কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী একটি কবিতায় লিখেছিলেন, “আমার ভেতরে কোনও দল নেই। এই সময়ের কবি শিল্পী এবং সিনেমা ও নাট্যজগতের কুশীলবদের প্রগাঢ় রাজনীতিমনস্কতার প্রেক্ষিতে কথাটি প্রণিধানযোগ্য। কারণ দল বলতে আমরা সাধারণভাবে আজকাল রাজনৈতিক দল বুঝি। একজন কবি যদি কোনও বিশেষ রাজনীতির পক্ষপাতী হন তাহলে তিনি বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়ায় অন্য অনেক রাজনীতি থেকে দূরে সরে যান। পরোক্ষত তার রাজনীতিতে বিশ্বাসী নন এমন বহু। মানুষের থেকেই তাকে দূরে সরে যেতে হয়।
কিছুদিন আগে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ছ’শো নাট্যশিল্পী মানুষের কাছ থেকে দূরে সরে যাওয়ার চরম উদাহরণ পেশ করেছেন। সারা দেশে যখন নির্বাচন চলছে ঠিক তার প্রাক মুহূর্তে মানুষের কাছে তাদের আবেদন বিজেপিকে ভোট দেবেন না। কারণ গত পাঁচ বছরে নরেন্দ্র মোদী সরকার চরম অসহিষ্ণুতার পরিচয় দিয়েছে। তিনি যদি আবার ক্ষমতায় আসেন তাহলে দেশে দলিত ও মুসলমানরা আর থাকতে পারবে না। দেশে গোরক্ষকদের তাণ্ডব বাড়বে। সুতরাং নরন্দ্রে মোদীকে একটি ভোটও নয়। নাট্যশিল্পীদের এই দলটির প্রধান মুখ ছিলেন নাসিরুদ্দিন শাহ, গিরিশ কারনাড, কঙ্কনা সেনশর্মা প্রমুখ।
প্রশ্ন হলো, এমন একটি আবেদন রেখে কীভাবে তারা মানুষের কাছ থেকে দুরে সরে গেলেন? হিন্দুরাই ভারতে সংখ্যাগরিষ্ঠ। নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় ফিরলে দেশটা জনজাতি (সেকুলারদের ভাষায় দলিত) ও মুসলমানদের কাছে বসবাসের অযোগ্য হয়ে যাবে— এমন বাক্যবন্ধের মানে দেশ শুধু হিন্দুদের বসবাসের যোগ্য হয়েই থাকবে। এটা কি হিন্দু মুসলমানের মধ্যে বিভাজন নয়? সেইসঙ্গে, এটা কি শিল্পী হিসেবে নাসিরুদ্দিনদের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কাছ থেকে দূরে সরে যাওয়া নয়?
একটা জিনিস স্পষ্ট, অতীতের কথা নাসিরুদ্দিন বড়ো তাড়াতাড়ি ভুলে যান। তিনি ভুলে গেছেন, হিন্দুরাই মুখ্যত তাকে নাসিরুদ্দিন শাহ বানিয়েছিল। আশির দশকে তাঁর আর্ট-ফিল্ম। বোঝার মতো বিদ্যেবুদ্ধি এ দেশের সাধারণ মুসলমানদের ছিল, এমন অবান্তর দাবি বোধ হয় নাসিরুদ্দিনও করবেন না। তবুও তিনি হিন্দু বিদ্বেষী। নাসিরুদ্দিনকে বুঝতে আরও একটু পিছিয়ে যাওয়া যেতে পারে। সময়টা আশির দশকই। ১৯৮৪ সাল। সেই বছরই নাসিরুদ্দিন পদ্মশ্রী সম্মান পেয়েছিলেন। তাকে সম্মান দিয়েছিল রাজীব গান্ধীর কংগ্রেস সরকার। ১৯৮৪ সালেই ইন্দিরা গান্ধীর হত্যাকাণ্ডের পর প্রতিশোধমত্ত কংগ্রেসের তত্ত্বাবধানে দিল্লিতে ভয়াবহ শিখ নিধন হয়েছিল। একদিনেই মারা গিয়েছিলেন তিন সহস্রাধিক শিখ ধর্মাবলম্বী মানুষ। সারা দেশের নিরীহ শান্তিকামী মানুষের বুক কাপানো