
হাড় হিম করা মাঘের শীতেই জ্বরটা বাঁধিয়েছিলেন সুকুমার রায় (Sukumar Ray)। কালাজ্বর। ১৯২১ সালে সেই যে অসুস্থ হলেন, ১৯২৩ সাল পর্যন্ত তার যন্ত্রণা ভোগ করেছিলেন। দু’বছরব্যাপী যন্ত্রণার ভিতর তিনি যা যা লিখে গিয়েছিলেন, প্রায় সবই এমন হাস্যকর যে স্রেফ্ হেসে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। সুকুমার রায় ব্যক্তিটি কি নেহাৎই ‘ননসেন্স’ ছিলেন, না হলে মৃত্যুর প্রহর গুনতে গুনতে কেনই বা খামোখা একের পর এক পরাবাস্তব কৌতুক কাহিনি রচনা করতে যাবেন! এ শুধু পরাবাস্তবই নয়, স্যাটায়ারেরও ঊর্দ্ধে।
‘জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে উপস্থিত হয়ে এমন রসিকতা আর কোনও রসস্রষ্টার পক্ষে পম্ভব হয়েছে বলে আমার জানা নেই।’ এ-কথা সত্যজিৎ লিখেছিলেন ১৯৭৩ সালে সুকুমার রচনাবলীর (আনন্দ) ভূমিকায়।
১৯২১-এ কালাজ্বরে আক্রান্ত হওয়ার পর ওই বছরই মে মাসের শেষ দিকে দার্জিলিঙে লুইস জুবিলি স্যানিটোরিয়ামে ছিলেন কিছু দিন, চিকিৎসার্থে। তার কিছু দিন আগেই, ২ মে তাঁর ‘খোকা’র জন্ম হয়েছে। আর দু’বছরব্যাপী যন্ত্রণার ভিতর তিনি জন্ম দিয়েছিলেন, আবোল তাবোল, হেঁয়ালি নাট্য, রাজার অসুখ, খোকার ভাবনা, লড়াইবাজ জানোয়ার, মানুষমুখো, বুমেরাং, হেশোরাম হুঁশিয়ারের ডায়রি, আকাশবাণীর কল, Notes on system in Half-tone Operating (অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি) আরও কত গল্প, নাটক, কবিতা, ছড়া, প্রবন্ধ। ১৯২২ সালের ৮ জানুয়ারি গিরিডির ‘হোম ভিলা’ থেকে শিশিরকুমার দত্তের স্ত্রীকে পাঠানো একটি কবিতা থেকে জানা যায় তখন তিনি সেখানে। সম্ভবত এই সময়েই তিনি লিখেছিলেন ‘হ য ব র ল’ (Hojoborolo) গল্পটি, যার বয়স এ বছর ১০০ ছুঁলো।
‘জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে উপস্থিত হয়ে এমন রসিকতা আর কোনও রসস্রষ্টার পক্ষে পম্ভব হয়েছে বলে আমার জানা নেই।’ এ-কথা সত্যজিৎ (Satyajit Ray) লিখেছিলেন ১৯৭৩ সালে সুকুমার রচনাবলীর (আনন্দ) ভূমিকায়। ‘অসম্ভবের ছন্দ’ প্রবন্ধে শঙ্খ ঘোষ লেখেন— “ছোটদের জন্য লেখা তাই খুব শক্ত কাজ। লেখক যদি মনে করেন চলতি সমাজের মূল্যগুলিকে ভাঙতে চান তিনি, ছোটোদের মন থেকে সরিয়ে দিতে চান ভুল সংস্কারগুলিকে, আর এইভাবে তার সামনে সাজিয়ে দিতে চান জীবনযাপনের একটা স্বাস্থ্যময় ছবি, তাহলে কীভাবে সেটা করবেন তিনি?… তাই অনেক সময়ে তাঁকে খুঁজে নিতে হয় হাসির চাল, খেয়ালখুশির হালকা হাওয়ায় তিনি করতে পারেন সেই কাজ…” ঠিক এই কারণেই সুকুমারের লেখা বিশেষ ভাবে সাবালকপাঠ্য বলে মনে করতেন বুদ্ধদেব বসু। ছন্দমিল, চরিত্রসৃষ্টি, কবিকল্পনায় তিনি সাবালক। এবং অবশ্যই ‘সিরিয়াস’ ভঙ্গি করা বহু সাহিত্যিকের চেয়ে তাঁর কলম অনেক বেশি সাবালক। কথাটা চমৎকার ভাবে বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ— “তাঁর স্বভাবের মধ্যে বৈজ্ঞানিক সংস্কৃতির গাম্ভীর্য ছিল।”
‘হ য ব র ল’-এ শ্রীকাক্কেশ্বর কুচচকুচের বিজ্ঞাপন
‘হ য ব র ল’, ‘হেশোরাম হুঁশিয়ারের ডায়েরী’, ‘আবোল তাবোল’-এর লেখাগুলি জীবনের শেষ পর্যায়েই তৈরি, অথচ গভীর অন্তর্দৃষ্টির ছাপ, পরিণত শিল্পীর ছোঁয়া যেন সমস্তটুকু নিংড়ে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। হ য ব র ল প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ‘সন্দেশ’-এ, সন্দীপ রায় ও অন্যান্য গুণীজনের তত্ত্বাবধানে যা এখনও প্রকাশিত হয়। “সন্দীপবাবু অন্য একটি কাজে ব্যস্ত থাকায় এই মূহুর্তে সেমিনার বা অন্যান্য অনুষ্ঠান-আলোচনার আয়োজন করা যাচ্ছে না। তবে, হ য ব র ল-এর শতবর্ষ উপলক্ষে বিশেষ পরিকল্পনা অবশ্যই রয়েছে। এ বিষয়ে একটি বইয়ের কাজও চলছে।” জানিয়েছেন সন্দেশ-এর সম্পাদকমণ্ডলীর সৌম্যকান্তি দত্ত।
‘পাগলা দাশু’, ‘হ য ব র ল’, ‘দ্রিঘাংচু’ প্রভৃতির স্রষ্টা বইয়ের পাঠ বা শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই-ক্ষ্যাপার মতো একটি চরিত্র। হতাশার বিষয় হলো স্কুল-শাসন ও ন্যায়-আইন ইত্যাদির বিরুদ্ধে যাঁর বিকল্প ভাষা দিনের পর দিন হেসে উড়িয়ে দেওয়াতেই সার্থকতা পেয়েছে।

