সত্যজিৎ রায়কে থেকে থেকেই মনে হত বাংলার শেষ ইংরেজ। বিখ্যাত মার্কিন পত্রিকা আশির দশকে তাঁকে নিয়ে ‘দ্য লাস্ট ইংলিশম্যান’ শিরোনামে স্টোরি করার বহু আগে থেকেই।

ওই অনুভূতিরই অন্য অংশটা বসন্ত চৌধুরীকে নিয়ে। যখনই দেখেছি ভদ্রলোককে ওঁর কেতাদুরস্ত জমিদার বেশে মনে হয়েছে বাঙালির ইতিহাস কিংবা তেমন কোনও উপন্যাস থেকেই উঠে এলেন বুঝি এই মাত্র।

আশির দশকের শেষ দিক আর নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি অবধি যখন খুব ঘন ঘন আঁচে দেখা হচ্ছে তখন অনুভূতিটার সঙ্গে একটা আশঙ্কাও জুড়ে গেল। হায় রে, এই বসন্ত চৌধুরী বাংলার শেষ বাঙালি হয়ে পড়ছেন না তো!

আভিজাত্য উচ্চশিক্ষা পৌরুষের অনবদ্য মেলবন্ধন বসন্ত চৌধুরী। বাংলা ছবির আভিজাত্যপূর্ন অভিনেতা। ‘ক্লাস’ কি জিনিস বুঝিয়ে দিতেন। বসন্ত চৌধুরী মানেই কেতাদুরস্ত জমিদার বেশ। মনে হয়েছে বাঙালির ইতিহাস উপন্যাস থেকে উঠে এলেন বুঝি এই মাত্র। বসন্ত চৌধুরীর বাঙালিয়ানার শুরুই হত পোশাক-আশাক, চেহারায়। কন্দর্পকান্তি চেহারার সঙ্গে আমে-দুধের মতো মিশত গলার ভারী আওয়াজ। শরীরের শান্ত চলন এবং অতলস্পর্শী চাহনি। চওড়া কপাল থেকে পায়ের বিদ্যাসাগরী চটি অবধি এক পূর্ণ বাবুটি। শখ ছিল শাল ও গনেশ মূর্তি সংগ্রহর।

শেষ ইংরেজ হয়ে পড়তে সত্যজিৎকে সারাক্ষণ সু্ট-বুট-টাই চড়াতে হয়নি। ঢোলা পাজামা-পাঞ্জাবিতেও একটা সাহেবসুবো ব্যাপার জড়িয়ে থাকত। কথা, কথার ভাবভঙ্গি উচ্চারণ, হাঁটাচলা, দাঁড়ানো, তাকানো – কীসে নয়?

বসন্ত চৌধুরীর বাঙালিয়ানার শুরুই হত পোশাক-আশাক, চেহারায়। কন্দর্পকান্তি চেহারার সঙ্গে আমে-দুধের মতো মিশত গলার ভারী গোল আওয়াজ। শরীরের শান্ত চলন এবং গভীর চাহনি। চওড়া কপাল থেকে পায়ের বিদ্যাসাগরী চটি অবধি এক পূর্ণ বাবুটি।

এ তো গেল দর্শনধারী বসন্ত। মনে করুন ‘ভগবান শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য’-য় চৈতন্যদেব গয়ায় পিণ্ডদানের সময় শ্রীহরির পাদপদ্মস্থলে অশ্রুবর্জন করছেন।

বসন্তের পরেই আসে গ্রীষ্ম। কিন্তু গ্রীষ্মতেই আগমন এই বসন্তের। তিনি বসন্ত চৌধুরী। বৈশাখেই জন্ম বসন্ত চৌধুরীর। ১৯৫০ এ ফিল্মে অভিনয় করার স্বপ্নকে সত্যি করতে বেরিয়ে পড়েছিলেন নিজের ভাগ্য অন্বেষণে আন্দুলের ‘দত্তচৌধুরী জমিদার বংশ’এর ছেলে। রামশরণ দত্তর বংশধর ঈশানচন্দ্রের পুত্র অপূর্বকৃষ্ণ দত্তচৌধুরী ‘দত্ত’ পদবি ব্যবহার করতেন না। তিনি আন্দুলের পৈতৃক ভিটে ছেড়ে নাগপুরে বসবাস করতে শুরু করেন ১৮৮৬ সাল থেকে। সেখানে তিনি আইনজীবী হিসেবে কাজ শুরু করেন। তাঁদেরই পরবর্তী প্রজন্ম হলেন বসন্ত চৌধুরী। তেরো বছর বয়সে পিতৃহারা বসন্তর মাথায় নানা স্বাধীন কাজ করার স্বপ্ন ভিড় করত। বসন্ত চৌধুরীর বয়স তখন ২২। নাগপুর থেকে স্নাতক পাশ করেই স্বপ্নপূরণের আশায় চড়ে বসেছেন বম্বে মেল-এর থার্ড ক্লাসের কামরায়। গন্তব্য কলকাতা।

