কংগ্রেসের ন্যায় প্রকল্প নিতান্তই দুর্বোধ্য ও সম্পূর্ণ অবাস্তব

বেশ অনেক দিন পর আবার একটা পাশা পাল্টে দেওয়া চাল পাওয়া গেল কংগ্রেসের কাছ থেকে। এর নাম সকলেই জানেন NYAY (ন্যূনতম আয় যোজনা) Minimum Wage Scheme। উদ্দেশ্য দেশের ৫ কোটি গরিব পরিবারকে বছরে ৭২ হাজার টাকা করে দান দেওয়া। বরাবর অর্থাৎ আজীবন। কংগ্রেসের সভাপতি প্রকল্পটি ঘোষণা করা মাত্রই বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের হেডলাইন হয়ে যায়। অবশ্যই তাৎক্ষণিকভাবে এই ঘোষণা কংগ্রেস দলকে রাজনৈতিক অস্ত্র সরবরাহে সহায়ক হবে। একটা ব্যাপার পরিষ্কার এই প্রকল্পটি নিয়ে যে ধরনের সাড়া পড়ে গেছে তাতে করে মনে হয় কেন্দ্রে যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক না কেন এই ধরনের কোনও একটা প্রকল্প রূপায়ণের চেষ্টা হবে। মাত্র কয়েক মাস আগেই মোদী সরকার একই ভাবে বছরে ৬ হাজার টাকা চাষিকে প্রয়োজনীয় কৃষি উপকরণ সংগ্রহের জন্য ইতিমধ্যেই দেওয়া শুরু করেছে। কিন্তু আপাতভাবে ৬ হাজার আর ৭২ হাজারের বড়ো ফারাক তো সকলেই বুঝবেন। আমরা এর অর্থনৈতিক টানাপোড়েন নিয়ে একটু পরেই আলোচনা করব।
‘ন্যায়’ প্রকল্পের টাকা কোথা থেকে জোগাড় হবে সে বিষয়টা ভাবার আগে আমরা এর নৈতিক অবস্থানটা দেখব। এর ভালো খারাপ দুটোই আছে। ভারতে নিশ্চিতভাবেই বেশ বড়ো সংখ্যায় বিশ্বের দরিদ্রতম মানুষ বাস করে। তাদের পকেটে টাকা পয়সা কিছু না থাকায় তারা দারিদ্র্যের জাল কেটে বেরোবার কোনও রাস্তাই খুঁজে পায় না। এই টাকাটা মাসে মাসে হাতে পেলে তারা কিছুটা ভাবতে পারবে যে ভালো খাবার না ভালো বাসস্থান না সন্তানের শিক্ষা জীবনযাত্রার কোন বিষয়ে তারা অগ্রাধিকার দেবে। সরকার কখন তার জীবনযাত্রায় পরিবর্তন ঘটাবে তার জন্য অনিশ্চিত অপেক্ষায় না থেকে হাতে কিছু নগদ থাকলে নিজেই কিছু না কিছু করার আংশিক স্বাধীনতা অন্তত পাওয়া যেতে পারে। দেশ ব্যাপী আলোড়ন তোলা প্রতিযোগিতামূলক ‘ঋণ মকুব প্রক্রিয়াতে’ যদি এর মাধ্যমে ইতি টানা যায় তাহলে ঋণমুকুবের হিড়িক যেভাবে দেশের ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা, ঋণদানের সংস্কৃতিকে সরাসরি ধ্বংস করে দিচ্ছে তা একটা নৈতিকভাবে ইতিবাচক দিকের সন্ধান দিতে পারে।
অন্যদিকে দুটি নৈতিক বন্ধু কিন্তু ঘোরতরভাবে ন্যায়ের বিপক্ষে যাচ্ছে। সরকার দেশের করদাতাদের একটা বিরাট আকারের টাকা চিরকালীন ভরতুকি খাতে খরচা করার বন্দোবস্ত করছে সে বিষয়ে করদাতাদের সম্মতি আছে কিনা। দ্বিতীয়ত, মুফতে পয়সা হাতিয়ে নেওয়া সমাজে কর্মসংস্কৃতিকে নষ্ট করার সঙ্গে সঙ্গে এক ধরনের অন্যায্য অধিকারবোধের জন্ম দেবে যা সরাসরি দেশের শ্রমজীবীদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। ভারতের শ্রমিকদের উৎপাদনশীলতা ইতিমধ্যেই কম, ‘ন্যায়’ তার অপূরণীয় ক্ষতি করবে।
