‘কালীপদ নিকেতন’ ও বাঘাযতীনের স্মৃতি

১৯১০ সালের ৪ঠা এপ্রিল। আলিপুর সেন্ট্রাল জেল থেকে দিদি বিনোদবালা দেবীকে একটি চিঠি লেখেন যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। চিঠির শেষে লিখেছিলেন, “ইন্দুকে ও অপর সকলকে এই পত্রই দেখাইবেন।“ আবার, ১৯১৫ সালের মে মাসে বালেশ্বরের  অজ্ঞাতবাস থেকে এক চিঠিতে দিদি বিনোদবালাকে যতীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “আপনি অনুগ্রহ করিয়া মন শান্ত করিয়া সসন্তান ইন্দুকে রক্ষা করিবেন। সন্তানগুলি যাহাতে মানুষ হয় তাহার চেষ্টার যেন কোন ত্রুটি না হয়।“

কখনও আত্মগোপনে, কখনও বন্দিদশা থেকে লেখা বিভিন্ন চিঠিতে স্ত্রী ইন্দু-র কথা এভাবেই স্মরণ করেছেন বাঘাযতীন। তিনটি ছোট্ট সন্তানকে ইন্দুর কাছে সমর্পন করে বিপ্লবের যজ্ঞে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন যতীন। তার পর পায়ে পায়ে বুড়ি বালামের তীরে সেই ঐতিহাসিক খণ্ডযুদ্ধ। ১৯১৫-র ৯ সেপ্টেম্বর সূর্যাস্তের সংগে অবসান হল এই যুদ্ধের। পরদিন বালেশ্বর সরকারি হাসপাতালে যতীন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। তখনো রক্তবমি হচ্ছে। হেসে বললেন: “এত রক্ত ছিল শরীরে? ভাগ্যক্রমে, প্রতিটি বিন্দু অর্পণ করে গেলাম দেশমাতার চরণে।”

শহরের ঐতিহ্যসফরে বেড়িয়ে ১১, মহেন্দ্র গোস্বামী লেনে অঙ্কের জাদুকর প্রয়াত কেপি বসু-র বাড়িতে গিয়েছিলাম। তাঁর নাতি জয়ন্ত বসুর মুখে শোনা কাহিনী আপনাদের জানিয়েছি। ঠাকুর্দার কথা জানাতে গিয়ে জয়ন্তবাবু এই প্রতিবেদককে বিস্তর প্রশংসা করলেন ঠাকুমা মেঘমালার। বাঘাযতীনের আত্মবলিদানের পর এই মেঘমালার আঁচলের আড়ালে ‘কালীপদ নিকেতন’-এ তিন শিশুসন্তানকে নিয়ে নাকি আশ্রয় পেয়েছিলেন ইন্দু। ইন্দু-যতীনের বড় ছেলে তেজেন্দ্রনাথের বয়স তখন প্রায় ৯, বীরেন্দ্রনাথের বছর ৬। মেয়ে তো আরও ছোট।

৮৭ বছরের জয়ন্তবাবু বললেন, এই ঘরেই বাচ্চাদের নিয়ে থাকত ইন্দু। পরম মমতায় নিজের মত করে মেঘমালা ওদের দেখত। বিস্মৃতির ধারাপাতে হারিয়ে যেতে বসেছে এ সব গল্প। কিন্তু ইতিহাস তো হারায় না! বাঘাযতীনের নাতি, বীরেন্দ্রনাথের পুত্র বালিগঞ্জ প্লেসের বাসিন্দা ইন্দুজ্যোতি মুখোপাধ্যায় আজও ভোলেননি তাঁর ঠাকুমা চরম বিপদের দিনে কীভাবে ছোট্ট তিনটি বাচ্চাকে নিয়ে ‘কালীপদ নিকেতন’ ও আরও কিছু বাড়িতে আশ্রয় পেয়েছিলেন।

ইন্দুজ্যোতিবাবু এই প্রতিবেদককে বললেন, “বাঘাযতীনের মৃত্যুর সময়কাল ছিল অত্যন্ত উত্তাল। বাবা-জ্যাঠা-পিসি তখন খুবই ছোট। ওদের নিয়ে ঠাকুমার এক ঠিকানায় বেশিদিন থিতু হওয়ার উপায় ছিল না। পরে তেজেন্দ্রনাথ চলে গিয়েছিলেন পন্ডীচেরিতে, অরবিন্দ আশ্রমে। তাঁর তিন পুত্র, মানে বাঘাযতীনের তিন নাতিও থাকতেন সেখানে। ফ্রান্স যখন পন্ডীচেরি ছেড়ে চলে যায়, ওঁরা তিনজন চলে গিয়েছিলেন প্যারিসে। স্থায়ীভাবে থেকে যান সেখানে।

বাঘাযতীনের স্মৃতি নিয়ে আলোচনায় বিভিন্ন সময়ে ভারত-বাংলাদেশের উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে ডাক পেয়েছেন ইন্দুজ্যোতিবাবু। আলোচনায় জয়ন্ত ঘোষ জানিয়েছিলেন, কেন ওই নাম জানেন? ঠাকুমা ইন্দুবালা আর ঠাকুর্দা যতীন— দুয়ে মিলে ইন্দুজ্যোতি।

কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন,
“বাঙালীর রণ দেখে যারে তোরা 
রাজপুত, শিখ, মারাঠীজাত,
বালাশোর, বুড়ি-বালামের তীর
নবভারতের হলদিঘাট…’’।
বুড়ি-বালামের তীরের সেই অমর শহিদের স্মৃতি ‘কালীপদ নিকেতন’-এর দ্বিতলের কক্ষে থেকে গিয়েছে, তা জানা ছিলনা। আমাদের ঐতিহ্যসফরের শুরুতে পথপ্রদর্শক কলকাতা বিশারদ হরিপদ ভৌমিক হরেক কথার মধ্যে বলেছিলেন, “এই অঞ্চলের প্রায় প্রতিটি বাড়িতে লুকিয়ে আছে ইতিহাস।“ ঘরের অন্দর থেকে সেসবের হদিশ যেন হঠাৎ আলোর ঝলকানির মত খুলে দেয় আপাত অজানা নানা দিক।

অশোক সেনগুপ্ত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.