শীত এলেই বাংলার মাঠ-ঘাট-বনাঞ্চলের চেহারা পাল্টে যায়। পাখিদের নির্ভরযোগ্য আস্তানা হয়ে ওঠে কত কত গ্রাম-গঞ্জ। পাখিদের কথা না বললে অসম্পূর্ণ থেকে যায় বাংলার জীববৈচিত্র্য। যাঁদের কলতান শুনে ঘুম ভাঙলে সকালটা আরামের হয়ে ওঠে, গাছগাছালির সবুজে সবুজে প্রাণের স্পন্দন ঘটে। তাই পাখির প্রভাব বাংলা সাহিত্যের পাতাতেও। কাতারে কাতারে কত কত পাখি এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত ছুটে চলে, যাদের খোঁজই রাখা হয় না। সেরকমই অচেনা অজানা পাখিদের অন্যতম ইন্ডিয়ান হোয়াইট আই (Indian White Eye); পক্ষীবিদরা ভালোবেসে বাংলা নাম দিয়েছেন ‘চশমা পাখি’।
হোয়াইট আই পরিবারের অন্তর্গত চড়ুই জাতীয় এই পাখির বিজ্ঞানসম্মত নাম জসটেরোপ্স প্যালপেব্রোসাস (Zosterops Palpebrosus)। ডাচ প্রাণীবিদ্যাবিশারদ কোয়েনরাড জেকব টেমিঙ্ক (Coenraad Jacob Temminck) ১৮২৪ সালে প্রথমবার এই পাখির নাম তাঁর লেখায় উল্লেখ করেন। খোদ বাংলা থেকে সংগৃহীত একটি চশমা পাখিকে পর্যবেক্ষণ করে তিনি এর নাম রাখেন সিলভিয়া প্যালপেব্রোসা। এই দুটি নামই ইঙ্গিত করে একদিকে – তা হল পাখিটির দুই চোখের চারপাশে ঘিরে থাকা একগুচ্ছ সাদা লোম। যা হঠাৎ দেখলে মনে হয়, পাখিটি বুঝি চশমা পরেছে চোখে! বিচরণক্ষেত্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং মালয়েশিয়া হওয়ার কারণে এর নাম দেওয়া হয় ‘ওরিয়েন্টাল হোয়াইট আই’ (Oriental White Eye)। যদিও পরবর্তীকালে ভারত জুড়ে এদের আনাগোনা বৃদ্ধি পাওয়ায়, নাম বদলে রাখা হয় ‘ইন্ডিয়ান হোয়াইট আই’।
এই পাখির দেহের উপরিভাগ হলদে ঘেঁষা জলপাই রঙের। পেটের রং ময়লাটে সাদা, যদিও প্রজাতি ভেদে এর তারতম্য দেখা যায়। চোখের ‘চশমা’টির জন্য ভীষণ ভাবে আকর্ষণীয় দেখতে লাগে মাত্র ৮-৯ সেন্টিমিটার লম্বা এই পাখিটিকে। বৈজ্ঞানিকেরা ইতিমধ্যেই চশমা পাখির ১১টি অন্তঃপ্রজাতির খোঁজ পেয়েছেন। এদের প্রাত্যহিক খাবারের মধ্যে রয়েছে নানাবিধ ফুলের মধু, শাঁসযুক্ত রসালো ফল এবং ছোটো পোকামাকড়।
ভারতীয় উপমহাদেশের উন্মুক্ত বনাঞ্চলগুলিতে বহুল পরিমাণে দেখতে পাওয়া যায় চশমা পাখিদের। আর্দ্র আবহাওয়ায় বেড়ে ওঠা ঝোপঝাড় ও গাছে এবং বিশেষত ম্যানগ্রোভ অরণ্যে বাসা বাঁধে এরা। চশমা পাখিদের দিন কেটে যায় আকাশে ভাসমান অবস্থাতেই, মাটিতে তাদের নামতে দেখা যায় না বললেই চলে। মজার বিষয় হল, হোয়াইট আই গোত্রের অন্তর্ভুক্ত বাকি পাখিদের মতোই চশমা পাখিরাও অন্য প্রজাতির পাখিদের বাসা তৈরির সামগ্রী চুরি করে থাকে। এছাড়াও, প্রয়োজনে প্যারাডাইস ফ্লাইক্যাচার গোত্রের পক্ষীশাবকদের খাইয়ে দিতে দেখা গেছে চশমা পাখিদের। এই ঘটনাটি বিজ্ঞানের ভাষায় ‘ইন্টারস্পেফিসিক ফিডিং’ নামে পরিচিত।
চশমা পাখিরা সর্বদা দলবদ্ধ ভাবেই এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ঘুরে বেড়ায়। দল থেকে আলাদা হয় কেবলমাত্র মিলনকালীন সময়ে। ফেব্রুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে মিলিত হয় চশমা পাখিরা, তবে এপ্রিল মাস হল এদের জন্য সঙ্গমের আদর্শ সময়। আঁটোসাঁটো বাটির মতো দেখতে লাগে চশমা পাখিদের বাসাগুলোকে। ইংরেজি অক্ষর ‘ভি’ আকৃতির চেরা ডালের ঠিক মাঝখানে দোলনার মতো দুলতে দেখা যায় সেগুলো। ইন্ডিয়ান হোয়াইট আই বাসা তৈরির জন্য গাছের আঁশ, মাকড়শার আঠালো জাল, এমনকি খুদে আকারের ছত্রাক পর্যন্ত তুলে নিয়ে যায়। মাত্র দুই দিন লাগে চশমা পাখিদের বাসা তৈরি করতে। দুটি ফ্যাকাশে নীল রঙের ডিম পাড়ে এরা, যা থেকে বাচ্চা ফুটতে সময় লাগে দশ দিন। যতদিন পর্যন্ত পাখি-শিশুরা ঠিকমতো উড়তে না শেখে, ততদিন অবধি পালা করে যত্নের সঙ্গে এদের লালন পালন করে বাবা ও মা চশমা পাখি।
ওড়বার সময় তীক্ষ্ণ স্বরে ডেকে পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে এই পাখিরা। মধু সংগ্রহ করবার উদ্দেশে এক ফুল থেকে অন্য ফুলে উড়ে বেরানোর সময়ে এরা নিজেদের অজান্তেই পরাগ মিলনে সহায়তা করে। দেখা গেছে, এ সময়ে ফুলের উপরে জমে থাকা শিশিরের জলে গা ভিজিয়ে নিচ্ছে জলপাই রঙের একরত্তি চশমা পাখিরা। বলা হয়ে থাকে এরা বিশ্বে, বিশেষত ভারত ও বাংলাদেশে বিপদমুক্ত পাখি। চশমা পাখি ছাড়া এদের আরও দুটি বাংলা নাম শ্বেতাক্ষী এবং বাবুনাই।