ঋষি শৌনক বলেছেন – 

বেদিতব্যং দৈবতং হি মন্ত্রে মন্ত্রে প্রযত্নতঃ।

দৈবতঞ্জো হি মন্ত্রাণাং তদর্থমধিগচ্ছতি।।

ন হি কশ্চিদবিজ্ঞায় যাথাতথ্যেন দৈবতম্।

লৌকিকানাং বৈদিকানাং কর্মাণাং ফলমশ্নুতে।।

যিনি সম্পদ প্রদান করেন সেই তেজোময় পরম ব্রহ্মশক্তিই হলেন দেবতা। তিনি সদা দীপ্তিময়। তাঁর নিকট কেবল আলো। যিনি সেই আলোক নিয়ে দ্যুলোক বা ভবঃলোকে থেকেও হৃদয়ের নিভৃতে বাস করেন তিনিই দেবতা। 

… দেবো দানাদ্বা দীপনাদ্বা দ্যোতনাদ্বা দ্যুস্থানো

ভবতীতি যা যো দেবঃ সা দেবতা…

যিনি ব্রহ্ম, তিনি আদ্যাশক্তি। যখন নিষ্ক্রিয়, তখন তাকে ব্রহ্ম বলি। পুরুষ বলি। যখন সৃষ্টি, স্থিতি, প্রলয় এসব করেন তাকে শক্তি বলি। প্রকৃতি বলি। পুরুষ আর প্রকৃতি। যিনি পুরুষ তিনি প্রকৃতি। আনন্দময় আর আনন্দময়ী।  পিতা আর জননী। যিনি জগৎরূপে আছেন- সর্বব্যাপী হয়ে তিনি মা। 

আচ্ছা তিনি কি কেবলই সম্পদ প্রদান করেন ? সম্পদ অর্থে কি কেবল ধন ? বুদ্ধি, জ্ঞান ,প্রজ্ঞা , বিদ্যা হতে বৃহৎ সম্পদ কি হতে পারে ? 

“বিদ্যা দদাতি বিনয়ং বিনয়াদ যাতি পাত্ৰতাম।

পাত্ৰতাদ্ ধন যদপ্নাতি ধনাদ্ ধৰ্মঃ ততঃ সুখম্”।

তাই সেই অমূল্য সম্পদ যিনি প্রদান করেন সেই পরম ব্রহ্মশক্তিকে আমাদের জানা এক ও একমাত্র প্রয়োজন। তাঁকে না জানলে এই অমৃতের জীবনটাই তো অধরা থেকে যাবে। 

আদ্যাশক্তি মহামায়া তিনিই বিদ্যা ও অবিদ্যা রূপে এই মায়ার সংসারে অবস্থান করেন। 

ত্রিধা চকার চাত্মানং স্বেচ্ছয়া প্রকৃতি স্বয়ং।

          মায়া বিদ্যা চ পরমেত্যেবং সা ত্রিবিধাঽভবৎ॥

          মায়া বিমোহিনী পুংসাং যা সংসার-প্রবর্তিকা।

          পরিস্পন্দানিশক্তি র্যা পুংসাং যা পরমা মতা।

          তত্ত্বজ্ঞানাত্মিকা চৈব সা সংসার-নিবর্তিকা॥

অর্থাৎ, আদ্যাশক্তি মহামায়া স্বয়ং স্বেচ্ছায় আপনাকে মায়া, বিদ্যা এবং পরমা এই ত্রিবিধরূপে বিভক্ত করেন। মায়া বিমোহিনী সংসার-প্রবর্তিকা শক্তি। যিনি পরিস্পন্দাদি ব্যাপার-বিধায়িনী চৈতন্যময়ী সঞ্জীবনী শক্তি তিনি পরমা। তত্ত্বজ্ঞানাত্মিকা সংসার-নিবর্তিকা শক্তি বিদ্যা।

