একটা সময় ছিল যখন বিতর্ক তৈরির একমাত্র মাধ্যম ছিল খবরের কাগজ। বামপন্থী হার্মাদদের দিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মাথা ফাটিয়ে জ্যোতি বসু বলতেন, “যাক! এতক্ষণে ব্যাপারটা আমিষগন্ধী হলো। বাম নেতার এহেন অশিষ্টাচারের প্রতিবাদে কেউ কেউ সংবাদপত্রের চিঠিপত্র বিভাগে চিঠি লিখতেন। কিন্তু তারা সংখ্যায় ছিলেন অল্প। এখন যদি কেউ জ্যোতিবাবুর মতো ভেবেচিন্তে বাজার গরম করা মন্তব্য করেন তাহলে আর রক্ষে থাকবে না। পুরো খিল্লি হয়ে যাবেন। যেমন হচ্ছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি একজন প্রিয়াঙ্কা শর্মাকে চমকাতে গিয়ে অন্তত কয়েক ডজন প্রিয়াঙ্কা শর্মার জন্ম দিয়ে ফেলেছেন। এখন ঘণ্টায় ঘণ্টায় মমতাকে নিয়ে মিম তৈরি হচ্ছে। কতজনকে অ্যারেস্ট করবে পুলিশ? সুতরাং, ‘এবার বাঙ্গলা পারলে সামলা।
একই সমস্যায় পড়েছেন দক্ষিণের সুপারস্টার কমল হাসানও। সিনেমার কোনও দৃশ্য ভালো লাগলে চটরপটর হাততালি দেয় পাবলিক। এই হাততালির লোভ বড়ো সাংঘাতিক। কখন কাজের জন্য হাততালি পাচ্ছেন আর কখন হাততালির জন্য কাজ করছেন সেই বিচারবোধ অভিনেতাদের সবসময় থাকে না। কমল হাসান সেটি একেবারে হারিয়েছেন। কিছুদিন আগে তামিলনাড়ুর আরাভাকুরিচিতে আসন্ন উপনির্বাচনে কমলের নিজের দল মাক্কাল নিধি মাইয়মের হয়ে ভোট চাইতে গিয়ে তিনি বলেন, স্বাধীন ভারতের প্রথম সন্ত্রাসবাদী ছিলেন একজন হিন্দু। তার নাম নাথুরাম গডসে। স্বাভাবিকভাবেই ক্ষুব্ধ হন সারা দেশের মানুষ। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড় বয়ে যায়। প্রশ্ন ওঠে, আরাভাকুরিচি মুসলমান প্রধান বলেই কি কমলের এই মন্তব্য? না কি এর পিছনে রয়েছে গোপন কোনও ষড়যন্ত্র ?
অনেকেই হয়তো বলবেন, অতি ব্যবহারে ষড়যন্ত্রের তত্ত্বটি আজকাল বেজায় ক্লিশে হয়ে গেছে। কিন্তু স্বাধীনোত্তর ভারতবর্ষের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটটি বিবেচনার মধ্যে রেখে যদি কমল হাসানের মন্তব্যটি বিচার করা হয় তাহলে দেখা যাবে দক্ষিণী অভিনেতা আলটপকা কিছু বলেননি। অন্তত বিচক্ষণতানা হোক, দেশের মূলধারার রাজনৈতিক চালাকিটি তিনি ভালোই রপ্ত করেছেন। ভারতবর্ষ গান্ধীজীকে শ্রদ্ধা করে। সুতরাং তার হত্যাকারীকে এ দেশ কোনওদিনই ক্ষমা করবে না। এ তো সবাই জানে। কিন্তু এসব কথাবার্তায় রাজনৈতিক লাভ কোথায়? বস্তাপচা ডায়ালগ আউড়ালে চিড়ে ভেজে না। বিশেষ করে চিড়ে যদি মুসলমান হয়। হ্যা, লাভ হতে পারে নাথুরাম গডসেকে যদি হিন্দু হিসেবে তুলে ধরা যায়! কথাটা মিথ্যেও নয়। নাথুরাম হিন্দু তো ছিলেনই, তার ওপর ছিলেন ব্রাহ্মণ। যে কারণে গান্ধীহত্যার পরেই গোটা মহারাষ্ট্র জুড়ে শুরু হয়েছিল ব্রাহ্মণ-হত্যা। তখন ক্ষমতায় কংগ্রেস। ব্রাহ্মণদের পাশে দাঁড়ালে পাছে ধর্মনিরপেক্ষ ভাবমূর্তিতে কালি লাগে তাই কংগ্রেস হাত গুটিয়ে বসে ছিল। স্বাধীনতার পর সুদীর্ঘ শাসনকালে এইভাবে স্রেফ রাজনৈতিক ফয়দা লোটার জন্য কংগ্রেস যে কত হিন্দুকে খুন হতে দিয়েছে। তার কোনও হিসেব নেই।
