তৃতীয় পর্ব
কানটার পিছে কে ঘুরে?
রাজার কোটাল।
কিসের জন্যে?
এক ছড়ি কলার জন্যে।
কাল যে নিয়া গেছিলা?
ঘোড়ায় মুতে দিয়াছে।
ধুয়ে ধুয়ে খাও নি?
ছি! ওয়াক! থু!!
তবে এক ছড়ি নিয়া যাও।
রাজার কোটাল কমবয়সী ছেলেমেয়েদের দলবদ্ধ খেলা। এতে একজন হয় মোড়ল আর অন্য একজন হয় কোটাল। মোড়ল ও অন্য খেলোয়াড়দেরা নিয়ে গোল হয়ে বসে একের পর এক বুড়ো আঙুল মুঠ করে ধরে। কোটাল তখন তাদের চারদিকে ঘুরতে থাকে। পরে মোড়ল ও কোটালের মধ্যে ছড়া কাটা হয় এবং যার মধ্যে প্রথমোক্ত ছড়াটিও কাটা হয়।

পরে কোটাল কলার কাঁদি কাটার অভিনয় করে একজন খেলোয়াড়কে নিয়ে যায় এবং পুনরায় ঘুরতে থাকে; এ সময় আবার পূর্বের ন্যায় ছড়া কাটা হয়। এভাবে কোটাল সব খেলোয়াড়কে নিয়ে গেলে প্রথম রাউন্ডের খেলা শেষ হয়। এভাবে যতক্ষণ খুশি এ খেলা চলতে থাকে। কোথাও কোথাও এই খেলাটি কাঁঠাল কাঁঠাল নামেও খেলা হয়। তখন কোটাল মোড়লের কাছে একইভাবে কাঁঠাল চাইতে থাকে।
হ্যাঁ , পূর্ব পর্বে উক্ত শ্রীমদ্ভাগবতের নায়ক নির্ণয় করে খেলার কথা বলেছিলাম। উপরি উক্ত খেলার সঙ্গে সেই খেলারও বেশ কিছু মিল প্রাপ্ত হয়। এরম আরো একটি খেলা খুব প্রচলিত ছিল। তার নাম #সিন্দুর_টোপ । ঠাকুমা , দিদিমাদের নিকট শুনেছি তাঁরা বাল্যকালে প্রায়ই এই খেলা খেলতেন। এই খেলায় কিছুদূর সমান ব্যবধানে দুই পক্ষের দুইটি #কোট নিৰ্মাণ করা হতো। প্রতিযোগী বা খেলোয়াড়র দুই দল লাফ দিয়ে পরস্পরের কোট দখলের চেষ্টা করত। অগ্রাধিকারীই জয়লাভ করত। তবে কিনা এই খেলায় লাফ দেবার অধিকারও অর্জন করতে হতো। সকল বালক বালিকারা একত্রে মিলে প্রথমে দুজন নায়ক নির্বাচন করত। পরে সমান সমান বয়স বা বলশালী দুইটি বালক বা বালিকা আপন আপন হস্তে দুইটি জিনিস নিয়ে জিনিসের নামানুসারে ” কে নিবিরে খোলাম কুচি /কে নিবিরে ঘাস ” – এই বলে চিৎকার করতে করতে হাত ধরাধরি করে আসত। তখন ওই পূর্ব নির্বাচিত নায়ক বা দলপতি ” আয়রে ঘাস ” ” আয়রে খোলামকুচি ” বলে ডেকে নিত। এবারে যে আগে ডেকেছিল , পরে তাকে শেষে ডাকতে হবে। এই রূপে দল নির্বাচন সমাপ্ত হলে , দল সহ সভাপতি আপন আপন কোটে গিয়ে বসত। অতঃপর এক দলের দলপতি গিয়ে অপর দলের চোখ চেপে ধরত। পরে – ইঙ্গিতে নিজের দলের একজনকে ডাকত। সে পা টিপে টিপে গিয়ে ওই চোখ ঢাকা বালক বা বালিকার কপালে টোকা মেরে আসত। টোকা দিয়ে সে তার সস্থানে গিয়ে বসে স্বচ্ছন্দ হলে , দলপতি ওই বালকের চোখ খুলে দিয়ে জিজ্ঞাসা করত , ” কে টোকা দিলে ?” যদি সঠিক নাম বলতে পারত ,তবে এক লাফ দিয়ে নিজের কোট হতে প্রতিদ্বন্দ্বীর কোটের দিকে অগ্রসর হতো। যদি দলের কোনো খেলোয়াড় লাফ দিতে অক্ষম হত তাহলে দলপতি গিয়ে লাফ দিত। এভাবে পর্যায়ে ক্রমে চোখ বাঁধা ও নাম জিজ্ঞাসা এবং লাফ দেওয়া চলত। এমন করেই একজনের কোট ওপরে দখল করত।