কিছুই চেনেননা কলকাতায়। কিন্তু অভিজাত সুদর্শন চেহারার জোরে সুযোগ হয়ে গেল ফিল্মে অভিনয় করার। দেবকী কুমার বোস থেকে কার্তিক চট্টোপাধ্যায় সবার হাতযশেই বাংলা ছবিতে এল নবীন বসন্ত যুগ।

বাংলার নায়ক বসন্ত চৌধুরী তাঁর আভিজাত্য, তাঁর বনেদিয়ানা, তাঁর অভিজাত ব্যক্তিত্ব… ক্লাস কী জিনিস বুঝিয়ে দেয় বাংলা ছবিতে। ছবি বিশ্বাসের পর বসন্ত চৌধুরী সেই অভিনেতা যিনি ভীষণ অভিজাত।

বসন্ত চৌধুরী বাংলা ছবির নায়ক অভিনেতা, তিনি আমাদের চির পরিচিত। কিন্তু ক’জন আমরা জানি বসন্ত চৌধুরী বলিউডে হিন্দি ছবিতেও তাঁর অভিনয়ের নজির রেখেছিলেন। নাগপুরের বাঙালি বসন্ত হিন্দিতে চোস্ত ছিলেন, তাই বাঙালি উত্তম-সৌমিত্রদের থেকে বলিউডে অনেক বেশী উপযুক্ত ছিলেন তিনি ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই।

রামশরণ দত্তর বংশধর ঈশানচন্দ্রের পুত্র অপূর্বকৃষ্ণ দত্তচৌধুরী ‘দত্ত’ পদবি ব্যবহার করতেন না। তিনি আন্দুলের পৈতৃক ভিটে ছেড়ে নাগপুরে বসবাস করতে শুরু করেন ১৮৮৬ সাল থেকে। সেখানে তিনি আইনজীবী হিসেবে কাজ শুরু করেন। তাঁর পুত্র ফণিভূষণ। এই ফণিভূষণেরই ছেলে সিদ্ধিশচন্দ্র। বসন্ত চৌধুরীর জন্ম ৫ মে ১৯২৮, নাগপুরে।

সময়টা ১৯৫০। বসন্ত চৌধুরীর বয়স তখন ২২। নাগপুরের দীননাথ স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করে আগের বছরই বিএসসি (মতান্তরে ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র) করেছেন সেখানকার মরিস কলেজ থেকে। তার পর কিছুটা ইচ্ছের উপর ভর করে চড়ে বসেছেন বম্বে মেল-এর থার্ড ক্লাসের একটা কামরায়। গন্তব্য কলকাতা। বাসনা, সিনেমায় অভিনয় করা। স্কুলে খেলাধুলোয় বেশ নাম ছিল তাঁর। ভাল ক্রিকেট খেলতেন। নাটকও করেছেন বেশ কয়েক বার। তখন থেকেই মনের মধ্যে অভিনয়ের প্রতি তীব্র টান অনুভব করতে শুরু করেছিলেন। গ্র্যাজুয়েট হওয়ার পর মুক্ত মনের বাসনাকে আগল দিতে চাননি।

তেরো বছর বয়সে বাবা সিদ্ধিশচন্দ্র চৌধুরীকে হারিয়েছেন তিনি। মা কমলা ও ভাই প্রশান্তকে নিয়ে পিতৃবিয়োগের পর নিজের ভবিষ্যৎ জীবন কেমন হবে, তা নিয়ে ভাসা ভাসা কিছু স্বাধীন ভাবনা ভিড় করত মনে। তাই বেরিয়ে পড়েছিলেন নিজের স্বপ্নকে সত্যি করা যায় কি না বাজিয়ে দেখতে। কলকাতা শহরের কাউকেই তিনি তেমন চিনতেন না। যদিও কলকাতার অদূরে আন্দুল গ্রামশহরে ছিল তাঁদের ‘দত্তচৌধুরী জমিদার বংশে’র ভিটেবাড়ি। একডাকে সেই পরিবারকে চেনে সারা বাংলা।

