“ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের উদ্যোগে সরস্বতী পূজা!”- এটা হওয়ারই ছিল।
‘মাঘের শীতে কোন অতিথি এলো প্রাণের দ্বারে
আনন্দ গান গারে হৃদয়, আনন্দ গান গারে।’
অতিথি হচ্ছেন শারদ প্রাতে শিশির স্নিগ্ধ ধরিত্রীর বুক ধন্য করা বিদ্যা এবং সংগীতের দেবী সরস্বতী।ব্রহ্মের যে শক্তি আমাদের বিদ্যাশিক্ষা দেন তিনি হলেন দেবী সরস্বতী। শাস্ত্র মতে, চর্তুভুজা ব্রহ্মার মুখ হতে আর্বিভুতা শুভ্রাবর্ণা বীণাধারিনী চন্দ্রের শোভাযুক্ত দেবীই হলেন সরস্বতী। দেবী সরস্বতী শুভ্রবর্ণা শ্বেতপদ্মাসনা, শ্রীহস্তে লেখনী, পুস্তক ও বীণা, এককথায় বলা যায় আলোকিত জীবন ময়তার প্রতীক হলেন মা সরস্বতী আর তাঁর পূজোয় সকলের অংশগ্ৰহণ হবে না তা কি হয়! তাই বলে যারা মূর্তি পূজায় বিশ্বাস করে না তারাও অংশগ্রহণ করেছে শুনলাম , শুনলাম বলা ভুল শুনে আসছি বিগত ৪-৫ বছর ধরে , শুধু অংশগ্রহণ ই নয়, তারা নাকি পুষ্পাঞ্জলি দিয়েছে , প্রতি বছরে এই অংশগ্ৰহণের সংখ্যা বেড়েছে দ্বিগুণ হারে । এই বছর আবার অনেক ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা দলবেঁধে নিজ উদ্যোগে বৈদিক দেবী মা সরস্বতীর আরাধনায় মেতে উঠেছেন , অনেকে আবার বলবেন সরস্বতী পূজোতেও ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার কথা তুলছেন! কিন্তু পূজা এক ধরণের সামাজিক উৎসব আমরা সেই ছোটোবেলার বাংলার রচনা থেকে পড়ে আসছি ,তাই কথা তুললাম, সবাই ধর্মের ভেদাভেদ ভুলে উৎসবে অংশগ্রহণ করুক , নিজের সংস্কৃতিকে চিনতে শিখুক , নিজের পূর্বপুরুষদের ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনুক , এই অতীত সংস্কৃতির পুনর্জাগরণের অধ্যায় না হয় সরস্বতী পূজা দিয়ে তাঁরা শুরু করছেন ঠিক যেমনটা ইন্দোনেশিয়ার ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে দেখা গেছে, তাঁরা অতীত সংস্কৃতিকে পুণঃস্মরণ করতে পেরেছেন । অতীতে হাজার হাজার হিন্দুকে যেভাবে জোর করে ,ভয় দেখিয়ে ধর্মান্তরিত করা হয়েছিল ,তাতে পাপের বোঝার ভার দিন দিন বাড়ছে , ঘটনায় তৎকালীন প্রাইম আঞ্চলিক বা সর্বভারতীয় সংবাদপত্র সেদিন লড়েছিল ,চোখে চোখ রেখে জবাবদিহি করার সাহস ছিল, কিন্তু এখন কেমন পচা আলুর মত কাজ করছে তারা ;কারা এরা? এরা তথাকথিত বাংলা মেইনস্ট্রিম সংবাদপত্র যাদের প্রধান কাজ হল খুব সাবধানে আড়ালে লুকিয়ে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপন আর প্রকাশ্যে সেকুলারিজমের রূপ ।