মাতৃকাচক্রবিবেকের টীকায় শিবানন্দ মুনি লিখেছেন, বিমর্শশক্তিই ইদন্তা বা ইদংভাবের প্রাধান্যের সহিত যখন অবভাসিত হন তখন তাঁকে বলা হয় ‘মায়া’ এবং যখন অহন্তা বা অহংভাবের প্রাধান্যের সঙ্গে অবভাসিত হন তখন তাঁকে বলা হয় ‘বিদ্যা’। অবিদ্যারূপে তিনি জীবকে সংসারে বাঁধেন আর বিদ্যারূপে তার মুক্তিবিধান করেন।

অন্যতম প্রাচীন শাক্তশাস্ত্র শ্রীশ্রীচণ্ডীতেও আমরা এই তত্ত্বেরই উল্লেখ পাই-

  সা বিদ্যা পরমা মুক্তির্হেতুভূতা সনাতনী॥

বিদ্যা অর্থ ব্রহ্মজ্ঞান- 

বিদ্যা ব্রহ্মজ্ঞানলক্ষণা। 

আর ব্রহ্মজ্ঞানই মুক্তি- 

জ্ঞানং মোক্ষৈককারণম্। 

সেইজন্য, অপরোক্ষ ব্রহ্মজ্ঞানস্বরূপা বিদ্যাই মুক্তিদায়িনী।

দেবীর এই বিদ্যাস্বরূপতা বৈদান্তিক আচার্যগণও স্বীকার করেছেন। কেনোপনিষদোক্ত বহুশোভমানা উমা হৈমবতীর প্রসঙ্গে আচার্য শঙ্কর তাঁর ভাষ্যে বলেছেন- 

তস্যেন্দ্রেস্য যক্ষে ভক্তিং বুদ্ধা বিদ্যা উমারূপিণী প্রাদুর্ভূতা স্ত্রীরূপা।

অর্থাৎ, সেই পূজ্যরূপে ইন্দ্রের ভক্তি বুঝতে পেরে শোভনতমা স্ত্রীরূপিণী হিমাচল-নন্দিনী বিদ্যা উমা আবির্ভূতা হলেন।

সায়ণাচার্যের মতেও হিমবানপুত্রী দেবী উমা ব্রহ্মবিদ্যাস্বরূপিণী- হিমবৎপুত্র্যা গৌর্যা ব্রহ্মবিদ্যাভিমানিরূপত্বাৎ গৌরীবাচকো উমাশব্দো ব্রহ্মবিদ্যাং উপলক্ষয়তি। 

সুতরাং, মহাশক্তি যে একাধারে বিদ্যা এবং অবিদ্যা উভয়স্বরূপা তা নিয়ে সংশয় নেই। তবে এখানে উল্লেখ্য, দেবীর মায়া বিদ্যা ইত্যাদি স্বরূপের মধ্যে আত্যন্তিক কোনো ভেদ নেই। সাধনায় পরিতুষ্টা হয়ে পরব্রহ্মরূপিণী মায়াই বিদ্যারূপে সাধককে পাশমুক্ত করেন। সেজন্যই, সর্বচৈতন্যরূপা আদ্যা ভুবনেশ্বরী একাধারে প্রণবাত্মিকা এবং মায়াবীজরূপা। 

দেবী আদ্যাশক্তি , তিনি নাদব্রহ্ম বা শব্দব্রহ্ম। তিনিই বাগ বৈ ব্রহ্মা। তিনিই ত্রিধা , গুপ্তরূপিদেবী। তিনি সত্ত্বগুণাত্মিকা সরস্বতী, তিনি রজসগুনাত্মিকা লক্ষ্মী , তিনিই তামসগুনাত্মিকা মহাকালী।  তিনিই ধী , ঈশ্বরী, বেদগর্ভা , আর্যা, ব্রাহ্মী । তাই মহাকালী মহামায়ার ধ্যানে যে ভাব প্রস্ফুটিত হয়েছে , মহাসরস্বতীর ধ্যানেও সেই ভাব ও তত্ত্ব অনুস‍্যূত। তিনি অষ্ট তারিণী , সেই তারিণীর একরূপ দেবী সরস্বতী।  তন্ত্রসার বলছে – 