বসন্ত চৌধুরী অবশ্য কাউকে জানতেও দেননি তাঁর বংশ পরিচয়। তাঁর তখন একটাই পরিচয়, অভিনেতা। কলকাতার বৌবাজারে বন্ধু রবি দে চাকরি করতেন একটি ল্যাবরেটরিতে। তিনি সেই ল্যাবরেটরির অফিস ঘরের একটি টেবিলে রাতে বসন্তের শোয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। সারা দিন কলকাতার বিভিন্ন স্টুডিয়ো পাড়ায় ঘুরে পরিচালক প্রযোজকদের সঙ্গে পরিচিত হয়ে, রাস্তার কোনও পাইস হোটেলে খাওয়াদাওয়া সেরে, রাতে সেই টেবিলেই শুয়ে পড়তেন। তবে সিনেমার নায়ক হওয়ার মতো চেহারা ছিল বলে প্রযোজক পরিচালকদের চোখে পড়তে খুব বেশি সময় লাগেনি। বাংলা সিনেমায় তখন বিমল রায়, প্রেমাঙ্কুর আতর্থী, নীতিন বোস, কার্তিক চট্টোপাধ্যায়, অমর মল্লিক, সুবোধ মিত্রর মতো বাঘা পরিচালকরা কাজ করলেও বি এন সরকারের নিউ থিয়েটার্স স্টুডিয়োর দীর্ঘ গৌরবময় ইতিহাসের শেষ অধ্যায় শুরু হয়ে গিয়েছে। চল্লিশের দশকের মাঝামাঝি থেকে তাদের ছবি ফ্লপ হতে শুরু করেছে। কোম্পানির আর্থিক অবস্থা ভাল নয়। যদিও সে সবের কিছুই তখন বসন্ত জানতেন না। তিনি কলকাতায় এসে নিউ থিয়েটার্স স্টুডিয়োতেই প্রথম হানা দিয়েছিলেন। কয়েক মাস ঘোরাঘুরির পর সদ্য প্রতিষ্ঠিত স্টুডিয়ো ‘রাধা ফিল্মস’-এর মাধব ঘোষাল তাঁদের নতুন ছবি ‘মন্দির’-এর নায়কের চরিত্রে নির্বাচন করলেন বসন্তকে। ছবির পরিচালক ছিলেন দেবকী বসুর ভাইপো তথা সহকারী চন্দ্রশেখর বসু। তিন হাজার টাকার পিকচার কনট্র্যাক্ট হল। অগ্রিম হিসেবে বসন্ত পেলেন তিনশো টাকা। সেটাই তাঁর কলকাতায় এসে প্রথম রোজগার। টাকা হাতে পেয়ে তাঁর মনে হয়েছিল “আমিই বা কে আর লর্ড লিনলিথগোই বা কে!” শুটিং শুরু হল।

এমনই এক সময়ে শিল্প নির্দেশক সৌরেন সেনের সুপারিশে নিউ থিয়েটার্স থেকে ডাক এল বসন্তের। শুনলেন, নিউ থিয়েটার্সের নতুন ছবি ‘মহাপ্রস্থানের পথে’র নায়কের ভূমিকায় নির্বাচিত হয়েছেন তিনি। নায়িকা নবাগতা অরুন্ধতী মুখোপাধ্যায়। পরিচালক কার্তিক চট্টোপাধ্যায়। আকাশ ভেঙে পড়ল তাঁর মাথায়। তিনি সৌরেনবাবুকে ‘মন্দির’ ছবির সঙ্গেই ‘মহাপ্রস্থানের পথে’র শুটিং করার ইচ্ছে প্রকাশ করলেন। কিন্তু সৌরেনবাবু জানালেন, নিউ থিয়েটার্সের ছবিতে কাজ করলে আর কোনও ছবিতে কাজ করা যায় না। সেটাই শর্ত। বিভ্রান্ত, দ্বিধাগ্রস্ত বসন্ত ছুটে গেলেন রাধা স্টুডিয়োর মাধববাবুর কাছে। নিউ থিয়েটার্সের ছবির প্রস্তাবের কারণে ‘মন্দির’ ছবিতে কাজ করতে পারবেন না বলে জানাতেই, মাধববাবুর দাদা কেশববাবু তিন দিনের হয়ে যাওয়া শুটিংয়ের যাবতীয় খরচ ক্ষতিপূরণ হিসেবে দাবি করে বসলেন।

অনেক চেষ্টায় ও দেবকী বসুর মধ্যস্থতায় ছাড়া পেয়েছিলেন বসন্ত চৌধুরী। শুটিংয়ের খরচ দিতে হয়নি বটে, তবে অগ্রিম হিসেবে পাওয়া তিনশো টাকা তিনি ফেরত দিয়েছিলেন। ৯ জুন ১৯৫২ মুক্তি পেয়েছিল বসন্ত চৌধুরী ও অরুন্ধতী দেবী অভিনীত কার্তিক চট্টোপাধ্যায়ের দ্বিভাষিক সুপারহিট ছবি ‘মহাপ্রস্থানের পথে’ (হিন্দি নাম ‘যাত্রিক’)। ছবিটিকে বাংলা সিনেমার প্রথম ‘ট্রাভেল ফিল্ম’ হিসেবে দেখা যেতে পারে। সেই সময়ের বাংলা ছবির নিরিখে এই ছবিকে অনেকেই অন্য ধারার ছবি বলে চিহ্নিত করেন।

১৯৫৪-তে নীরেন লাহিড়ীর ‘যদুভট্ট’-তে বসন্ত পার্শ্বচরিত্র। কিন্তু ১৯৫৫ সালে তাঁর চারটি ছবি মুক্তি পেয়েছিল – ‘দুজনায়’, ‘ভালোবাসা’, ‘দেবীমালিনী’, ‘অপরাধী’। এর মধ্যে কেবল দেবকী বসুর ‘ভালোবাসা’ ছবিতে সুচিত্রা সেন আছেন নায়িকা হিসেবে। বেশ বোঝা যায়, বসন্ত চৌধুরীকে ঘিরে সাময়িক একটা আগ্রহ পরিচালকদের মধ্যে তৈরি হয়েছিল বটে, তবে এই পর্বটি ছিল খুবই ক্ষণস্থায়ী। অদ্ভুত কিছু ঘটনাক্রমের কারণে বসন্ত চৌধুরী বাংলা সিনেমায় ‘স্টার’ নয়, আভিজাত্যে ভরা এক অভিনেতা হিসেবে মান্যতা পেয়েছিলেন।