কমল হাসান কংগ্রেসের এই ছক ভালোই বোঝেন। তিনি জানেন সহস্রাধিক বছর ধরে একতরফা মার খেতে খেতে হিন্দুদের পরমতসহিষ্ণুতার মতো মহান আদর্শ এখন এক রসিকতায় পরিণত হয়েছে। নাথুরাম গডসের হিন্দু পরিচয় তুলে ধরলে হিন্দু সন্ত্রাসের অস্তিত্ব সম্পর্কিত বিতর্কটি আরেকবার উসকে দেওয়া যায়। যতই আদালত বলুক, হিন্দুত্ব নিছক ধর্ম নয়। এটি জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সব মানুষের জীবনযাপনের পথনির্দেশ। কমল হাসান জানেন, এদেশে গুজবের স্থান আইনের অনেক ওপরে। বিশেষ করে সেই গুজব যদি কমল হাসানের মতো সুপারস্টার অভিনেতা এবং সিনেমার জনপ্রিয়তা- ভাঙানো রাজনীতিবিদের মুখ থেকে ছড়ায় তাহলে তো আর কথাই নেই। গল্পের গোরুর গাছে চড়তে বেশি সময় লাগে না। কমল হাসান এটাও জানেন, নাথুরামকে হিন্দু সন্ত্রাসবাদী বলার অছিলায় হিন্দু সন্ত্রাসের হাস্যকর। ধারণাটি বাজারে ছাড়লে হিন্দুরা বড়োজোর দু-চারদিন একটু হৈ চৈ করবে। তারপর ভুলে যাবে। কিন্তু খুশি হবে মুসলমানরা। আরাভাকুরিচি মুসলমান-অধ্যুষিত জায়গা। সুতরাং মুসলমানদের বশে রাখতে হিন্দুদের যত পারো গালাগাল দাও। মুসলমানদের বোঝাও, সারা বিশ্ব তাদের সন্ত্রাসবাদী ভাবলেও, ইসলামকে জিহাদি ধর্ম হিসেবে মানলেও—এই ভারতবর্ষে তারা একা জঙ্গি নয়। হিন্দুরাও জঙ্গি। নাথুরাম গডসে হিন্দু সন্ত্রাসবাদের প্রতিনিধি। তার অপরাধও কিছু কম নয়। তিনি এ দেশে রাজনৈতিক অভিজাততন্ত্রের জনক গান্ধীজীকে হত্যা করেছিলেন। কমল হাসান এই অভিজাততন্ত্রেরই ফসল। সুতরাং ভারতবর্ষে অধুনা-বিকশিত চা-ওয়ালা মার্কা রাজনৈতিক প্রজ্ঞায় তার রুচি থাকবে না, এটা স্বাভাবিক। এবং তিনি ও তার দোসররা পেডিগ্রিকে ভারতীয় রাজনীতিতে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে সচেষ্ট হবেন। আমরা যারা বাঙ্গালি তারা দেখব, পশ্চিমবঙ্গে কচিকাচাদের পাঠ্যপুস্তকে ক্ষুদিরাম-প্রফুল্ল চাকিরা ‘সন্ত্রাসবাদী’ শিরোপায় ভূষিত হয়েছেন।
এখন পশ্চিমবঙ্গে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে সশস্ত্র আন্দোলনকারীদের জঙ্গি বলা হচ্ছে। কারণ সশস্ত্র আন্দোলন তো বটেই, গান্ধীজীর নেতৃত্বে যে অহিংস আন্দোলন হয়েছিল—সেটাও ছিল হিন্দু জাতীয়তাবাদী আন্দোলন। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে মুসলমানদের দলে টানার জন্য গান্ধীজী খিলাফতের মতো ভারতবর্ষ ও ভারতীয়ত্বের সঙ্গে সম্পর্কহীন একটি কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলেন। এই কর্মসূচি রদপায়ণে পদ্ধতিগত ত্রুটির কথা স্বীকার করে নিয়েও বলা চলে কোনও অসৎ উদ্দেশ্য গান্ধীজীর ছিল না। তিনি শুধু মুসলমানদের ভারতের জাতীয় আন্দোলনে মেলাতে চেয়েছিলেন। ভারতীয় সমাজে সর্বোদয়ের প্রবক্তার পক্ষে এই চাওয়া খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু লাভ কিছু হয়নি। গান্ধীজী মুসলমানদের বুঝতেই পারেননি। মুসলমানরা কংগ্রেসকে হিন্দুদের দল হিসেবে দেগে দিয়ে মুসলিম লিগের ছাতার তলায় ভিড়েছিল। তবে গান্ধীজীর এই অপরিণামদর্শিতায় উপকার হয়েছিল কংগ্রেসের। ধর্মনিরপেক্ষতা নামক