তারা চোগ্রা মহোগ্রা চ বজ্রকালী সরস্বতী।

কামেশ্বরী চ চামুণ্ডা ইত্যাষ্টৌ তারিণীগণাঃ।।

দেবী তন্ত্রের নীল সরস্বতী ।

 তারাদ্যা পঞ্চবর্ণেয়ং শ্রীমন্নীলসরস্বতী।

সর্বভাষাময়ী শুদ্ধা সর্বদেবৈর্নমস্কৃতা।।

তন্ত্রসারে বলা হয়েছে – 

নীলা চ বাকপ্রদা চেতি তেন নীলসরস্বতী।

তিনি সৌভাগ্য প্রদান করেন। 

মাতর্নীলসরস্বাত ! প্রণমতাং সৌভাগ্য সম্পৎপ্রদে।

শ্রীমৎ শঙ্করাচার্য নীল সরস্বতীর আরাধনা করেছেন। তিনিই যে আদ্যাশক্তি সে বিষয় এরপর কারো সন্দেহ থাকা উচিৎ নয়। তাঁর একটি নাম মহাশ্রী। তিনিই মহাবিদ্যা। তিনিই মহানীলসরস্বতী । কোথাও মহালীলসরস্বতী নামে উল্লিখিত হয়েছেন। তন্ত্রসার বলেন – 

লীলয়া বাকপ্রদা চেতি তেন লীলসরস্বতী।

তারাস্ত্ররহিতা ত্র‍্য‍র্ণা মহালীলসরস্বতী।।

প্রপঞ্চসার তন্ত্রের সপ্তম পটলে জপের কথা লেখা আছে। তার পূর্বে মাতৃকান্যাস। এই মাতৃকামন্ত্রের ঋষি হলেন – ব্রহ্মা , ছন্দঃ – গায়ত্রী এবং দেবতা – সরস্বতী। সরস্বতী ছয় অঙ্গ বর্ণমালার সমস্ত বর্ণ।

এই তন্ত্রে মাতৃকামূর্তি সরস্বতীর একটি ধ্যান আছে – 

পঞ্চাশদ্বর্ণভেদৈর্বিহিতবদনদোঃপাদযুক্কুক্ষিবক্ষো – 

দেশাং ভাস্বৎকপর্দাকলিতশশিকলামিন্দুকুন্দাবদাতাম্।

অক্ষস্রক্ককুম্ভচিন্তালিখিতবরকরাং ত্রীক্ষণাং পদ্মসংস্থা-

মচ্ছাককল্পামতুচ্ছস্তনজঘনভরাং ভারতীং তাং নমামি।

এই ধ্যানের দেবী পদ্মাসনা , ত্রিনয়না , ভাস্বদ্ মূর্তি। তিনি ইন্দু এবং কুন্দের ন্যায় শুভ্র এবং তাঁর অঙ্গ পঞ্চাশটি বর্ণে বিহিত। মস্তকের উপর কেশগুচ্ছ ও শশিকলা। দেবীর উপরের দক্ষিণ হস্তে অক্ষমালা বা জ্ঞানমুদ্রা, নীচের দক্ষিণ চিন্তা , উপরের বামহস্তে কুম্ভ, নীচের বামহস্তে পুস্তক। 

একাদশ পটলে প্রকৃতির স্তব আছে । তার পঞ্চম শ্লোকে তাঁকে সরস্বতী বলে সম্বোধন করা হয়েছে। এখানে তিনি লেখনী ধারণ করেন। 