১৯৪৮ সালে ‘দৃষ্টিদান’ থেকে শুরু করে আরও সাতটি ছবির ব্যর্থতা পার হয়ে ১৯৫৪ সালে মুক্তি পায় অগ্রদূত গোষ্ঠীর ‘অগ্নিপরীক্ষা’। এতে উত্তম-সুচিত্রার বাণিজ্যসফল জুটি বড়ুয়া-পরবর্তী বাংলা ছবির দর্শকের সামনে যেমন হাজির হয়, তেমনই ১৯৫৫ সালে নিউ থিয়েটার্স যুগেরও অবসান ঘটে।

চেহারার কারণেই দেবকী বসু চৈতন্যদেবের চরিত্রে বসন্ত চৌধুরীকে নির্বাচিত করেছিলেন। সেটা ছিল বসন্তবাবুর দ্বিতীয় ছবি। দেবকীবাবুর পুত্র পরিচালক দেবকুমার বসু জানাচ্ছেন, “শ্রীচৈতন্যদেবের চরিত্রে ওঁকে খুব মানিয়েওছিল। ঠিক যেমন পরবর্তী কালে রাজা রামমোহনের চরিত্রে তাঁর মধ্য দিয়েই বাঙালি সাক্ষাৎ রামমোহনকে দর্শন করেছিল। ১৯৫২ সালে ‘মহাপ্রস্থানের পথে’র বিপুল সাফল্যের পরে ’৫৩ সালে দ্বিতীয় ছবি ‘ভগবান শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য’ও বিপুল জনপ্রিয়তা পায়। শ্রীচৈতন্যর চরিত্রে বসন্ত চৌধুরী ও বিষ্ণুপ্রিয়ার চরিত্রে সুচিত্রা সেনের অনবদ্য অভিনয়ের জন্য ছবিটি ভক্ত দর্শকের কাছে আজও স্মরণীয় হয়ে আছে।” তাঁর স্মৃতিতে আছে, “বসন্তবাবু অভিনয় করার সময়ে একটু দুলতেন, ক্যামেরা জ়োনের পজ়িশন থেকে সরে যেতেন। বাবা ওঁকে সে ব্যাপারে সাবধান করে ফ্লোরে একটা গণ্ডি কেটে দিয়ে বলেছিলেন, ‘এর বাইরে তুমি যেয়ো না’। ছবিটা করতে উনি খুব খেটেছিলেন। প্রবল অধ্যবসায় ছিল তাঁর।”

কিন্তু দুর্ভাগ্য! এর পরও বসন্ত-সুচিত্রাকে প্রমথেশ বড়ুয়া পরবর্তী ও প্রাক-উত্তম পর্বে বাংলা ছবির এক সম্ভাবনাময় বাণিজ্যসফল জুটি হিসেবে ভাবতে পারেননি প্রযোজক পরিচালকেরা। তথ্যের দিকে তাকালে দেখা যাবে, ১৯৫৩ সালে বসন্ত অভিনীত, সুবোধ মিত্র পরিচালিত ‘নবীন যাত্রা’ (বাংলা) বা ‘নয়া সফর’ (হিন্দি) ছবিটি মুক্তি পায়, যেখানে প্রথমে বসন্ত ও উত্তমকুমার অভিনয় করেন। ছবিটির বাংলা সংস্করণের নায়ক উত্তম আর হিন্দিতে বসন্ত চৌধুরী (নায়িকা মায়া মুখোপাধ্যায়)।

১৯৫৪-তে নীরেন লাহিড়ীর ‘যদুভট্ট’-তে বসন্ত পার্শ্বচরিত্র। কিন্তু ১৯৫৫ সালে তাঁর চারটি ছবি মুক্তি পেয়েছিল – ‘দুজনায়’, ‘ভালোবাসা’, ‘দেবীমালিনী’, ‘অপরাধী’। এর মধ্যে কেবল দেবকী বসুর ‘ভালোবাসা’ ছবিতে সুচিত্রা সেন আছেন নায়িকা হিসেবে। বেশ বোঝা যায়, বসন্ত চৌধুরীকে ঘিরে সাময়িক একটা আগ্রহ পরিচালকদের মধ্যে তৈরি হয়েছিল বটে, তবে এই পর্বটি ছিল খুবই ক্ষণস্থায়ী। অদ্ভুত কিছু ঘটনাক্রমের কারণে বসন্ত চৌধুরী বাংলা সিনেমায় ‘স্টার’ নয়, আভিজাত্যে ভরা এক অভিনেতা হিসেবে মান্যতা পেয়েছিলেন।

