Story image

যে কোনো জানলায় সাধারণত দুটো পাল্লা থাকে। ফলে বাইরে আর ভিতরে অলক্ষ্যেই জানলার চারটি অংশ তৈরি হয়ে যায়। আধুনিক মনোবিজ্ঞানের ধারণা অনুযায়ী মানুষের মনেরও স্পষ্টত তেমনই চারটি ভাগ। ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটির দু’জন বিখ্যাত সাইকোলজিস্ট জোসেফ লাফ্ট এবং হারেভিংটন্ ইঙ্গহাম-এর মতে মানবমনের বিভাজন সংক্রান্ত এই চমকপ্রদ ধারণা ‘জেহারি উইন্ডো’ অনুযায়ী আমাদের মন ‘ওপেন-এরিয়া’, ‘ব্লাইন্ড-এরিয়া’, ‘হিডেন-এরিয়া’ এবং ‘আননোন-এরিয়া’ এই চারভাগে বিভক্ত। নাম থেকেই আন্দাজ করা যায় এই চারভাগের মধ্যে সবচেয়ে বিভ্রান্তিকর ওই আননোন-এরিয়া অর্থাৎ মনের সেই অংশ যা আমরা নিজে তো জানিই না, এমনকি অন্যরাও জানে না। পৃথিবীর যাবতীয় কাজের অন্যতম কঠিন কাজ আমাদের মনের এই না জানা অংশকে জানার এবং বোঝার চেষ্টা।

প্রাথমিক এ তথ্যগুলোকে মাথায় রেখেই যদি উনিশ শতকের কলকাতায় দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের এক দরিদ্র, ব্রাহ্মণ পূজারী শ্রীরামকৃষ্ণের ঘরে উপস্থিত হওয়া যায়, বোঝা যাবে, আধুনিক মনের বিভাজন সংক্রান্ত তত্ত্ব ‘জোহারি উইন্ডো’-র মূর্তিমান প্রকাশ যেন সে ঘর। জাতপাত নির্বিশেষে সাধারণ ছাপোষা মানুষ থেকে শুরু করে সমাজে প্রতিষ্ঠিত নামী ডাক্তার, শিক্ষক, উকিল, ব্যবসায়ী, সমাজসংস্কারক, আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত এক ঝাঁক তরুণ, ধর্মগুরু প্রমুখ শ্রীরামকৃষ্ণের অদম্য আকর্ষণে এ ঘরে ছুটে এসেছেন বারবার। কারণ এখানে এঁরা প্রত্যেকেই তাঁদের মনের ওই ‘আননোন এরিয়া’-কে জানার পাঠ পেয়েছেন যে যার নিজের মতো করে। নাতিদীর্ঘ একটি মানব জীবনভর শ্রীরামকৃষ্ণ জীবনের সার স্বরূপ যে যে সত্যিগুলো সমকাল এবং অনাগত ভবিষ্যতের সামনে তুলে ধরতে চেয়েছেন, তার মূলেই আছে নিজের এই না চেনা ‘আমি’টাকে চিনতে, জানতে চেষ্টা করার কথা। এখানেই শ্রীরামকৃষ্ণ যেন এক অতি আধুনিক মনোবিজ্ঞানী। তিনি প্রত্যেকের মন বুঝে যার জন্য যে ধরনের থেরাপি প্রয়োজন তার জন্য সেরকম কথাই বলছেন। কথামৃতের পাতায় একই সমস্যায় গৃহীদের জন্য তাই একরকম নিদান, সংসার ত্যাগীদের জন্য আবার ভিন্ন। আর এসব কিছুই শ্রীরামকৃষ্ণ করছেন গল্পের ছলে, গান গেয়ে, হাসতে হাসতে, বাস্তব জীবন থেকে উদাহরণ তুলে, একেবারে চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে বুঝিয়ে। এভাবে অজান্তেই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অগুনতি মন পরিবর্তন হয়েছে। অথচ মন পরিবর্তনের কাণ্ডারি সে মানুষটি সব বুঝে, সব জেনেও যেন কিছুই করেননি, কিছুই বোঝেননি এই ভাব নিয়ে তখনও মশকরা করে গেছেন তাঁর কাছে আসা মানুষগুলির সঙ্গে। কোথাও একটুও এই ‘বুঝিয়ে বলা’ ভাব নেই শ্রীরামকৃষ্ণ জীবনে। এখানেই আধুনিক মনোবিজ্ঞান যে অনুসরণ করে শ্রীরামকৃষ্ণকে, তার প্রমাণ শ্রীরামকৃষ্ণ এবং তাঁর কাজকর্ম ও আচরণ সম্পর্কে বিশ্বের তাবড় সাইকোলজিস্ট, সাইক্রিয়াটিস্ট, বিহেভিয়ারিস্ট প্রমুখদের বক্তব্য।