সচিন্তাক্ষমালা সুধাকুম্ভলেখাধরা ত্রীক্ষণার্ধেন্দুরাজৎকপর্দা।

সুশুক্লাংশুকাকল্পদেহা সরস্বত্যপি ত্বন্ময়ৈবেশিবাচামধীশা।।

দেবী ভারতী অর্থাৎ সরস্বতীর নবশক্তি । তাঁরা হলেন – মেধা , প্রজ্ঞা, প্রভা, বিদ্যা, ধী, ধৃতি, স্মৃতি, বুদ্ধি, বিদ্যেশ্বরী।

সাধক সরস্বতী, তাঁর শক্তি ও আবরণ দেবতার পূজা করে থাকেন। পূজায় গন্ধ ,পুষ্প, দীপ, ধূপ ও অন্ন আবশ্যক। তাই সরস্বতী যাগের মূল উপাদানই হল চরু। 

ময়া সো অন্নমত্তি যো বিপশ্যতি যঃ প্রাণিতি য ঈং শৃণোত্যুক্তম্……..

যে অন্ন আহার করে, যে দর্শন করে, যে প্রাণ ধারণ করে,যে বাক্য শ্রবণ করে তারা আমার শক্তিতেই সে সব করে থাকে, ঈদৃশী যারা আমাকে জানে না তারা ক্ষীণতা প্রাপ্ত হয় ! 

তন্ত্রে অক্ষরের মূর্তি আছে। স্বরবর্ণের কেশব , নারায়নাদি ১৬ টি বৈষ্ণব মূর্তি। এই ১৬ মূর্তির ১৬ শক্তি। তন্মধ্যে সরস্বতী হলেন  সংকর্ষণের শক্তি।  নারদপঞ্চরাত্রাগমের তৃতীয় রাত্রির প্রথম অধ্যায়ের দ্বাদশ সংখ্যক বৈষ্ণব মূর্তি সংকর্ষণের শক্তি সরস্বতী বলিয়া উল্লিখিত। ব্যঞ্জনবর্ণে রুদ্রমাতৃকা , মহাকালী, সরস্বতী, সর্বসিদ্ধি, গৌরী, ভদ্রকালী প্রভৃতি ৩৫ টি মূর্তি।

প্রপঞ্চসারের ২৩ অধ্যায়ের ২৪ শ্লোকে আছে –

 দংস্ট্রায়াং বসুধা সশৈলনগরারণ্যাপগা হুংকৃতৌ বাগীশী…। 

রসাতলে যাওয়া পৃথ্বীকে উদ্ধার করবার নিমিত্ত বিষ্ণু  বরাহ অবতার গ্রহণ করেন। বরাহবতারের দংস্ট্রায় পৃথ্বী ছিলেন এবং তাঁর সেই সময় প্রচন্ড যে হুংকার নির্গত হয়েছিল সেই হুংকারে শব্দব্রহ্ম রূপে দেবী সরস্বতী অবস্থান করেছিলেন। 

দেবী আদ্যাশক্তি মহামায়ার পূজা বহুপ্রকারে হয়ে থাকে। বয়স অনুসারে দেবী পূজা যখন হয় তখন তিনি ভিন্ন ভিন্ন নামে অভিহিত হন। এক বৎসর কন্যা দেবী সন্ধ্যা , দুই বৎসর কন্যা হলেন দেবী সরস্বতী , সাত বৎসর কন্যা হলেন চন্ডিকা, আট বৎসর কন্যা দেবী সম্ভাবি ইত্যাদি। 