“এই সময়” অতি পরিচিত ডিজিটাল সংবাদ ম্যাধ্যম, সেখানেই একটি লেখা দেখলাম একটি প্রতিবেদন – (https://eisamay.com/nation/saraswati-pujo-2-siliguri/articleshow/67918021.cms) , সেখানে একটি স্থানে লেখা রয়েছে -“মহিবুল সিদ্দিকিও,তিনি একজন ল-ক্লার্ক। কাজ করেন বনগাঁ আদালতে। ভিন ধর্মের মানুষ হয়েও তিনি সরস্বতী পুজোর আয়োজন করেছেন। আদালত চত্বরের সামনেই পুজোর মণ্ডপ গড়েছেন। কাজের ফাঁকে একটু একটু করে থার্মোকল কেটে তিনি তৈরি করেছেন একটি রাজহাঁস। ওটাই মণ্ডপ। তাঁর কথায়, ‘কোরান আর গীতা পাশাপাশি থাকলে কখনও লড়াই হয় না। আর যারা এই নিয়ে লড়াই করেন, তারা গীতা বা কোরান কোনওটাই পড়ে না।’ আসলে মহিবুলও বোঝাতে চান, এটা বাংলা।”। সত্যিই একমাত্র বাংলায় কোরাণ আর গীতা পাশাপাশি থাকলে কোনো লড়াই হয় না , শুধু কোরাণ এ মূর্তি পূজায় বিশ্বাস করা যায় না তাই নিঃশব্দে মূর্তি ভাঙা যায়। গতবছর আনন্দবাজার এর একটি প্রতিবেদনে পড়েছিলাম – “মহম্মদ সাহবাজ রাজা, ঝাড়গ্রাম কুমুদকুমারী ইনস্টিটিউশনের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র। এ বার স্কুলের সরস্বতী পুজো পরিচালনার পড়ুয়া-কমিটির সম্পাদক সাহবাজই। পুজো আয়োজনের ঝক্কি সামলানোর ফাঁকেই জঙ্গলমহলের এই তরুণ বলছে, ‘‘নমাজ পড়া, আল্লাকে ডাকার সঙ্গে মা সরস্বতীর পুজোর তো কোনও বিরোধ নেই। সবই এক ঈশ্বরের রূপ। আর সব আরাধনাই তো মানুষের জন্য।’’ লোধাশুলি গ্রামের বাসিন্দা সাহবাজ পঞ্চম শ্রেণি থেকে এই স্কুলের পড়ুয়া। এখান থেকেই মাধ্যমিক পাশ করেছে। এখন পড়ছে বিজ্ঞান শাখায়। সাহবাজের প্রিয় বন্ধু দ্বাদশ শ্রেণির কলা বিভাগের ছাত্র প্রীতম ষড়ঙ্গী বলছিল, ‘‘সাহবাজের কাছেই আমরা শিখেছি মানবধর্ম শ্রেষ্ঠ ধর্ম”। লিঙ্ক-(https:/www.anandabazar.com/west-bengal/this-muslim-student-of-jhargram-got-responsibility-to-organize-saraswati-puja-in-his-school/cid/1266762)। আরোও একটি প্রতিবেদন- “মাঘের রোদে স্কুলের মাঠে গোল হয়ে বসে শুরু হয়েছে আলোচনা। কে কে হাজির? হাত তুলে এক এক করে নাম বলা শুরু হল—অর্পণা, শম্পা, নৌসাদ, মুসকান, শবনম, ইসরাত…।প্রধান শিক্ষক সামসুল আলম অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, হাসানুর কোথায় গেল? সেই তো পুজো কমিটির সম্পাদক। উত্তর এল, মণ্ডপ সাজানোর জোগাড়যন্ত্র করতে গিয়েছে। ব্যস্ত হওয়ার কারণও রয়েছে..……” , লিঙ্ক-(https://www.anandabazar.com/west-bengal/hindu-and-muslim-students-will-arrange-each-and-everything-of-saraswati-puja-in-their-school-1.742417) , এছাড়া এই কদিনে প্রথমসারির বেশ কিছু সংবাদপত্রে ( বর্তমান, আনন্দবাজার, প্রতিদিন) ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের দ্বারা সরস্বতী পুজার আয়োজন করার কথা প্রায় সবাই পড়েছে , এর আগেও দূর্গাপূজা, লক্ষীপূজা করতে দেখে গেছে তাঁদের, দেখা যাচ্ছে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা ধীরে ধীরে সনাতন বৈদিক হিন্দু সংস্কৃতির দিকে ঝুঁকছে অথচ তাঁদের ধর্মগ্ৰন্থে বলেই দেওয়া হয়েছে মূর্তিপূজা নৈব নৈব চ! এতটা পরিবর্তন কেন?