প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি , বালক বালিকাদের কপালে কে টোকা মেরেছে তার নাম জানানোর জন্য দলের মধ্যে একটি সংকেত কখনো কখনো ব্যবহার করা হতো। মানে এক একজনের নামের এক এক সংকেত। ওই সংকেত বা কোড ধরে বুঝে নিতে হতো টোকা মারা ব্যক্তির নাম। যেমন – ” গোপলাকুন্ড শুকালো” বললে বুঝতে হতো রাম টোকা মেরেছে। ” পাঁকুড় গাছটা ভেঙে পড়ল ” অর্থাৎ শ্যাম টোকা মেরেছে ইত্যাদি।
ঠিক এমনই টোকা দিতে ডাকবার ইশারায় অনেক সময় কাজ হতো না। একজনকে উঠতে বললে অপর জন উঠে দাঁড়াত, ফলে গোলমাল হতো। তাই , তারও একটি সংকেত থাকে। যেমন – ” আয়রে বেগুন ফুল “বললে যদু আসত , “আয়রে ঝুমকো লতা “বললে মধু এসে টোকা দিত ইত্যাদি।

এই খেলা কোথাও গোলাপ টগর বা টুক্কা টুক্কি খেলা নামেও সুপরিচিত ছিল। এই খেলা দেশের প্রায় সব জায়গাতেই কম বেশি প্রচলিত ছিল একসময়। তাই অঞ্চলভেদে নামের বিভিন্নতাও লক্ষ্য করা যেত। বঙ্গে কোথাও কোথাও এ খেলা বউরানী, আবার কোথাও চড়নখেলা নামেও পরিচিত ছিল।
এই খেলাটি প্রণালীবদ্ধভাবে চালাতে পারলে, একদিকে বালক বালিকারা যেমন দলপতি নির্বাচন , দলগঠন , দলের আনুগত্য , নিয়মানুবর্তিতা প্রভৃতি শিক্ষা করত, তেমনই ল্মফ দেওয়া , ঝাঁপ দেওয়ার জন্য তাদের শারীরিক ব্যায়াম হতো। এই খেলা পুনরায় চালু হলে বেশ হয়।

