃদ্ধি পাবে। আজ ভারত বিশ্বের পঞ্চম বৃহৎ অর্থনীতির আসনে অধিষ্ঠিত। মোদী সরকারের সূচারু পরিকল্পনা, দেশকে অর্থনৈতিক ভাবে যেমন সাবলম্বন এনে দিয়েছে, তেমন ভারতবর্ষের সামাজিক সমৃদ্ধির দিকেও অনেকদূর এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে।
যত দিন গেছে তত একের পর এক সামাজিক প্রকল্প ভারতবাসীকে উন্নততর জীবনের সন্ধান দিয়েছে। যেমন ধরা যাক প্রধানমন্ত্রী জন আরোগ্য যোজনার কথা। ২০১৮-র সেপ্টেম্বরে এই প্রকল্পটি গৃহীত হয়। প্রকল্প অনুযায়ী প্রত্যেক পরিবারের জন্য বার্ষিক পাঁচ লক্ষ টাকা স্বাস্থ্য বিমার ব্যবস্থা করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের হিসাব অনুযায়ী ১০ কোটি ৭৪লক্ষ গরিব ও হতদরিদ্র পরিবারের ৫০ কোটি মানুষ এর ফলে উপকৃত হবেন। ন্যাশনাল হেলথ অথরিটি বলছে, এ বছরের মে মাস পর্যন্ত প্রায় ২৭ কোটি মানুষ এই প্রকল্পে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এবং এ ব্যাপারে এখনও পর্যন্ত ৩৫০০ কোটি টাকা খরচ হয়েছে এখনও পর্যন্ত।
প্রধানমন্ত্রী কৃষক সম্মান নিধি প্রকল্পের সূত্রপাত হয়েছে এবছরের ফেব্রুয়ারিতে। এজন্য বার্ষিক বরাদ্দের পরিমাণ ৮৭ হাজার ২০০ কোটি টাকা। উপকৃত হবেন প্রায় সাড়ে চৌদ্দ কোটি কৃষক। প্রথম পর্যায়ে ৩ কোটি ১০ লক্ষ ও দ্বিতীয় পর্যায়ে ২ কোটি ৬০ লক্ষ সব মিলিয়ে ৫ কোটি ৭০ লক্ষ কৃষককে আপাতত সরাসরি নিয়ে আসা হবে এই প্রকল্পের আওতায়, তেমনটাই জানাচ্ছে। কেন্দ্রীয় কৃষি মন্ত্রক। ক্ষমতায় আসার পরই চালু করা মোদীর কিছু প্রকল্পের দিকে এবার চোখ ফেরানো যাক। ২০১৬-র মে মাসে চালু হওয়া প্রধানমন্ত্রী উজ্জ্বলা যোজনার লক্ষ্যমাত্রা ছিল প্রাথমিক ভাবে ৮ কোটি মানুষের কাছে পোঁছনো। এর জন্য ব্যয় বরাদ্দ ছিল ১২ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। রাইসের করা একটি গ্রামীণ সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে যে ৮৬ শতাংশ মানুষের মতে স্টোভে রান্নার থেকে কাঠের উনুনেই তারা রান্না করতে অনেক বেশি স্বাচ্ছন্দ্য। আবার ৩২ শতাংশ মানুষ বলছেন কাঠের উনুনের রান্না তাদের অনেক বেশি স্বাদু মনে হয়। ৩৬ শতাংশ মানুষ এখনও উনুনেই রাঁধেন। ২৭ শতাংশ রান্নার গ্যাসে। আর ৩৭ শতাংশ গ্যাস ও উনুন— দুটিতেই রান্না করেন। কেন্দ্রীয় পেট্রোলিয়ম ও প্রাকৃতিক গ্যাস মন্ত্রকের হিসাব অনুযায়ী ২০১৮-য় পরিবার পিছু গ্যাস দেওয়া হয়েছে বছরে ৩.৪টি, প্রকল্প-বহির্ভূত পরিবার পিছুবছরে গ্যাস নেওয়ার পরিমাণ ৭.৩টি। একটা কথা আমাদের বোঝা দরকার, যে কোনও সামাজিক পরিবর্তনেই সময় প্রয়োজন। মা-বোনেদের উনুনে তেতে-পুড়ে রান্না করার কষ্টের হাত থেকে রেহাই দিতে ঘরে ঘরে গ্যাস পোঁছে। দেওয়ার যে কর্মসূচি কেন্দ্র সরকার গ্রহণ করেছিল, অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে দেশবাসীর সচেতনতাই পারতো তাকে সাফল্যের শিখরে নিযে যেতে, যা একদিনে হয় না।
এবার ভোটের প্রাক্কালে মোদী বলেছিলেন, পাঁচ বছরে দেশ এতটা পাল্টে যাবে ভাবিনি। নিন্দুকেরা হেসেছিল। কিন্তু ভারত ভাগ্যবিধাতাও বোধহয় পাল্টা মুচকি হেসেছিলেন। কারণ এই ধরনের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় যে ধৈর্য স্থৈর্যের প্রয়োজন হয়, তার একশতাংশ বিরোধীরা বিগত দিনে সরকারে থাকার সময় দেখাতে পারলে দেশকে এতটা দুরবস্থার মধ্য দিয়ে যেতে হতো না। মোদীর স্বপ্নের প্রকল্প স্বচ্ছ ভারত মিশনে ১০ কোটি গৃহ-শৌচালয় তৈরি হয়েছে এখনও পর্যন্ত, যার মধ্যে গ্রামীণ এলাকায় ৯ কোটি ২৮ লক্ষ, শহরে ৫৮ লক্ষ। এছাড়া জন শৌচালয়ও তৈরি হয়েছে ৪ লক্ষ ৮০ হাজারটি। এ তো মামুলি পরিসংখ্যান মাত্র।
রাইসের একটি তথ্য অনুযায়ী এসব সত্ত্বেও মানুষের অভ্যেস বদলানোই আপাতত সবচেয়ে বড়ো চ্যালেঞ্জ, গ্রামের ৪৩ শতাংশ মানুষ আজও খোলা স্থানে শৌচকর্ম করেন। শৌচালয় থাকা সত্ত্বেও ২৩ শতাংশ গ্রামীণ মানুষ তা ব্যবহারে এখনও স্বচ্ছন্দ নন। সুতরাং যে প্রকল্পের বয়স ছ’বছর হয়ে গেল তবুমানুষের সচেতনতা আনা কতটা কষ্টসাধ্য তা বোঝাই যাচ্ছে ওপরের পরিসংখ্যানে। মোদী সরকার ভোটের স্বার্থে কোনও কিছু করেননি। তার সমস্ত লক্ষ্য ২০২০, ২০২২ বা ২০২৫ সালকে কেন্দ্র করে। ভোটমুখী হলে তা ২০১৯ অবধি হতো বড়োজোর। তাই রাজনৈতিক গিমিক নয়, দেশের স্বার্থেই মোদী সরকারে সামাজিক অবদানকে বিবেচনা করা উচিত। তিন তালাকের ক্ষেত্রে মোদী সরকারের পদক্ষেপকেও এই অভিমুখ থেকে দেখা দরকার। একইভাবে স্মার্ট শহর প্রকল্পে মোদী-সরকারের স্থায়ী পদক্ষেপ ভারতকে জগৎসভায় গুরুত্বপূর্ণ আসনে অভিষিক্ত করেছে।
অভিমন্যু গুহ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.