আদ্যাশক্তির মহামায়ার অনন্ত রূপের মধ্যে সৃষ্টি স্থিতি এবং লয়ের অধিষ্ঠাত্রী হিসেবে পূজিত সরস্বতী, লক্ষ্মী এবং কালী। এ সকল প্রধান রূপ থেকেই মনসা দেবী অভিন্ন। তাই মনসাদেবীর দ্বাদশাক্ষর বীজযন্ত্রে দেবীদুর্গা, লক্ষ্মী, কালী এবং সরস্বতী এ সকলেরই অধিষ্ঠান দেখা যায়। এ কল্পতরু স্বরূপ বীজমন্ত্রটি হল: “ওঁ হ্রীং শ্রীং ক্লীং ঐং মনসাদেব্যৈ স্বাহা।” তাই কেউ দেবীকে সদা চিন্তন করেও মুক্তিলাভ করতে পারে। তিনি ব্রহ্মস্বরূপিনী কুলকুণ্ডলিনী শক্তি। নাগ তাঁর গায়ের যজ্ঞোপবীত। নাগের সাথে যোগের এবং যোগীর নিকট সম্পর্ক। তাই শিবের গায়েও নাগের যজ্ঞোপবীত দেখা যায়। নাগ গুহাবাসী, শীতের কয়েকটি মাস, শুধু বায়ু ভক্ষণ করেই বা সামনে যা খাবার আসে তাই ভক্ষণ করে অযাচক বৃত্তিতে তাই গ্রহণ করে বেঁচে থাকে। এমন আচরণ পর্বত গুহাতে বসবাসকারী একজন যোগীর জীবনেও দেখা যায়। তাই রঘুনন্দন ভট্টাচার্য তাঁর ‘অষ্টাবিংশতিতত্ত্ব’ নামক সুবিখ্যাত গ্রন্থে পদ্মপুরাণোক্ত দেবী মনসার একটি ধ্যানমন্ত্রে উদ্ধৃত করেছেন। সে ধ্যানমন্ত্রটি আজও বহুল ব্যবহৃত দেবীর পূজায়। ধ্যানমন্ত্রটিকে দেবীকে যায়, ‘কামরূপাস্’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। মহাযোগিনী দেবী কামেশ্বরী রূপে প্রত্যকটি জীবকে নাগরূপা কুলকুণ্ডলিনী শক্তি দ্বারা জীবের কামনা বাসনা থেকে যুক্ত করেন।

দেবীমম্বামহীনাং শশধরবদনাং চারুকান্তিং বদন্যাং হংসারূঢ়ামুদারাযরুণিতবসনাং সর্বদাং সর্বদৈব। স্মেরাস্যাং মণ্ডিতাঙ্গীং কণকমণিগণৈনাগরত্নৈ- বন্দেহং সাষ্টনাগামুরুকু চযুগলাং ভোগিনীং কামরূপাম্।।

“সর্পকুলের জননী, চন্দ্রবদনা, সুন্দর কান্তি বিশিষ্টা, বদন্যতাগুণসম্পন না, হংসবাহিনী, উদার স্বভাবা, রক্তবস্ত্র পরিহিতা, সর্বদা অভিষ্ট প্রদায়িনী, সহাস্য বদনা, কণকমনি এবং নাগশ্রেষ্ঠগণের দ্বারা ভূষিতাঙ্গী,অষ্টনাগ পরিবৃতা, উন্নত কুচযুগল শোভিতা, ভোগিনী, কামরূপা দেবীকে সদা বন্দনা করি।”

আবার দেখুন 

আ নো যজ্ঞং ভারতী তূরমেতু ইড়ামনুন্বদিহ চেতয়ন্তী।

তিস্রো দেবীর্বর্হিরেদং স্যোনং সরস্বতী স্বপসঃ সদস্তু।।

দেবী ভারতী শীঘ্র আমাদের যঞ্জে আগমন করুন। যেমন মনুষ্য আগমন করেন , তেমনি হে দেবী ইড়া আগমন করুন। ঋগ্বেদে সরস্বতী সুক্ত ব্যতীত আরো ৪০ টি মন্ত্রে  দেবী সরস্বতীর স্তুতি আছে। সেখানে দেবী সরস্বতী ইড়া ও ভারতী নামেও অভিহিত হয়েছেন। তিনি ত্রয়ী , অগ্নির শিখা। 