১৯৪৮ সালে ‘দৃষ্টিদান’ থেকে শুরু করে আরও সাতটি ছবির ব্যর্থতা পার হয়ে ১৯৫৪ সালে মুক্তি পায় অগ্রদূত গোষ্ঠীর ‘অগ্নিপরীক্ষা’। এতে উত্তম-সুচিত্রার বাণিজ্যসফল জুটি বড়ুয়া-পরবর্তী বাংলা ছবির দর্শকের সামনে যেমন হাজির হয়, তেমনই ১৯৫৫ সালে নিউ থিয়েটার্স যুগেরও অবসান ঘটে। এই অবসান বাংলা সিনেমার গতি ও প্রকৃতিকে বদলে দিয়েছিল। সেই সঙ্গে স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলার সামাজিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিবেশও প্রভাব ফেলেছিল বাংলা সিনেমায়। তাই চলচ্চিত্র ব্যবসার যুক্তিহীন ও উদ্ভট ঘটনাবলির কারণে বাংলা ছবির দর্শকের কাছে বসন্ত-সুচিত্রার বদলে উত্তম-সুচিত্রা জুটি জনপ্রিয়তা পেয়ে যায়। এমন অবস্থার সামনে দাঁড়িয়ে বসন্তর অসহায় লেগেছিল। তিনি নিজেই এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “খুব চাপে পড়ে গিয়েছিলাম।”

বসন্ত-উত্তমের ব্যক্তিগত সম্পর্কের উপরে অবশ্য এর কোনও ছাপ পড়েনি। দু’জনের মধ্যে বন্ধুত্ব চিরকাল অটুট থেকেছে। উত্তমকুমার স্টার হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পর যে সব ছবিতে দু’জনে অভিনয় করার সুযোগ পেয়েছেন, সেখানেই বসন্ত চেষ্টা করেছেন নিজস্ব এক অভিনয়শৈলীকে কাজে লাগাতে। সফলও হয়েছেন ক্রমশ। যেমন, ‘বকুল’ (হিন্দি), ‘হারজিৎ’, ‘শঙ্করনারায়ণ ব্যাঙ্ক’, ‘শঙ্খবেলা’ এবং ‘যদি জানতেম’। বসন্তর কথায় তিনি নির্দিষ্ট কোনও ইমেজ তৈরি করতে চেষ্টা করেননি কখনও। তাই ওই ছবিগুলিতে উত্তমকুমারের পাশে নিজস্ব প্রতিভায় বসন্ত চৌধুরী ভাস্বর হয়ে রয়েছেন আজও। এর একটা বড় উপমা হয়তো ‘দীপ জ্বেলে যাই’ ছবিটি। ‘মহাপ্রস্থানের পথে’, ‘ভগবান শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য’র দিনগুলি থেকে অনেকটা পথ পেরিয়ে এসেছিলেন তত দিনে। চলচ্চিত্রে অভিনয় নিয়ে তাঁর ভাবনা তখন পরিষ্কার। লিখেছেন, “চলচ্চিত্রে পারফরমেন্সের প্রশ্ন ওঠে না। বিহেভিয়ারের কথা আসে। এখানে অভিনয়ের টেকনিক্যালিটিস বড় নয়, আচরণের সুষমাই মুখ্য।”

একজন স্টারের অভিনয়-জীবনের বিপদের দিকটা তিনি আশ্চর্য ক্ষমতায় বুঝতে পেরেছিলেন। বলেছেন, “বার বার ব্যবহারে কোনও অভিনেতা তাঁর নিজস্ব ‘টাইপ’-এ অনেক সময়ে একটি ‘ইমেজ’-এ আবদ্ধ হয়ে যান। তখন তাঁকে ঘিরে তৈরি হয় নিজস্ব ভক্তমণ্ডলী আর তখনই চলচ্চিত্র অভিনয়ে ‘পারফরমেন্স’-এর অনুপ্রবেশ ঘটে।” মাধবী মুখোপাধ্যায়ের ধারণা, “এই উক্তি অভিনেতা বসন্ত চৌধুরীকে আলাদা করে চিনিয়ে দেয়। বোঝা যায়, উত্তমকুমারের প্রচণ্ড খ্যাতির সামনে দাঁড়িয়ে তিনি কেমন করে নিজের জায়গাটিকে আলাদা করে নিয়েছিলেন। এই জন্যই বাংলা সিনেমায় ‘বসন্তদা’ তাঁর যাবতীয় দৈহিক সৌন্দর্য, কণ্ঠমাধুর্য আর পৌরুষ নিয়ে এক অনন্য অভিনেতার জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে পেরেছিলেন আজীবন।”

মনে করুন ‘আধাঁরে আলো’ ছবির নায়ক গঙ্গাস্নানে যাচ্ছেন। যেতে যেতে আবিষ্কার করছেন নায়িকা সুমিত্রা দেবীকে। কিংবা ‘রাজা রামমোহন’-এ রাজা সংরক্ষণবাদীদের সঙ্গে তর্কে নেমেছেন বা মৃত্যু ঘনিয়ে আসার দিনগুলোয় বিধ্বস্ত শরীরে বিলেতের শীতে পথে হাঁটছেন। এই মূর্তিগুলো দিয়েই বাঙালি-স্মৃতিতে বসন্ত বাঁধা পড়েছেন।