নিজের ৭০ তম জন্মদিনে মুসলিম প্রধান ইন্দোনেশিয়ায় ইসলাম ছেড়ে হিন্দু ধর্মে দীক্ষিত হয়েছেন প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট কন্যা। গত ২০ বছর ধরেই হিন্দু ধর্ম নিয়ে পড়াশুনা করেছেন সুকমাবতী। বালির প্রায় সমস্ত মন্দিরে যাওয়া ছাড়াও রামায়ণ, মহাভারতের মতো মহাকাব্যও তাঁর পড়া।আজকের দিনে ইন্দোনেশিয়া বিশ্বের সবথেকে বৃহৎ মুসলিম দেশ। কিন্তু এক সময় সেখানে হিন্দু ধর্মের মানুষের সংখ্যা বেশি ছিল বলে জানা যায়। যদিও, সেখানে ইসলামের আগমনের পর হিন্দুদের সংখ্যা কমতে থাকে। ২০২০ সালের এপ্রিল মাসের ১৮ তারিখে হরিয়ানার জিন্দ জেলার দানোরা গ্রামের ছয় পরিবারের সদস্যরা হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। ওই ছয় পরিবারের মোট সদস্য ছিল ৩৫ জন।ধর্মান্তরিত হয়ে যাওয়া পরিবারগুলির বক্তব্য হচ্ছে তাঁদের সঙ্গে ইসলামের সম্পর্ক ৩০০ বছরের। তার আগে এনাদের পূর্বপুরুষেরা হিন্দু ছিলেন। সম্রাট ঔরঙ্গজেবের সময়কালে বলপূর্বক তাঁদের ধর্মান্তরিত করা হয়। তিন শতাব্দী পরে শুধরে নেওয়া হল সেই ভুল। তবে হিন্দু রেওয়াজ অনুসারে অনেক কিছুই ওই গ্রামগুলিতে জারি ছিল বলে দাবি করেছেন ধর্মান্তরিত হওয়া সকলেই। ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রপতি জোকো উইদোদো গর্বের সাথে নিজেকে কৃষ্ণ ভক্ত বলে জনসমক্ষে উল্লেখ করে থাকেন। মূলত তাঁর উদ্যোগেই ইন্দোনেশিয়ায় প্রথম হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় ‘সুগ্রীব’ চালু হয়েছে। সুগ্রিভা বিশ্ববিদ্যালয় বালির ডেনপাসারে অবস্থিত। হিন্দু ধর্ম স্টেট ইনস্টিটিউটকে (আইএইচডিএন) ইন্দোনেশিয়ার প্রথম হিন্দু স্টেট বিশ্ববিদ্যালয় করা হয়েছে।মুসলিম দেশ ইন্দোনেশিয়া বরাবরই রামায়ণের স্মৃতি আঁকড়ে ধরে সনাতন সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধা অর্পণ করে থাকে। ওই দেশের অধিবাসীরা কার্যত স্বীকার ও করে থাকেন যে তাঁদের পূর্বপুরুষের ধর্ম হিন্দু ধর্ম।দেশে ইসলাম ছাড়ার প্রবণতাও লক্ষ্য করার মতো। সবচেয়ে বড় কথা হ’ল এই মুসলিম দেশটি হিন্দু ধর্মগ্রন্থ, রামায়ণ আমলের সুগ্রীবের নামে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরণ করেছে।ইরাক এখন মুসলিম দেশ হলেও সৌদি আরবের মতো এখানেও সনাতন ধর্ম বিস্তৃত হয়ে ছিল। কিন্তু ইসলাম প্রবেশ হওয়ার সাথে সাথে সনাতন ধর্মের সংস্কৃতিগুলি মুছে ফেলা হয়। তবে এখনও বার বার ইরাক থেকে সনাতন সংস্কৃতির চিন্হ ফুটে বেরিয়ে আসে। ইরাকে ভগবান রামের খোদাই করা মূর্তি পাওয়া গেছে। ইরাকে যাওয়া ভারতীয় প্রতিনিধিমন্ডল দেওয়ালে ছবি দেখতে পেয়েছে। এতে একটি বিবস্ত্র বুক থাকা রাজাকে দেখানো