পারসিক ধর্ম জরাথুস্ট্রবাদ

” পারসিক ধর্ম জরাথুস্ট্রবাদ “

( Magianism / Zarathustraism )!

 সুপ্রাচীন ঐতিহাসিক এই ধর্মটির উৎপত্তি প্রাচীন পারস্য বা আজকের ইরানে খ্রিস্টপূর্ব ১৮০০ থেকে ১২০০ শতাব্দীর মধ্যে ৷ জরাথুস্ট্র নামটি প্রাচীন ফারসী ভাষার জর(নত) বা পুরানো + উস্ত্র বা উট ৷ আসল অর্থ বুড়ো উটওয়ালা ৷ আরেক মতে জরেদ্ মানে সোনালী বা হলুদ উট ওয়ালা ৷ এর প্রকৃত তাৎপর্য "সোনালী ভোর এনেছেন যিনি " বা যিনি আলো ভালোবাসেন ৷ তিনি পূর্ব ইরানে এক গ্রামের  ১৫ বছর বয়সী এক কুমারী মায়ের সন্তান ৷ যাঁর পিতা মাতার নাম পরুসাস্পা স্পিতামা ও দুগ্দভা ৷ তাঁর স্ত্রীর নাম হভভি ৷ ১৫ বছর বয়সে তাঁদের বিয়ে হয় ৷তিন ছেলে মেয়ের বাবা ছিলেন জরাথুস্ট্র ৷ ফ্রেনি , পরুসিস্তা , ট্রিটি , ইসাত ভাসটার , উরুভাত নারা ও হাভেরে সিওরা ৷ তিনি ৭৭ বেঁচে ছিলেন ৷ দীর্ঘদিন তপস্যা করে তিনি প্রকৃত জ্ঞান লাভ করেন ৷ ৩০ বছরে তাঁর ঈশ্বর অনুভূতি লাভ হয় ৷ ৪০ বছর বয়সে ব্যাকট্রিয়ার রাজা ভিশতাস্প প্রথম তাঁর ধর্ম গ্রহণ করেন ৷ রাজ আনুকূল্যে তা ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ে  ৷এই মজদাযস্ন ধর্মটি বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন একেশ্বর বাদী ধর্ম ৷যদিও একে ইসলাম বা ইহুদিদের মত একেশ্বরবাদী না বলে বহু ঈশ্বরবাদী প্রথাকে একক ও সার্বভৌম ঈশ্বরের ধারনায় আনার প্রয়াস বলা যায় ৷তিনি ঈশ্বরের দুটি রূপের কথা বর্ণনা করেন ৷ এই দুটি সত্ত্বা হলো স্পেন্টা মাইনু বা ঈশ্বর সত্য ও কল্যাণকে বোঝায় ৷ আর আঙরা মাইনু  বা শয়তান মিথ্যা ও কুকর্মের নির্দেশক ৷ মানুষের যেকোনটি বাছার স্বাধীনতা আছে ৷সারা জীবন মানুষের মধ্যে ঐ দ্বৈত সত্তার লড়াই চলে ৷যারা আশা বা সৎ পথের অনুগামী তারা স্বর্গে , যারা দ্রুজ বা অসৎ তারা নরকে এবং বাকীরা মাঝামাঝি স্থান হামিস্তাগানে মৃত্যুর পর ঠাঁই পাবে ৷বিচার কাজ পরিচালনা করবে চিনভত নামে এক সেতুর উপর ৷ আর বিচার করবে একটা তরোয়াল ৷ এই ধর্ম ইহুদিদের চেয়ে পুরানো মনোলিথিক বা একেশ্বরবাদী ধর্ম ৷ মূর্তি পুজোয় বিশ্বাসী নয় ৷জরাথুস্ট্রবাদ পরবর্তীতে ইহুদি মতবাদের অগ্রগতি ও খ্রিস্টীয় মতবাদের জন্মকে প্রভাবিত করে ৷ম্যাথু লিখিত সুসমাচারে তিনজন জরাথুস্ট্র ধর্মযাজক বা ম্যাজাই এর উল্লেখ আছে ৷বৈদিক হিন্দু দেবতা ইন্দ্র ও মিত্রের ( মিথরা) কথা জেন্দাবেস্তা পাওয়া যায় ৷ জরাথুস্ট্রর  কাছ থেকে পিথাগোরাস নির্দেশনা লাভ করেন এবং ক্যালিডীয়রা জ্যোতিষ ও যাদুবিদ্যায় অনুপ্রাণিত হয় বলে এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার অভিমত ৷মহাকাব্যে গ্রিক -পার্সিয়ার যুদ্ধের বর্ণনা আছে ৷ পারসী ধর্ম বলে পরিচিত জরাথুস্ট্রবাদে সর্বশক্তিমান ঈশ্বর হলেন " আহুর মাজদা" ৷ মানে সর্বজ্ঞান স্বামী ৷ একসময় ইরানের হাখমানেশী , পার্থীয় ও সাসানীয় সামাজ্য সহ মধ্য প্রাচ্যের বিরাট অংশে তা প্রধান ধর্ম ছিল ৷ গ্রেট সাইরাস ছিলেন বিখ্যাত পার্সি রাজা ৷ যাঁর আমলে এই ধর্মের সবচেয়ে বৃদ্ধি হয় ৷ এখন সারা পৃথিবীতে এক লক্ষ ত্রিশ হাজার অনুসারী নিয়ে ক্রমক্ষীয়মান ৷ভারতে আছেন ষাট হাজার পার্সি ৷অন্য কেউ এই ধর্ম গ্রহণ করতে পারে না ৷ এমনকি অন্য ধর্মে পারসিক পুরুষ বা মহিলা বিয়ে করলেও তাঁদের সমাজ ভালভাবে গ্রহণ করে না ৷পার্শি মহিলারা অন্য ধর্মে বিয়ে করে সমাজ চ্যুত হয় ৷ জন্মহার খুব কম তার মৃত্যুহার বেশী ৷ অধিকাংশ বয়স্ক ৷ সংখ্যায় কমে যাওয়ায় এঁদের অনেকে অবিবাহিত থাকতে বাধ্য হন ৷ বাঙ্গালোরে দুই অবিবাহিত ভাই -বোনের সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিল ৷ কথা প্রসঙ্গে বলে ছিলেন একথা ৷ অনেক সময় স্ত্রী স্বামীর চেয়ে বয়সে বড় হয় ৷ মুসলিম, মোঙ্গল ও তুর্কীদের অত্যাচারে অধিকাংশ পারসিক ভারতে পালিয়ে আসতে বাধ্য হন ৷ অনেকে ইসলাম গ্রহণে বাধ্য হয় ৷ নয় জিজিয়া কর দিয়ে ওখানে ( এখন ১৫০০০) থেকে যায় ৷"বসুধৈব কুটুম্বকমে " বিশ্বাসী হিন্দুরা তাঁদের এদেশে আশ্রয় নেন ৷ সবচেয়ে সংখ্যালঘু ( ভারতের জনসংখ্যার .০০৪%) হলেও তাঁদের উপর কোন সংখ্যাগুরু মানুষ অত্যাচার করেছেন এমন দৃষ্টান্ত নেই ৷ ১২০০ বছর আগে প্রথম  গুজরাটের একটা ছোট রাজ্যে ( সঞ্জান)আশ্রয় নেন ৷ সেখানকার রাজা এক গ্লাস ভরতি দুধ দিয়ে বলেছিলেন তাঁর রাজত্বে এত লোকের জায়গা হবে না ৷ তখন পারসিকরা ঐ দুধে  চিনি দিয়ে দেখান পাত্র উপচে পড়ছে না ৷ সুজন হয়ে থাকবেন গ্লাসের দুধে চিনি গলে মিশে যাবে ৷ এঁরা স্থানীয় ভাষা ও মহিলাদের পোশাক হিসাবে শাড়ি গ্রহণ করে ৷ তারপর থেকে অধিকাংশ পারসিক নিজ ধর্ম বজায় রেখে ভারতের সুনাগরিক রূপে থেকে যান ৷ এখন অর্ধেকের উপর পারসিক ভারতে আছেন ৷ আর তার বেশীটাই মুম্বাই মহানগরীতে ৷ কাঠ , সিল্ক , তুলা ও আফিনের ব্যবসায় বিশেষ সাফল্য পায় ৷এঁদের ধর্মগ্রন্থের নাম "জেন্দাবেস্তা " ৷এঁরা আগুনকে