সারা জীবনে প্রায় শতাধিক ছবিতে অভিনয় করলেও আশ্চর্য এই যে, আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র তথ্যভাণ্ডার মাত্র ৭৪টি ছবির সন্ধান দিতে পেরেছে, যার মধ্যে ৭টি হিন্দি। এর মধ্যে ‘ভগবান শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য’, ‘আঁধারে আলো’, ‘রাজা রামমোহন’, ‘যদুভট্ট’, ‘দীপ জ্বেলে যাই’, ‘শুভরাত্রি’, ‘মেঘ কালো’, ‘অভয়া ও শ্রীকান্ত’, ‘অনুষ্টুপ ছন্দ’, ‘বৈদুর্য্যরহস্য’, ‘দিবারাত্রির কাব্য’, ‘দেবী চৌধুরাণী’, ‘অন্তর্জলী যাত্রা’ ‘হীরের আংটি’, ইত্যাদি ছবির জন্য বসন্ত চৌধুরীকে বাঙালি মনে রেখেছে। তাঁর অভিনীত হিন্দি ছবিগুলি যথাক্রমে ‘যাত্রিক’, ‘নয়া সফর’, ‘বকুল’, ‘পরখ’, ‘গ্রহণ’, ‘ময়ূরী’, ও ‘এক ডক্টর কী মওত’। ‘রাজা রামমোহন’ ছবির জন্য তিনি ‘বিএফজেএ’ পুরস্কার পান। দীর্ঘ মঞ্চ অভিনয়ের স্বীকৃতি হিসেবে তাঁকে ‘স্টার থিয়েটার অ্যাওয়ার্ড’ দেওয়া হয়।

কলকাতার পাবলিক থিয়েটারেও বসন্ত চৌধুরী অভিনয় করেছেন পঞ্চাশের দশক থেকেই। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আরোগ্য নিকেতন’ নাটকে নবীন চিকিৎসকের প্রধান চরিত্র দিয়ে তাঁর থিয়েটার জীবনের সূচনা হয়। তার পর ‘দেনা পাওনা’, ‘বিপ্রদাস’, ‘অগ্নিকন্যা’-সহ বহু নাটকে তিনি অভিনয় করেছেন। স্টারে ‘কালবৈশাখী’ ও ‘ক্ষুধা’ ৫০০ রজনী চলেছিল। ষাটের দশকে ‘শ্রেয়সী’ দর্শককে মাতিয়ে রাখত। আকাশবাণীতেও তাঁর কণ্ঠে বেতার নাটক শুনতে শুক্রবার রাত পৌনে আটটায় শ্রোতারা রেডিয়ো খুলে বসতেন।

এক সময়ে নট্ট কোম্পানির হয়ে বসন্ত চৌধুরী যাত্রা করেছেন নিয়মিত। সেখানে অভিনয়ের অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে জানিয়েছেন, “আমার কাছে যাত্রা মানে খোলা চষা মাঠ। ধান কাটার পর খড়ের গোঁজ বেরিয়ে আছে মাঠে। তার ওপর ইউরিয়া সারের পলিবস্তা জুড়ে জুড়ে পাতনি…অমন জায়গায় তিনশো ফুট বাই তিনশো ফুট প্যান্ডেল। কমপক্ষে পঁচিশ হাজার লোক ধরে। অতগুলো লোককে ধরে রাখা সহজ কথা?”

বছর দুয়েক টানা যাত্রা করেছিলেন। এই যাত্রা করতে যাওয়ার পিছনে তাঁর আর একটা উদ্দেশ্য ছিল। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক স্যমন্তক দাস জানিয়েছেন, “আসলে উনি যাত্রায় নাম লিখিয়েছিলেন কতকগুলো বিষয় মাথায় রেখে। যার একটা হল, পশ্চিমবঙ্গে বহু জায়গায় তিনি ঘুরেছেন, কিন্তু যাত্রায় অভিনয় করার সুবাদে আরও বহু না-জানা জায়গায় ঘোরা হয়ে যাবে, এটা ওঁর মাথায় থাকত। হয়েছিলও তাই। পুরনো মন্দির, বাড়ি, বহু জিনিসপত্র ওঁর দেখা হয়েছে। বহু গ্রামীণ সংস্কার, গ্রামীণ বিশ্বাস সম্পর্কে জেনেছেন, যা ওঁর জানা ছিল না। এর ফলে এক অন্য বসন্ত চৌধুরীর পরিচয় আমরা পেয়েছি।”

আবার বসন্ত চৌধুরী মানেই বাঙালিয়ানা, যার শুরু তাঁর পোশাকআশাক দিয়ে। কন্দর্পকান্তি চেহারার সঙ্গে আমে দুধের মতো মিশত গলার ভারী আওয়াজ। শান্ত চলন এবং গভীর চাহনি। চওড়া কপাল থেকে পায়ের বিদ্যাসাগরী চটি অবধি এক পূর্ণ বাবুটি যেন! কিন্তু এই বহিরঙ্গের আড়ালে বসন্ত চৌধুরী সাহেবও ছিলেন। থেকে থেকে চমৎকার ইংরেজি মিশিয়ে বাংলা কথা, সেরা ফরাসি কনিয়াকের রুচি, নিবিড় আমেজে হাভানা চুরুটে টান, প্রাচীন মুদ্রা, ডাকটিকিট, গণেশ মূর্তি ও জামেয়ার সংগ্রহ ও তা নিয়ে পড়াশোনা, খাটাখাটনি ও অর্থব্যয়ে অপরূপ ও দুষ্প্রাপ্য সব শাল কেনা আর সর্বোপরি এক বিচিত্র, বিস্তীর্ণ বই পড়ার নেশা। তাঁর বাঙালিয়ানা সম্পর্কে রাধাপ্রসাদ গুপ্তর (শাঁটুল) মন্তব্য, “ও একটা রোবাস্ট ভদ্রলোক। অনেক দিকে মাথা খেলে। কিন্তু পল্লবগ্রাহী নয়। ভীষণ সেন্স অব হিউমার, কিন্তু কোথায় যেন একটা মেলানকলির ছোঁয়া।”