হয়েছে, যে ধনুকে তীর ধরে আছে, একটি তূণীর ও তার কোমরের পাট্টায় একটি ছুরি বা ছোট তলওয়ার লাগানো আছে। ভারত একসময় সম্পূর্নরূপে অখন্ড হিন্দু রাষ্ট্র ছিল যে কারণে ভারতীয়দের উচ্চস্তরীয় জীবন যাপনের সম্পর্কে জানার ও হিন্দুদের বিপুল ধনসম্পত্তির উপভোগ করার প্রতি প্রবল আগ্রহ ছিল বিদেশিদের। আর এই কারণেই বিদেশীদের দ্বারা সবথেকে বেশিবার আক্রন্ত হয়েছে ভারতবর্ষ। আর সেই কারণেই আজ ভারত মাতা বহু খণ্ডে বিভাজিত হয়েছে। এককালের সোনার পাখি বলে পরিচিত ভারত আজ তার নিজের সভ্যতা সঙ্গস্কৃতি ভুলে পাশ্চাত্যের সভ্যতা অনুসরণ করতে ব্যাস্ত হয়ে পড়েছে।আয়ারল্যান্ড এ ঝড়ের গতিতে ছড়িয়ে পড়ছে হিন্দু ধর্ম।জনগণনা অনুযায়ী বিগত ৫ বছরে হিন্দু জনসংখ্যায় ৩৪% বৃদ্ধি হয়েছে। আফ্রিকা অঞ্চলের দেশগুলো দরিদ্র হওয়ার পিছনে একটা বড় কারণ হচ্ছে দুর্নীতি এবং সন্ত্রাসী। কিন্তু এখানে উল্লেখ করার মতো বিষয় হলো মরিশাসে দুর্নীতি ও সন্ত্রাসবাদের আকার নেই বললেই চলে। দেশটির বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় ১৩ লক্ষ তার মধ্যে প্রায় ৭.৫ লক্ষ মানুষ “সনাতন ধর্ম হিন্দু” ধর্মাবলম্বী।হিন্দুধর্ম মরিশাসে শান্তি এবং মানবতার ধর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।হোয়াইট হাউস থেকে প্রায় এক মাইল দূরে দেবী সরস্বতীর মূর্তি ২০১৪ এ ইন্দোনেশিয়া প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি স্থাপন করে।ইন্দোনেশিয়ান দূতাবাসের একজন মুখপাত্র বলেছেন, “সরস্বতী হিন্দুদের দেবী। ইন্দোনেশিয়ার বালিতে মূলত একই ধর্মের লোকেরা বাস করেন এবং এই মূর্তিটি বালির শিল্পের চিত্র তুলে ধরেছে।” মূর্তিটিতে দেবী সরস্বতীর চার হাতকে চিত্রিত করা হয়েছে যারা বিভিন্ন বার্তা দেয়। এর মধ্যে একটি হস্তের অক্ষমাল যা জ্ঞানের ধারাবাহিক প্রক্রিয়া চিত্রিত করে, দু’জন হাতে বীণা বাজাচ্ছেন যা শিল্প ও সংস্কৃতির প্রতীক এবং তৃতীয়টিতে একটি পাণ্ডুলিপি রয়েছে এবং তারপরে জ্ঞানের উৎস দেখায়।এছাড়াও, সরস্বতী যে পদ্মে দাঁড়িয়ে আছেন তা জ্ঞানের বিশুদ্ধতা এবং রাজহাঁস জ্ঞান থেকে প্রাপ্ত জ্ঞানের প্রতীক।” মুখপাত্র বলেছেন, “এই মূর্তিটি সাংস্কৃতিক প্রতীকের একটি রূপ যা তাঁদের রক্তে মিশে থাকা ঐতিহ্যবাহী সনাতন সংস্কৃতির শিক্ষা।দীর্ঘ বছর যাবৎ চলে আসা বিভিন্ন মতাদর্শে বিশ্বাসী মানুষের বা প্রতিষ্ঠানের প্রচেষ্টা কে সম্পূর্ণ বিফল করে রক্তে মিশে থাকা সনাতন সংস্কৃতিকে পুণরায় নিজের জীবনে পাথেয় করার যে অধ্যায় শুরু হয়েছে ,আগামীতে তা আরোও প্রশস্ত হোক , কোনো রকম উত্তেজক পরিস্থিতি এতে বাধা দিতে পারবে না – এটা হওয়ারই ছিল।
- সপ্তর্ষি ভট্টাচার্য্য