আরো একটি খেলা ছিল যা এখন আর খেলা হয় না। সেখানে নায়ক হল বাঘ। খেলাটা এরকম ছিল –
খেলার জন্য বাড়ির উঠোন কিংবা মাঠে একটি বড় বৃত্ত অাঁকা হতো। একজন খেলোয়াড় এই বৃত্তের বাইরে থাকত, সে হতো বাঘ। আর অন্যরা বৃত্তের ভেতরে থাকতো এবং তারা হতো ছাগল। বাঘ বৃত্তের চারপাশে ঘুরে বেড়াতো আর ছড়া কেটে কেটে ভেতরে অবস্থানকারীদের ভোলানোর চেষ্টা করতো। তখন বাঘ আর ছাগলের মাঝে এই ছড়াটি কাটা হয়:
বাঘ (ক্রন্দনের সুরে) – অ্যাঙ্গা অ্যাঙ্গা
ছাগদল (সমস্বরে) – কাঁদো ক্যা?
গরু হারাইছে
কি গরু?
নাঙ্গা গরু।
শিঙ্গি কি?
কুষ্টার অাঁশ।
একটা গান গাও।
বাঘ তখন নাচের ভঙ্গিতে ঘুরে ঘুরে গান গায়:
এতি চোর বেতি চোর,
এতি চোর বেতি চোর,
চলে আয় আমার সিয়ানা চোর।
গান শেষ করেই বাঘ লাফ দিয়ে বৃত্ত থেকে একটা ছাগল ধরে টানতে থাকত, অন্যরা তখন বাধা দিত। বাঘ তাকে বৃত্তের বাইরে নিতে পারলে সে বাঘের দলভুক্ত হতো শেষপর্যন্ত যে ঘরে থাকত, সে পরবর্তী খেলায় বাঘ হওয়ার সুযোগ পেত! তার মানে বাঘ হওয়াটাই মহত্ত্ব ছিল এই খেলায়।
আমি মনে করি, আমরা ভারতীয়রা অতীতের এক মহান সভ্যতার উত্তরাধিকারী , আমাদের শিক্ষা , দীক্ষা , রীতি , নীতি আচার, ব্যবহার কিছুই অপূর্ণ ছিল না। আমাদের ক্রীড়াদির মধ্যেও বালক এবং বালিকাগণের শরীর গঠন ও শিক্ষা লাভের উপকরণ যথেষ্ট ছিল।
লোকে বলে আধুনিক কিন্ডারগার্ডেন শিক্ষাই নাকি খেলার ছলে শিক্ষাদান এই প্রণালীর আবিষ্কার করেছে। যাঁরা এরূপ ভাবনা ভাবতে চান তাঁদের আমি বিরোধিতা করব না। তবে এটাই বলে রাখি যে , আমাদের সুবিশাল ভারতবর্ষে এখন বহু বহু খেলা ছিল যা শিশুদের সরল রেখা টানবার এবং সোজা সরল আল বাঁধার পদ্ধতি শিক্ষা প্রদান করত। সেদিকে যদি বর্তমান সমাজ একটু দৃষ্টি প্রদান করেন তবে বেশ ভালো হয়।