যাই হোক, নীতিগতভাবে ‘ন্যায়ের ভালোমন্দ দুটো দিক পর্যালোচনার পর মনে হতেই পারে ভারতের মতো দরিদ্রতম দেশে ‘ন্যায়’কিছুটা উপকার হয়তো করতে পারে। কিন্তু আসল বিষয়টি হলো এর অঙ্গীভূত অর্থনীতি ও বাস্তবে প্রকল্পটি কীভাবে রূপায়িত হবে সেই মহা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি।
প্রথম, দেশ হিসেবে আমাদের কি এর রূপায়ণ ক্ষমতা আছে ? অর্থনীতির মহা পণ্ডিত না হয়েও বলা যায় যে, দেশের ৫ কোটি পরিবারকে বছরে ৭২ হাজার টাকা করে দিলে ৩.৬ (তিন লক্ষ ষাট হাজার) কোটি টাকা লাগবে। কেন্দ্রীয় সরকারের সামগ্রিক বাজেটের পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করলে এ এক বিশাল অঙ্কের টাকা। সরকারের সামগ্রিক কর বাবদ আদায় হয় ১৮ লক্ষ কোটি টাকা, এর এক পঞ্চমাংশ। কেবলমাত্র এই প্রকল্প হজম করে নিতে পারে। আজকের তারিখ অবধিও সরকার। যে পরিমাণ আয় করে তার খরচ তার চেয়ে বেশি।মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো এই বাড়তি গগনচুম্বী খরচ দেশের সমগ্র বাজেট প্রস্তাবকে হাওয়ায় উড়িয়ে দিতে পারে। সাধারণের দৃষ্টিতে বিষয়টা এরকম দাঁড়ায়। ধরা যাক একজন লোক ১৮ হাজার টাকা। আয় করে, তার মাসিক খরচ ২০ হাজার টাকা। ২ হাজার টাকার ঘাটতি ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে চালায় যা কয়েকমাসে যে পর্যায়ক্রমে শোধ করতে থাকে। কালকে এই লোকটিকে বলা হলো তোমার খরচ আগামী মাস থেকে ২৪ হাজার টাকা হয়ে যাবে। আয় তো একই থাকবে। হঠাৎ আয়-ব্যয়ের হিসেবে নাটকীয়ভাবে বড়ো ধরনের ফারাক তৈরি হয়ে গেল যা দীর্ঘস্থায়ী হবে। এর মানে দাঁড়ালো ক্রেডিট কার্ডে খরচ চালানোর বিল যা ইতিমধ্যেই বেড়ে চলেছিল তা আরও বেড়ে গেল। ব্যক্তির ক্ষেত্রের উদাহরণ দেওয়া হলো। সরকারের কাছে বাজেটের নিরিখে আয়ের চেয়ে বেশি খরচা মানেই বাজার থেকে ধার করা। ধার বাড়ানোর অর্থই হচ্ছে চলতি সুদের হারও বেড়ে যাওয়া। টাকা পেতে যদি বেশি সুদ গুনতে হয়ে বেসরকারি পুঁজি বিনিয়োগ ধাক্কা খাবে। যেহেতু বাজারে বাড়তি টাকা জোগান দিতে হবে (কেননা সরকারের অর্জিত আয় আগেই খরচ হয়ে গেছে) টাকা ছাপিয়ে (Deficit financing) ভারসাম্য তৈরি করতে হবে। যার ভয়ঙ্কর পরিণতি মুদ্রাস্ফীতি। হ্যাঁ ভাই, জীবনে কোনো কিছুই ফোকটে আসে না। নগদ টাকা তো নয়ই।
অবশ্যই আমরা রাজস্ব আদায়ে বৃদ্ধি ঘটিয়ে ঘাটতিকে বাগে আনতে পারি। কীভাবে করবে সরকার ? কতই না পরিচিত সহজ রাস্তা রয়েছে– (১) সরকার দুম। ধাড়াক্কা আয়করের হার বাড়িয়ে দিতে পারে বা দেশের cess-দগ্ধ জনতা অচিরেই NYAY Cess দেওয়ার জন্য রেডি হয়ে যেতে পারে। কর্পোরেট সেক্টর যে কোনও সময় কর বৃদ্ধির বলির পাঁঠা হয়ে যেতে পারে। এর পরিণতিতে ভারতের পণ্য বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারবে না। বাড়তি কর দিলে উৎপাদিত পণ্যের দামও বাড়াতে হবে। নইলে তার বাজেট ধসে যাবে।