সুরা, সিগার, পঞ্চব্যঞ্জন বিলাসী, ড্রয়িংরুম আলো করা গল্পপটু বসন্ত চৌধুরীর কোনও ছায়া নেই ওঁর গম্ভীর, প্রধানত দুঃখী, কখনও রোম্যান্টিক হলেও বেদনার কারণেই স্মরণীয় সিনেমার চরিত্রগুলোয়। তিনি ছিলেন ভরদ্বাজ গোত্র কনৌজিয়া কায়স্থ দত্ত চৌধুরী বংশের সন্তান। কান্যকুব্জ থেকে বাংলায় আসা প্রথম পুরুষ পুরুষোত্তম দত্ত থেকে ধরলে আন্দুল দত্তচৌধুরী বংশের ষোড়শ পুরুষ হলেন বসন্ত চৌধুরী। জীবন ও সিনেমার সম্পূর্ণ দু’টি ভিন্ন সরণিতে হেঁটে গিয়েছেন দু’টি ভিন্ন সাফল্যের লক্ষ্যে।

কিন্তু বসন্ত নিজেকে খুব একটা ভাঙেননি, তাই ঐ আভিজাত্য কঠিনত্ব থেকে বেরোননি সে অর্থে। আবার রোম্যান্টিক নায়কের রোলে হয়তো কিছুটা পিছিয়ে ছিলেন বম্বের নায়কদের তুলনায়। এটাও ঠিক কলকাতা-বোম্বে একসঙ্গে সামলানো মুশকিল তাই বোম্বেতে পাকাপাকি না থেকে বাংলা ছবিতেই নিজের সাম্রাজ্য গড়েছেন বসন্ত চৌধুরী।

কিন্তু ইতিহাসের চরিত্র হয়ে গেলেন বসন্ত চৈতন্য রামমোহনের পর শিষ্টের পালন দুষ্টের দমনকারী ভবানী পাঠক … উনি ছাড়া কাকেই বা মানাতো। সত্যজিত্‍ কাকে ভবানী পাঠক ভেবেছিলেন হয়তো বসন্তই, কিন্তু অত বছর পরেও যখন দীনেন গুপ্ত করলেন অবিকল বঙ্কিমের ভবানী পাঠক উঠে এলেন পর্দায়। কি স্থিতধী কি দাপটপূর্ণ ডাকাতসর্দার। ‘প্রথম প্রতিশ্রুতি’তে সত্যবতী সোনালী গুপ্ত-র পর্দাপিতা রূপে বসন্ত চৌধুরী ছাড়া অন্য কাউকে ভাবাই যায়না। করেন বলিউডি ছবিও। পরখ।ঋতুপর্ন তাই যখন বনেদী রাজসিক দুর্গা পুজো কেন্দ্রিক ছবি ‘হীরের আংটি’ বানালেন বাড়ির কর্তা নিলেন জমিদার বসন্তকেই। তবে বসন্ত কিছু অন্যধরনের চরিত্র করেছেন যেমন মানসিক রোগীর অভিনয়ে অসিত সেনের ‘দীপ জ্বেলে যাই’, অথবা রহস্যভরা ভিলেনের অভিনয় তপন সিনহার ‘বৈদুর্য্য রহস্য’ ছবিতে।

শেষদিকে কলকাতা দূরদর্শনে রানী রাসমনি র কাহিনী নির্ভর মেগা সিরিয়াল ‘রাজেশ্বরী’তে নিধুবাবুর চরিত্রে বসন্তকেই নেন পরিচালক দেবাংশু সেনগুপ্ত। বসন্তর স্ত্রী অলকা চৌধুরী।তাঁদের দুই পুত্র সন্তান। বসন্ত চৌধুরীর পুত্র বিখ্যাত সফল সাংবাদিক সৃঞ্জয় চৌধুরী। টালিগঞ্জের কাছে রাণীকুঠীতে ছিল তাঁদের বাড়ি।কলকাতার শেরিফ রূপে বসন্তকে পেয়ে মহানগর ধন্য হয়। নন্দনের চেয়ারম্যানও হন তিনি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলা স্টেজ সেন্টিনারী সম্মানে তাঁকে ভূষিত করে স্টার থিয়েটার। তবে সত্যজিত্‍ রায়, মৃণাল সেনরা নেননি তাঁর মতো পার্সোনালিটিকে তাঁদের কোনো ছবিতে।