পাঁচনের মশলা পাওয়া গিয়েছিল খিলাফতের ভাঁড়ারে। সত্তর বছর ধরে দেশের প্রতিটি মানুষ এই পাঁচন দুধের সঙ্গে মিশিয়ে খাচ্ছে। বস্তুত এই পাঁচনের ঘোরেই হিন্দুরা এতকাল ঘুমিয়ে ছিল। দেশভাগের পর কুড়ি লক্ষ হিন্দুকে হত্যা, কাশ্মীরি পণ্ডিতদের বিতাড়ন, পশ্চিমবঙ্গে মরিচঝাপি, ১৭ জন আনন্দমার্গী সন্ন্যাসীকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা ইত্যাদি খবরের শিরোনাম হলেও হিন্দুদের মনে খুব একটা রেখাপাত করেনি। মুসলমানের হাতে কাটারি দেখে ভয়ে ঘরে ঢুকে পড়া হিন্দু ধর্মনিরপেক্ষতার চাদরে মুখ ঢেকে প্রাণ যেমন বাঁচিয়েছে, তেমনি বাঁচিয়ে রেখেছে। কংগ্রেস নামক ক্ষমতালোলুপ প্রতিষ্ঠানটিকেও।
কমল হাসানও কংগ্রেসের এই পাঁচন মানুষকে খাওয়াতে চান। কিন্তু মুশকিল হলো আজকের ভারতের অবিসংবাদী নেতার নাম নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদী। আজকের ভারতের প্রধান রাজনৈতিক দল ভারতীয় জনতা পার্টি। আজকের ভারতের আত্মনির্মাণের কারিগর রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ। নাথুরাম গডসেকে হিন্দু সন্ত্রাসবাদী বলার সময় কমল হাসান সম্ভবত এই কথাগুলো ভুলে গিয়েছিলেন। তবে তাতে ক্ষতি কিছু হয়নি। হিন্দুরা যে পাঁচনের ঘোর কাটিয়ে জেগে উঠছেন, সেকথা তাকে মনে করিয়ে দিয়েছেন এক অত্যুৎসাহী ব্যক্তি। পায়ের জুতোটি খুলে ছুঁড়ে মেরেছেন কমল হাসানকে লক্ষ্য করে। না, তার কাজ মোটেই সমর্থনযোগ্য নয়। কিন্তু তার ক্ষোভ এবং উত্তেজনাবশত ভালোমন্দের জ্ঞান হারিয়ে ফেলা— দুটোই এক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য। ধর্মনিরপেক্ষতার নামে নির্বিচার মুসলমান তোষণের বিরদ্ধে সাধারণ মানুষ কি সোশ্যাল মিডিয়ায় এইভাবেই ফুসে উঠছেন না? খবরের কাগজ যে গল্পই শোনাক, ধর্মনিরপেক্ষতার তত্ত্বটিকে প্রত্যাখ্যান করছে। মানুষ। কারণ সবাই জেনে গেছে আমাদের দেশে ধর্মনিরপেক্ষতা মানে হিন্দুবিদ্বেষ। প্রতিটি ধর্মনিরপেক্ষ দলের রাজনৈতিক দর্শন। মোটামুটি এক। হিন্দুদের ভাগ করো আর মুসলমানদের এক করো। বাম হোন বা কংগ্রেসি, মমতাপন্থী হোন বা মায়াবতীপন্থী—মোল্লাতন্ত্রের পিঠ চাপড়ানি না পেলে এদেশের রাজনৈতিক নেতারা নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে পারেন না। ইফতার পার্টিতে মমতা হিজাব পরেন, নমাজ পড়েন, রাহুল গান্ধীকে মাথায় ফেজটুপি পরে গদোগদো হয়ে উঠতে দেখা যায়। বাঙ্গলার মমতাপন্থী কবি সুবোধ সরকার গোরুর মাংসের প্লেট হাতে রাস্তায় সস্তা নাটক করেন। এসব সাধারণ মানুষ এতদিন শুধু দেখার জন্য দেখেছেন। গা গুলিয়ে উঠলেও প্রতিবাদ করেননি। কিন্তু এখন তাদের মুখ ফুটেছে। এখন তারা এইসব উলঙ্গ রাজাদের সামনে দাঁড়াতে পারেন। জিজ্ঞাসা করতে পারেন, রাজা তোর কাপড় কোথায়?
কমল হাসান কি হিন্দুদের জেগে ওঠার কথা জানেন ? না জানলে জেনে নিন। ভুলভাল টনিক দিলে পাবলিকের বদহজম বাড়বে। এই পাবলিক কিন্তু কথা বলতে পারে। পেডিগ্রির ধার না ধেরে ক্ষোভও উগরে দেয়।
সন্দীপ চক্রবর্তী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.