একটি খেলা আমরা ছোট বেলায় খেলে এসেছি , তার নাম হল #এইটিকে_ছোঁয়াছুঁয়ি। সেই খেলায় একটি মধ্যবিন্দু হতে সম সংখ্যক ও সমানভাবে দাঁড়ি টানতে হতো। সেই মধ্যবিন্দুতে একটি পয়সা বা ঘুটিং রাখতে হতো। তারপর যতগুলি দাঁড়ি ততো গুলির উপর ততজন বালক বা বালিকারা একসঙ্গে দাগ বুলাতে আরম্ভ করত। একতালে সকলকেই অঙ্গুলী চালনা করতে হতো। ধীরে ধীরে অঙ্গুলী দ্রুত চলত। রেখার গোড়া হতে মধ্যবিন্দু পর্যন্ত আঙ্গুল চালাতে হতো। অথচ মধ্যবিন্দুতে পয়সা বা সুপারি বা ঘুটিং – এ অঙ্গুলী ঠেকবে না। যার অঙ্গুলী ঠেকতো সেই হেরে যেত। সেই অস্পৃশ্য হয়ে তখন অন্যকে ছোঁবার চেষ্টা করত।
আর একটি খেলার নাম ছিল ” #থুক্_থুক্_দাঁড়ি” । বালি বা ধূলা দিয়ে একটি স্বল্প পরিসর দেড় কি দুই হাত লম্বা আল নিৰ্মাণ করতে হতো। একটি চার অঙ্গুলী পরিমিতকাঠি হাতে রেখে একজন দুই হাত সেই আলের এধার হতে ওধার উপরে নাড়া দিতে দিতে মুখে থুক্ থুক্ দাঁড়ি আবৃত্তি করত। এরূপ করবার সময় সে গোপনে কাঠিটি আলের মধ্যে লুকিয়ে রাখত। অন্যজন সেই কাঠিটি বার করবার জন্য ওই আলের একটি স্থান দুই হাত দিয়ে চেপে ধরত। যদি কাঠিটি সেই স্থান থেকে বার করতে পারত পারত তবে সে কাঠিটি লুকাতে পারবে আর না পারলে হেরে যেত। যে হারত , বিজেতা তার হাতে একমুঠো ধুলার মধ্যে সেই কাঠি দিয়ে দুহাতে তার চোখ চেপে ধরত এবং আলের উপর ধানভানার অনুকরণে তাকে চার পাঁচবার নাচিয়ে নানা স্থানে ঘুরিয়ে একটি গুপ্ত স্থানের সেই ধূলার মুঠোর সঙ্গে কাঠিটি ফেলতে বলত। তারপর পূর্ব স্থানে ফিরে এসে পরাজিতের চোখ খুলে দেওয়া হতো এবং জয়ী ঐ কাঠি পুনরায় খুঁজে আনতে বলত। পরাজিত যতক্ষণ কাঠি না খুঁজে আনত , ততক্ষণ সে পরিত্রাণ পেত না। যদি সে খুঁজে আনতে পারত তবে সে কাঠি লুকানোর অধিকারী হতো। ওই দাঁড়ি আলের মধ্যে হাত চালানোর সময় কারুর হাত বেঁকে গেলে সে খেলতে পারত না।

এইসব শিশুতোষ খেলার যেগুলো আমাদের শৈশবকে রঙীন করেছিলো। পূর্ব পর্বে উল্লিখিত কড়ি খেলার সময় ঠাকুমা একটা ছড়া কাটতেন। অতি বৃদ্ধ বয়সে এসেও সেই ছড়া তিনি ভুলে যাননি। রাত্রি বেলা ঠাকুমার কাছে শুলে উনি সেসব ছড়া শোনাতেন –
খুশুর খুশুর দুর্গা মাসুর
তিন তালিয়া মার কেলিয়া
কুমড়ার চাক ধাপ্পা দিয়া
হাতের কড়ি হাতে থাক।
এছাড়াও বলেছিলাম না আমাদের শৈশব তাও জীবন ঘনিষ্ট নানা খেলা খেলে কেটেছে –
রান্নাবাড়ি, পুতুল খেলা, বিয়ে বিয়ে এ ধারার অন্তর্গত। এ প্রসঙ্গে নিচের ছড়া-গানটি বিশেষভাবে উল্লেখ্য, এটি পুতুল খেলার সময় আগে গাওয়া হতো। ঠাকুমার কাছে এসব ছড়া শিখে ছিলাম । কুপি কি হ্যারিকেনের আলোয় ঝিঁ ঝিঁ ডাকা রাতে ঠাকুমার নিকট শোনা সেসব ছড়া গুলোর কথা যখন স্মৃতিতে আসে, তখন মনে হয় একটা এমন কিছু হোক যাতে আবার আমার শৈশবে ফিরে যাই আর ছড়া কেটে পুতুল খেলি –

লাউ মাচার তলে লো জোড়া পুতুল বিয়া
বাজনা বাজায় ঝুমুর ঝুমুর দেখে আসি গিয়া
আম কাঁঠালের পিঁড়িখানি ঝিমিক ঝিমিক করে
তারি মধ্যে বাপে খুড়ায় কন্যা দান করে।।
ক্রমশঃ
©দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ ১ ) বাংলার লৌকিক ক্রীড়ার সামাজিক উৎস
২) গৌড়বঙ্গ সংস্কৃতি