নিজের জীবনে কেবল বইপড়া, অন্তঃসারশূন্য হৃদয়ে লম্বা-চওড়া কথা, বুঝিয়ে বলার ঘোরতর বিরোধী ছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ। সাকার নিরাকার প্রসঙ্গে মাস্টারমশাই অর্থাৎ কথামৃতকার মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত যখন তাঁকে বলছেন, যারা মাটির প্রতিমা পুজো করেন তাদের তো বুঝিয়ে দেওয়া উচিত তারা মাটির অবয়বের সামনে আসলে চিন্ময় ঈশ্বরের আরাধনা করছেন, এক লহমায় শ্রীম’র সেই ফাঁপা অহংকার চূর্ণ করছেন শ্রীরামকৃষ্ণ। বলছেন, “তোমাদের কলকাতার লোকের ঐ এক! কেবল লেকচার দেওয়া, আর বুঝিয়ে দেওয়া। আপনাকে কে বোঝায় তার ঠিক নেই! তুমি বুঝাবার কে?…”। কোনো বিষয়ে অর্ধেক বুঝে বা জেনে অন্যকে যেনতেন প্রকারে তা বোঝাতে যাওয়ার যে এক বালখিল্য স্বভাব আমাদের, তা যে আদতে বোঝাবুঝির দিক থেকে কত গণ্ডগোলের এবং এভাবে পরের মুখের ঝাল খেয়ে যে আদৌ কিছু জানা যায় না, সেই ভাবনাটাকে কী স্পষ্ট ভাষায় বলে দিলেন রামকৃষ্ণদেব! ব্রাহ্মসমাজের সুবক্তা কেশবচন্দ্র সেন যখন হিন্দুধর্মকে আচার, সংস্কার, কুসংস্কারের পাঁক থেকে বের করে ব্রহ্মের মুখোমুখি করতে চাইছেন, ব্রহ্ম খায় না গায়ে মাখে তা না জানা সমাজের কাছে, সেখানেও রাশ ধরলেন শ্রীরামকৃষ্ণ। কেশব সেনকে বোঝালেন একলাফে ছাদে ওঠা যায় না। ‘ব্রহ্মাস্মি’ শুধু মুখে বললেই ক্ষুদ্র এই দেহবোধ যাবে না। বৃহতের অংশ বলে নিজেকে পরিচয় দিতে গেলে আগে নিজেকেই বৃহৎ হয়ে উঠতে হবে। রামকৃষ্ণদেব তাই শেখালেন, ‘আমার মতই শ্রেষ্ঠ’ এই ছেঁদো বুদ্ধি ত্যাগ করে কীভাবে একই গন্তব্যে পৌঁছনোর বিবিধ পথকে মান্যতা দিতে হয়। স্বার্থযুক্ত ‘আমি’ময় জঞ্জাল ছেঁটে ফেলে কেমন করে সমগ্রতায় নিজেকে মিশিয়ে দিতে হয় শ্রীরামকৃষ্ণের এই শিক্ষারই তো বাস্তবোচিত উদাহরণ তাঁর সবচেয়ে প্রিয় পাত্র নরেন্দ্রনাথ তথা বিশ্ববন্দিত স্বামী বিবেকানন্দের জীবন। মনোবিজ্ঞানের উল্লেখযোগ্য ‘গেস্টাল্ট থিয়োরি’র সঙ্গে রামকৃষ্ণদেবের এই সমগ্রতা বোধের আশ্চর্য এক মিল খুঁজে পাওয়া যায়। এই তত্ত্বেরও মূল কথা পৃথিবীতে মানুষের অভিযোজন হয়েছে তার অন্তর্দৃষ্টির সামগ্রিক পরিবর্তনের জন্যই, আর তাই মানুষ ক্রমাগত নিজেকে পেরিয়ে যেতে চাইছে। এই পেরিয়ে যাওয়াই শ্রীরামকৃষ্ণের মতে ‘মানুষ’ হওয়া।