মন্তব্য করেছিলেন রাজীব গান্ধী– বড়ো গাছ পড়ে গেলে চারপাশের মাটি এরকম একটু আধটু কাপে। সেদিন ভয়াবহ শিখনিধনকে কার্যত সমর্থনই কারছিলেন রাজীব। অথচ এহেন রাজীবের কংগ্রেসের কাছ থেকে পুরস্কার নিতে নাসিরুদ্দিনের বাধেনি। তার একবারও মনে হয়নি, যেখানে সংখ্যালঘু শিখেরা বিপন্ন, অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ও সেখানে শান্তিতে থাকতে পারে না।নাসিরুদ্দিন নিজেও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ কিন্তু শিখ হত্যাকারী রাজীব গান্ধীর মধ্যে অসহিষ্ণুতা দেখেননি। দেখেছেন নরেন্দ্র মোদীর মধ্যে। অথচ নরেন্দ্র মোদী এমন একজন প্রধানমন্ত্রী যার আমলে কোথাও কোনও দাঙ্গা হয়নি।
শিল্প-সাহিত্যকে কমিউনিস্টরা যেভাবে প্রোপাগান্ডার মাধ্যম করেছে আর কেউ সেভাবে করেনি। যার ফলে বহু ভেজাল সাহিত্য মুলধারার সাহিত্যে জায়গা করে নিয়েছে। গিরিশ কারনাডের নাটকেও আমরা সেই প্রোপাগান্ডা দেখতে পাই। ভারত এদের কাছে শোষিত নিপীড়িত অত্যাচারিত মানুষের দেশ। এবং শোষক নিপীড়ক অত্যাচারীমুলত হিন্দুরা। না, অবশ্যই সব হিন্দু নয়। কমিউনিস্টদের বিচারে তথাকথিত বর্ণহিন্দুরাই শ্রেণীশত্রু। দীর্ঘকাল ধরে হিন্দু সমাজকে ভাগ করার চেষ্টা চলছে। একদিকে বর্ণহিন্দু, অন্যদিকে তথাকথিত নীচু জাত। এই প্রক্রিয়া চালাতে পারলে বেশ লাভ হয়। রাজ্যগুলিতে আঞ্চলিক দলের ভূতের নেত্য শুরু হয় আর কেন্দ্রে কংগ্রেস বার বার ফিরে আসে। কংগ্রেসের সঙ্গে কমিউনিস্টদের বোঝাপড়াটা অদ্ভুত। অনেকটা তেল আর জলের মতো। দুটিতে মিলমিশ হয় না বলে সাধারণ্যে একটা ধারণা আছে। কিন্তু ওটা ভুল ধারণা। ঝালে-ঝোলে-অম্বলে তেল আর জল বেশ মিলেমিশে যায়।
কংগ্রেস ক্ষমতায় থাকলে আরও একটা লাভ আছে। যে সব সংস্থা নাসিরুদ্দিনদের চালনা করে তাদের অ্যাকাউন্টে বিদেশি অর্থের পাহাড় জমতে থাকে। কংগ্রেস এবং কমিউনিস্টদের উদ্দেশ্য যেহেতু দেশকে উৎসনে পাঠানো, তাইনাসিরুদ্দিন শাহ গিরিশ কারনাড়দের চালিকাশক্তি এনজিওগুলি দেশের স্বার্থবিরোধী কাজ করলেও কেউ কিছু বলে না। চলছে চলবে স্লোগানের নীচে ঢাকা পড়ে দেশের মানুষের মুখ। সাহিত্যের সংজ্ঞা নির্ধারণ করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন সহিতের ভাবকে বলে সাহিত্য। সাদা বাংলায়, সাহিত্য হলো মানুষকে কমিউনিকেট করার মাধ্যম। ঠিক এই জায়গায় গিরিশ – নাসিরুদ্দিনরা অনেকটা পিছনে পড়ে যান। তাদের কাজমানুষকে স্পর্শ করতে পারেনা। ইন্টেলেকচুয়াল বলে আর একটা গোষ্ঠী তৈরি করতে হয়। বাংলায় যেশব্দের অপভ্রংশ হলো আঁতেল। নাসিরুদ্দিনরা আঁতেলের কুরঙ্গেই মেতে উঠেছেন। এই বয়সে এমন ভুলভাল মাতামাতি না করলেই ভালো করতেন।
সন্দীপ চক্রবর্তী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.