কিছু ক্ষেত্রে এখনই চালু জিএসটি-রহার চড়া আছে তা নিয়ে কতই না বুক ফাটাফাটি হচ্ছে, কিন্তু এর ওপর বাড়তি ন্যায় দেন সে তো ব্যবসায়ীকে নোনা মুখে মেনে নিতেই হবে। এর সঙ্গে আরও বহু ক্ষেত্র থেকে দুম করে কর আদায় শুরু হয়ে যেতে পারে। শুধু তাই নয় সরকারি খরচ বাঁচাতে অত্যাবশ্যক ও দেশের পক্ষে দীর্ঘকালীন পরিকাঠামো উন্নয়ন খাতে কাটছাঁট শুরু হতে পারে।
রাস্তা কম তৈরি হবে, স্বাস্থ্যখাতে খরচ হেঁটে দেওয়া হবে। শিক্ষা খাতে খরচ কমিয়ে দেওয়া তো হাতের পাঁচ। এর থেকে টাকা নিয়ে ‘ন্যায়’ বাঁচাতে হবে।
হ্যাঁ, আবার বলছি, যতই খারাপ লাগুক না কেন দুনিয়ায় বিনামূল্যে কিছু পাওয়া যায় না, কিছু না। আর এত বিশাল অঙ্কের টাকা তো ভাবাই যায় না। চিন্তার কিছু নেই ভারতের তো অতীতের কলঙ্কিত অভিজ্ঞতা আছেই। যত বেশি কর চাপবে তত বেশি কর ফঁকি বাড়বে। বলতে কোনও বাধা নেই গত পাঁচ বছরে এই ফাকিবাজরা কিছু একটি গ্রহণযোগ্য ভারসাম্য রক্ষাকারী কর জমানায়। এই প্রবণতা থেকে সরে এসেছেন।
MGNREGA বা ছোটো করে ‘মনরেগা’ প্রকল্পই এ পর্যন্ত ভারতে ঘোষিত সর্বাধিক ৫০ হাজার কোটি টাকার ফি বছরে খরচের প্রকল্প। প্রস্তাবিত ন্যায়ের বহর হবে এর ৭ গুণ বেশি। তাহলে কি দেশ এই খরচ বইতে পারবে? হ্যা, মারপ্যাচ করে কাগজে কলমে হয়তো হিসেব মেলানো যাবে কিন্তু এর ফলশ্রুতি দেশের অর্থনীতিকে বহুমুখী আঘাত করবে। অর্থনৈতিক বৃদ্ধি হ্রাস পাবে, বাড়বেমুদ্রাস্ফীতি, দেশের বিনিয়োগে ভাটা পড়বে, আয়কর চাপানো হবে বর্ধিত হারে। আর হ্যা, চাকরি ও চাকরির আশা কমে যাবে ভয়ংকর ভাবে।
সবচেয়ে বেশি যেটা মাথায় রাখতে হবে তা হলো বাস্তবে এর সঠিক প্রয়োগযোগ্যতা। নির্দিষ্ট সীমার আয়ের মানুষের মধ্যে আয়করের রিটার্ন দাখিল করার ফলে বিশেষ করে চাকুরি ও সুদ আয়কারীদের ক্ষেত্রে টিডিএস বা উৎসমূলে কর কাটার সূত্রে সরকার দেশের মানুষের রোজগার সম্পর্কে জানতে পারে। ন্যায়’ প্রকল্পে আয়ের যে মানদণ্ড ধরা হয়েছে অর্থাৎ ১২ হাজার টাকা, সে ক্ষেত্রে যে Auto driver ১৭ হাজার টাকা আয় করে সে গিয়ে অনায়াসে আয় ১২ হাজার টাকার নীচে দেখাবে না তো কী করবে? মুফতে ভরতুকি পেতে হলে এটাই তো রাস্তা। যে আধিকারিক তাকে এই জাল সার্টিফিকেট দেবে যার ফলে ৭২ হাজার তার খাতায় যাবে সে কি করবে মনে হয়? তাকে তো হাত গরম করতেই হবে। চমৎকার!
একজন ভারতীয় হিসেবে আপনি সহজেই ভাবতে পারছেন যে প্রতিষ্ঠান ও সার্বিক প্রশাসনিক কাঠামোর কতটা অপব্যবহার শুরু হবে এই ধরনের যোগ্যতা সার্টিফিকেট দিতে। সত্যিই বলছি এর কোনও সদুত্তর আমাদের জানা নেই যার মাধ্যমে এই প্রতারণাকে আটকানো যেতে পারে।
যে কোনও প্রকল্প যদি গরিবের উপকারে লাগে তাতে আপত্তির কী থাকতে পারে? কিন্তু ন্যায়ের মতো এত বিপুল একটা প্রকল্পে এটা দেখা জরুরি যে এই দান দিতে গিয়ে আমাদের কী কী হারাতে হবে। আর আদৌ তা বাস্তবায়িত করা সম্ভব কিনা! যেখানে সব হিসেবেই জন্মসূত্রে কারচুপির সম্ভাবনা সুপ্ত রয়েছে।
চেতন ভগত
(লেখক প্রখ্যাত সাহিত্যিক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.