বসন্ত চৌধুরী আভিজাত্য, বনেদিয়ানা নিয়ে কেবল মাত্র একজন অভিনেতা ছিলেন না। ভারতের প্রাচীন ইতিহাসের ব্যাপারে কলকাতার এক কিংবদন্তি চরিত্রও তিনি। ত্রিপুরা, কোচবিহার, আরাকান-সহ উত্তর-পূর্বাঞ্চলের পুরনো রাজতন্ত্র ও প্রত্নতত্ত্বের তিনি বিশেষজ্ঞ ছিলেন। এ সব বিষয়ে দেশি-বিদেশি গবেষণা পত্রিকায় তিনি নিয়মিত লিখেছেন। মুদ্রা ও গণেশমূর্তি সংগ্রাহক হিসেবে তাঁর খ্যাতি ছিল বিশ্বজোড়া। দুর্লভ ও প্রাচীন গণেশমূর্তি সংগ্রহের জন্য চষে বেড়িয়েছেন সারা ভারত, চট্টগ্রাম, মায়ানমার, নেপাল থেকে নিউ ইয়র্ক। তাঁর প্রাচীন মুদ্রার সংগ্রহ দেখতে ইতিহাসের প্রখ্যাত অধ্যাপক নীহাররঞ্জন রায় নিজে এসেছিলেন তাঁর বাড়িতে।

এই গণেশ সংগ্রহের নেপথ্য কারণ হিসেবে বসন্ত চৌধুরী বলেছেন, “ছেলেবেলায় আমি বড় হয়েছি মহারাষ্ট্রে, যেখানে গণপতি বাপ্পার উপাসনা প্রায় ঘরে ঘরে। এই দেবতার প্রতি আমার আগ্রহ শৈশবে দেখা দশ দিনের গণেশ উৎসব থেকেই।” স্যমন্তক জানিয়েছেন, “মেসোমশাইয়ের সংগ্রহে এমন অনেক গণেশমূর্তি ছিল, বিশ্বে আর কারও কাছেই যা ছিল না। যেমন, ‘পঞ্চদ্বাররোধী যোগগণেশ’ বা ‘ধ্যানী গণেশ’। গণেশ সংগ্রহ করতে গিয়ে নানা মজার অভিজ্ঞতা হয়েছে তাঁর। একবার ছোট্ট একটি লোকশিল্পের গণেশ জোগাড় করেছিলেন এক খ্রিস্টান বন্ধুর কাছ থেকে। মূর্তিটির সঙ্গে সেই বন্ধু মেসোমশাইকে একটি পঁচিশ পয়সার কয়েন দেন। এটাই রীতি বলে তিনি জানান। যেহেতু গণেশ সমৃদ্ধি ও সিদ্ধির দেবতা, তাই তার মূর্তি হস্তান্তর করায় অর্থক্ষতির আশঙ্কা থাকে।”

মৃত্যুর কিছু দিন আগে বসন্ত চৌধুরী তাঁর বহুমূল্য শ’খানেক গণেশমূর্তির সংগ্রহ ভারতীয় জাদুঘরে দান করে যান, যা বিক্রি করলে তিনি কোটি কোটি টাকা পেতে পারতেন।

এ সব সত্ত্বেও বসন্ত চৌধুরী ছিলেন মিশুকে মানুষ। তাঁর সঙ্গে আড্ডা দিতে পারত যে কেউ। স্টুডিয়োর সামান্য টেকনিশিয়ান থেকে পরিচালক, সাধারণ থেকে ধনী মানুষ কাউকেই তিনি তাঁর আভিজাত্য দিয়ে দূরে ঠেলতেন না। অভিনয়ের জন্য চরিত্রদের ফুটিয়ে তুলতে খুব সাধারণ মধ্যবিত্তের বাড়ি গিয়ে চা খেয়ে আড্ডা দিয়েছেন দিনের পর দিন। বহু দুঃখেও কখনও তিনি জীবনবিমুখ হননি।

তাঁর আভিজাত্য, ক্লাস অভিনয়ের দ্বারা অমর হয়ে থাকবেন। বাংলা ছবির চিরবসন্ত যে তিনি। বাঙালি সংস্কৃতির এক সেরা মুখ বসন্ত চৌধুরীর কৃষ্টি ছিল বীরের মতো নিজের ব্যথা-বেদনাকে গোপন রেখে দেওয়া। আনন্দটুকুই শুধু ভাগ করার। কারও দিকে না তাকিয়ে ২০০০ সালের ২০ জুন চলে গেলেন ‘মহাপ্রস্থানের পথে’-র নায়ক। উনি কারও চোখের জল সহ্য করবেন না। গত ২০ জুন ছিল বসন্ত চৌধুরীর প্রয়াণ দিবস। আমার শ্রদ্ধার্ঘ্য।

★ তথ‍্যঋণ ও কৃতজ্ঞতা স্বীকার :- আনন্দবাজার পত্রিকা, সাতরঙা – রবি বসু, অঞ্জন দাস মজুমদার, শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় – দ‍্যা ওয়াল, জ্ঞানপীঠ, ডেইলি হান্ট।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.