সুকুমার পরিকল্পিত প্রচ্ছদ

চোখের ব্যারামে নাজেহাল পেঁচা বিচারক
অসুস্থতার পর্বেই সুকুমার উদ্যোগী হয়েছিলেন আবোল-তাবোল ও হ য ব র ল গ্রন্থদুটি প্রকাশের জন্য। ১৯২৩-এর ১০ সেপ্টেম্বর, যেদিন কলকাতা ভূমিকম্পে কেঁপেছিল, সুকুমার চলে যান। তার ন-দিন পরে ১৯ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত হয় আবোল তাবল। ‘অতীতের কথা’ নামে একটি বইয়ের কথা বাদ দিলে, সুকুমার তাঁর কোনও বইয়েরই প্রকাশ দেখে যায়নি। কিন্তু, হ য ব র ল-এর মুদ্রণ-পরিকল্পনা করেছিলেন। সন্দেশ-এর পর যখন সিগনেট সংস্করণে প্রকাশিত হয়, সেটি শুধু আকারে বদলায়, তার ফরম্যাট পাল্টানো হয়নি। পেঁচা বিচারক ঘুমিয়ে পড়েও চোখের ব্যারামের জন্য ‘বেনিফিট অফ ডাউট’ লাভ করেন, হ য ব র ল-এর জন্য এই প্রচ্ছদ পরিকল্পনাটিও চিরবিদায় জানানোর আগেই করে গিয়েছিলেন। মৃত্যুর ভিতর দিয়ে জীবনের এমন অর্থ আর কে খুঁজেছে!

ব্যাকরণ শিং
‘পাগলা দাশু’, ‘হ য ব র ল’, ‘দ্রিঘাংচু’ প্রভৃতির স্রষ্টা বইয়ের পাঠ বা শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই-ক্ষ্যাপার মতো একটি চরিত্র। হতাশার বিষয় হলো স্কুল-শাসন ও ন্যায়-আইন ইত্যাদির বিরুদ্ধে যাঁর বিকল্প ভাষা দিনের পর দিন হেসে উড়িয়ে দেওয়াতেই সার্থকতা পেয়েছে। “একজনের মাথার ব্যারাম ছিল, সে সব জিনিসের নামকরণ করত। তার জুতোর নাম ছিল অবিমৃষ্যকারিতা, তার ছাতার নাম ছিল প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব, তার গাড়ুর নাম ছিল পরমকল্যাণবরেষু— কিন্তু যেই তার বাড়ির নাম দিয়েছে কিংকর্তব্যবিমূঢ়, অমনি ভূমিকম্প হয়ে বাড়িটাড়ি সব পড়ে গিয়েছে।” হ য ব র ল-তে লিখেছিলেন সুকুমার। ইহাকে ত্রিকালদর্শীতা বলা যেতে পারে এবং চন্দ্রবিন্দু, শ্রীকাকেশ্বর কুচকুচে, উদো আর বুদো, হিজিবিজবিজ, ব্যাকরণ শিং, বি.এ. খাদ্যবিশারদ, ন্যাড়া হ য ব র ল-এর চরিত্রগুলি নিয়মের বাইরে বেরিয়ে যাচাই করলে দেখবেন কোনটিই কাল্পনিক নয়, এমনকি ১০০ বছর আগের নয়, সমসাময়িক। অতএব, বোধ প্রয়োগ করলেই বোঝা যাবে সুকুমার রায় ব্যক্তিটি ‘ননসেন্স’ শব্দটির বিকল্প মানে তৈরি করেছিলেন। যেকারণে কবীর সুমন তাঁর গান ‘সুকুমার রায়’-এ বারবার বলে যান, “আমাকে ভাবায় সুকুমার রায় / আমাকে ভাবায় সুকুমার রায়।”
তথ্যসূত্রঃ
প্রবন্ধ সংগ্রহ, সিদ্ধার্থ ঘোষ
হ য ব র ল, সুকুমার রায়