অত্যন্ত পবিত্র ও ঈশ্বরের প্রতিভূ ভাবলেও তাঁরা অগ্নি উপাসক নয় ৷ এতে তাঁদের আধ্যাত্মিক জ্ঞান ও অন্তর্দৃষ্টি জাগ্রত হয় ৷এনাদের উপাসনালয়ে বা আগুনের ঘরে ন্যায় , সত্য ও শুদ্ধতার প্রতীক রূপে  সবসময় আগুন জ্বলে ৷ এঁরা জলকে আগুনের উৎস মনে করেন ৷ আগুন(  আতার বা আযার) আর জল  (আপো বা আবান)জীবন ধারনের জন্য অপরিহার্য বলেই হয়তো এমন ধারনা ৷জেন্দাবেস্তার ভাষার সঙ্গে ঋকবেদের ভাষার বেশ মিল লক্ষ্য করা যায় ৷ তবে , ঋকবেদের পরবর্তী ৷ খ্রিস্টানদের ব্যাপ্তিজম , ইসলাম ও ইহুদি ধর্মাবলম্বীদের  সুন্নৎ ( লিঙ্গের অগ্রত্বক ছেদন) কিংবা ব্রাহ্মণদের উপনয়ণের মত এই ধর্মের মানুষকে সাত বছরের পর "নওজোত" বা নবজোত আচার পালন করতে হয় ৷ এঁরা উপাসনার সময় একরকম টুপি পড়েন (ধামাল সিনেমা দেখে থাকলে দেখতে পাবেন) যা ইহুদি , খ্রিস্টান বা মুসলমানদের চেয়ে আলাদা ৷সবচেয়ে এঁদের মৃতদেহ অন্ত্যেষ্টীর প্রক্রিয়া ৷ এঁদের উপাসনালয় গুলি টাওয়ারের মত বর্গাকৃতির ৷দেওয়ালে থাকে "আসো ফরোহর" তাঁদের ধর্মীয় প্রতীক ৷এরকম তিনটি উপাসনালয়ে অনির্বাণ আগুনের শিখা আজও প্রবাহমান ৷যা সরাসরি আহুর মাজদা থেকে পাওয়া ৷ভারতে বর্তমানে দার ই মিহ্র অর্থাৎ এনাদের মন্দির আছে ১৬০ টি ৷পারসিক বিশ্বাস মৃত্যুর পর দেহে প্রবেশ করে অশুভ আত্মা  চারপাশ অশুভ হয়ে যায় ৷ তাই এঁদের মৃতদেহ পুড়িয়ে বা কবর না দিয়ে শব রেখে দেওয়া হয় দাখমাহে অর্থাৎ  পাহাড় বা টিলার শিখরে ( মুম্বাই য়ের সেই  সাইলেন্স  অফ টাওয়ারর ছবি) ৷ দক্ষিণ মুম্বাইয়ের মালাবার হিলের জঙ্গলে  ৬৬  একর জমির উপর নির্মীত এই দাখমাহে সারা বিশ্ব থেকে অনেক পার্সি মৃতদেহ অন্ত্যেষ্টির জন্য আনা হয় ৷যাতে শকুনে দেহ ভক্ষণ করে ৷ পরে থাকা হাড় এক বছর রোদে শুকিয়ে কৃষিকাজের সার হিসাবে ব্যবহৃত হয় ৷ আগুন , জল ও মাটি বা পৃথিবী তাঁদের কাছে পবিত্র তাই এমন সৎকার প্রক্রিয়া ৷মিনার থেকে যাতে বৃষ্টির জল বেরোতে না পারে নিচে থাকে গভীর কুয়ো ৷তাই এনাদের মৃতদেহ সৎকারে খরচ নেই বরং তাঁদের মিতব্যয়িতার প্রমাণ মেলে ৷এতে পরিবেশ ভালো থাকে ৷ বিলুপ্ত প্রিয় পাখি শকুন বেঁচে থাকে ৷বিখ্যাত ভারতীয় পার্শীদের কথা জেনে আমার ওনাদের সম্পর্কে উৎসাহ ছিল ৷এঁদের ( Zoroastrinism)নামের সঙ্গে মুসলমানদের নামের মিলের কারণ তা পার্সি নাম ৷ ১৯৭১ এর যুদ্ধে প্রধান নায়ক স্যাম হরমাসাজি ফ্রেমজি জামসেদজি ম্যানকেশ ছিলেন আমার এক আইডল ৷ছেলেবেলায় ক্রিকেটার ফারুক ইঞ্জিনীয়ারের উইকেট কিপিং উদ্বুদ্ধ করত ৷ভারতের সবচেয়ে শ্রদ্ধেয় শিল্পপতি  জামসেদজী ও রতন টাটা থেকে বোম্বে ডাইং এর ওয়াদিয়া , সাইরাস মিস্ত্রি ,গোদরেজ  এমনকি বর্তমানের কোভিশিল্ড নির্মাতা বিশ্বে ভ্যাকসিনের সর্বাধিক নির্মাতা সিরাম গ্রুপের সাইরাসপুণাওয়ালা পার্শী মালিকানাধীন ৷ গান্ধীজী হিন্দু ছিলেন কিন্তু ইন্দিরা গান্ধীর স্বামী ফিরোজ গান্ধী পার্সি ৷গান্ধীজীর গুরু দাদাভাই নৌরজী , বিশিষ্ট ব্যারিষ্টার ননী পাল্কিওয়ালা , ভারতের পরমাণু বিজ্ঞানের জনক হোমি জাহাঙ্গীর ভাবা সহ অসংখ্য বিশিষ্ট পার্সি ভারতবর্ষের অহংকার ৷ পাকিস্তানের কায়দে আজম বা জাতির জনক জিন্নার একমাত্র সন্তান  বা মেয়ে পার্শিকে বিয়ে করে অনেক সুযোগ পেয়েও পাকিস্তানে না গিয়ে সারাজীবন মুম্বাইয়ে অর্থাৎ ভারতে থেকে যান ৷যখন সাংবাদিকতা করতাম কলকাতার তালতলার কাছে এক পার্শী পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল ৷এই অনুষ্ঠানে বনফায়ার" করে বাচ্চারা আগুনের উপর লাফিয়ে যায় ৷ "চাহার সানবে সুরি" বা বাজি পোড়ায় ৷দেখে মনে হয় এভাবে আমরা ছোটবেলায় দোলের আগের দিন "নেড়াপোড়া" করতাম ৷তাঁদের নববর্ষ ফারবারদিন বা নওরোজে খেয়েছিলাম ৷এদের"সামানু" ( গম দিয়ে তৈরী পুডিং), মশলা মাখানো কাবাব , "বাফেলা ইদা নি আকুরি" নামের সিদ্ধ ডিমের পদ ,  ঘন দুধ "শীর" , শেহেদ(মধু) , শিরিনি( সিমাইয়ের মিষ্টি)  আজও মুখে লেগে আছে ৷এখনও কলকাতা গেলে নিউমার্কেটে "মানছোড়জি" পার্শি রেস্তোঁরায় খেতে ঢুঁ মারি ৷এই অনুষ্ঠানে কাঁচের ফিশবোলে দুটি গোল্ড ফিশ রাখা হয় ৷ ডিম এঁদের কাছে নবজীবনের প্রতীক শুভ ও পবিত্র ৷ এঁদের বিশ্বাস কোন ব্যক্তির চারপাশে সাত বার ডিম ঘোরালে অশুভ শক্তি পালিয়ে যায় ৷ কলকাতায় ছিল পার্শি ক্রিকেট ক্লাব , টেনিস ক্লাব ও ধর্মশালা ৷ বেলেঘাটায় পার্শী মৃতদেহ সৎকারের দখমা (১৮২৮ সালের ২৮ জানুয়ারি এই টাওয়ার অফ সাইলেন্সটি উদ্বোধন হয়েছিল) ৷এখন টাওয়ারে চিল শকুন না আসায় সৌরচুল্লি বসেছে ৷কলকাতায় গিয়েছি এজরা স্ট্রীটের পার্শি উপাসনায় "আগিয়ারা " র ৷রুস্তমজি কাওয়াসজি বানাজি একসময় ছিলেন কলকাতা বন্দর ও সাতাশটি জাহাজের মালিক ৷আজ কলকাতায় চারশো পার্সির বাস ৷এখনও তাঁদের অনেক অবদান রয়েছে ৷

॰॰॰॰॰॰॰ ডাঃদীপালোক বন্দ্যোপাধ্যায় ৷
৯৭৩২২১৭৪৮৯

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.