শারীরিক ও মানসিক রোগে জীর্ণ এই পৃথিবীর আধুনিক মানুষের জন্য প্রেসক্রিপশন লিখতে গিয়ে রামকৃষ্ণদেব কেবল একটি কথাই লিখে গেছেন, তা হল মন। মনটাকে নিয়েই আমাদের যত বিপত্তি। সেই মনটাকে নিজের নিয়ন্ত্রণে আনার, তাকে চেনার, জানার, চিন্তা করার প্রক্রিয়াকে মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার শিক্ষাই নিজের সহজ সরল গ্রাম্য ভাষায় বলে গেছেন তিনি। মানসিক অস্থিরতা ও অসুস্থতার চিকিৎসায় বর্তমানে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ও প্রচলিত থেরাপি হল ‘CBT’ বা কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি। এই থেরাপির মূল কথা মানুষের চিন্তা করার ধরন পরিবর্তন করলে তার আচরণেরও পরিবর্তন হবে। পারিবারিক অশান্তি, মৃত্যুশোক এবং অন্যান্য বিভিন্ন কারণে মাস্টারমশাই মহেন্দ্রনাথ যখন নিজের জীবন শেষ করে দেওয়ার আগে নিরিবিলিতে একবার দক্ষিণেশ্বরে সময় কাটিয়ে আসবেন বলে শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে পৌঁছেছিলেন, সেই দিন থেকে তিনি যেন শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসের এই CBT থেরাপির মধ্যে পড়ে গেলেন। নিত্য-অনিত্য, বিদ্যা-অবিদ্যা, ধর্ম-অধর্ম আসলে কী, প্রকৃত জ্ঞান কোনটা, অজ্ঞানই বা কোনটা! জীবন কেমন, জীবন কেন; এরকম হাজারও বিষয়ে একের পর এক কথা বলে গেলেন রামকৃষ্ণ পরমহংস। চিন্তা প্রক্রিয়ার আমূল পরিবর্তন হল মহেন্দ্রনাথের, ফলে তাঁর আচরণেরও পরিবর্তন হল, মৃত্যুচিন্তা কোথায় দূরে চলে গেল। আর তাই-ই হয়তো, ভাবীকাল উপহার পেল আধুনিক পৃথিবীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মনোবিদ শ্রীরামকৃষ্ণের ‘কথামৃত’।

কাশীতে যাওয়ার সময় জশিডির রাস্তায় হতদরিদ্র দেহাতি মানুষগুলোর করুণ অবস্থা দেখে ছোটো ভটচায গদাই ঠাকুর তাঁর সেজোবাবু মথুরমোহনের কাছে প্রশ্ন রাখলেন, কেন এত মানুষ নিরন্ন থাকে আমাদের দেশে। এ প্রশ্নের কাছে তখন অসহায় রানি রাসমণির সেজোজামাই। শ্রীরামকৃষ্ণ জেদ ধরলেন এই দুঃস্থ নারায়ণকে না খাওয়ানো পর্যন্ত তিনি এদের ছেড়ে কোন তীর্থদর্শনের পুণ্যেই যাবেন না। চোখের জলে তখন বিবেকের মুখোমুখি দাঁড়ালেন মথুরবাবু। তারপর নরনারায়ণের সেবা পরমহংসদেবের কথা মতোই সুসম্পন্ন হয়েছিল সেদিন। আধুনিক বিহেভিয়ারিস্ট বি.এফ.স্কিনার মানুষের আচরণের গুরুত্বপূর্ণ দিক সমানুভূতি ও করুণা অর্থাৎ ‘কম্প্যাশন’-এর উদাহরণ দিতে গিয়ে তাঁর বই ‘Beyond Freedom and Dignity’-তে শ্রীরামকৃষ্ণের এই মানসিকতারই উল্লেখ করে বলেছেন, “his feelings were not a by-product of effective action; with all the power of his samadhi he had nothing to offer but compassion।”

১৯৯৬সালে আন্তর্জাতিক ডেলর কমিশন ‘লার্নিং : দি ট্রেসার উইদইন’ বলে যে রিপোর্ট পেশ করে, তাতে জীবন কুশলতা বা লাইফ স্কিলের জন্য যে চারটি স্তম্ভ নির্ধারণ করা হয় তার প্রথমটিই ছিল ‘লার্নিং টু নো’ (learning to know)। আর এই ‘নো’ বা জানার মূল শর্ত হিসেবে যে বিষয়টিকে চিহ্নিত করা হয়েছে তা হল ‘আত্ম সচেতনতা’ বা ‘সেল্ফ কনশাসনেস’ তথা ‘অ্যাওরনেস’। কাশীপুর উদ্যানবাটীতে জীবনের একেবারে শেষ পর্বে শ্রীরামকৃষ্ণ যখন বলেন, ‘তোমাদের চৈতন্য হোক’, বিস্মিত হয় পৃথিবী। কারণ এই ‘কনশাসনেস’ বা চেতনার আলোয় জ্বলে উঠবে বলেই তো যুগ থেকে যুগে মানুষ চোখ মেলে, সৃষ্টি করে, সৃষ্ট হয়।    

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.