ইড়াদিশব্দাভিধেয়াঃ বহ্নি – মর্তয়স্তিস্রঃ…

সেই অখন্ড জম্বুদ্বীপ তথা ভারতের দেবী ব্রহ্মময়ী মা সরস্বতী , যাঁর তীরে গড়ে উঠেছিল এক সুসভ্য সভ্যতা তিনি আজও আমাদের নিকট পূজিতা। মা ব্রহ্মময়ী নানা সময় নানা রূপ ধারণ করেছেন এবং বৈদিক হতে লৌকিক নানা উপায় তিনি পূজিতা হয়ে আসছেন। 

তিনি একক , তিনি মহেশ্বর ,ব্রহ্মা , বিষ্ণুর প্রত্যেকের সঙ্গে ত্রিধা হয়ে অবস্থান করেন। তিনি শ্বেতপদ্মাসনা। 

পদ্মং লক্ষ্ম‍্য্য সরস্বত্যা ওঁ কারঞ্চ ত্রিবর্ণকম্…

জ্ঞানের অধিষ্ঠাত্রী দেবী সরস্বতীর বাহন রাজহংস। কারণ হাঁস অসারকে ফেলে সার গ্রহণ করে। দুধ ও জলের মিশ্রণ থেকে জল ফেলে শুধু দুধটুকু গ্রহণ করে কিংবা কাদায় মিশ্রিত স্থান থেকে তার খাদ্য খুঁজে নিতে পারে। মায়ের সঙ্গে পূজিত হয়ে শিক্ষা দিচ্ছে, সবাই যেন অসার/ ভেজাল/ অকল্যাণকরকে পরিহার করে নিত্য পরমাত্মাকে গ্রহণ করে এবং পারমার্থিক জ্ঞান অর্জন করতে পারে।

বীণার জীবন ছন্দময়। বীণার ঝংকারে উঠে আসে ধ্বনি বা নাদ। বিদ্যার দেবী সরস্বতীর ভক্তরা সাধনার দ্বারা সিদ্ধিলাভ করলে বীণার ধ্বনি শুনতে পায়। বীণার সুর অত্যন্ত মধুর। তাই বিদ্যার্থীদেরও মুখ নিঃসৃত বাক্যও যেন মধুর ও সঙ্গীতময় হয়। সেই কারণেই মায়ের হাতে বীণা। তাই দেবী সরস্বতীর আরেক নাম ‘বীণাপাণি’।

বিদ্যার্থীদের লক্ষ্য জ্ঞান অন্বেষণ। আর জ্ঞান ও বিদ্যার অন্বেষণের জন্য জ্ঞানের ভান্ডার ‘বেদ’ তার হাতে রয়েছে। সেই বেদই বিদ্যা। তিনি আমাদের আশীর্বাদ করছেন আমাদের জীবনকে শুভ্র ও পবিত্র করতে।

দেবী মনসা তিনি বিষহরণ করে প্রাণদান করছেন। তাঁর ধ্যান মন্ত্রে বারংবার তাঁকে জ্ঞান প্রদায়িনী বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি মহাজ্ঞানযুক্তা, জ্ঞানিদের প্রধানা, শ্রেষ্ঠা, সিদ্ধগণের অধিষ্ঠাতৃদেবী, সিদ্ধিস্বরূপিনী এবং সিদ্ধিদায়িনী। তিনি শ্বেতরাজহংসারূঢ়া হয়ে পদ্মাসনে আসীন। তিনি কি করছেন? তিনি বিষ হরণ করছেন। তিনি কোন বিষ হরণ করছেন ? সর্প বিষ ! নাকি অজ্ঞানতার বিষ! আমাদের দেহের লোভ, লালসার বিষ। বিষ হরণ করে তিনি অজ্ঞানতার অবিদ্যা রূপী মায়ার অন্ধকার থেকে মুক্তকে বিদ্যা রূপী মহামায়ার দিকে নিয়ে যান। 

দেখুন দেবীভাগবতে বলছেন – 

ত্রিযুগঞ্চ তপস্তপ্তা কৃষ্ণস্য পরমাত্মনঃ। সিদ্ধা বভূব সা দেবী দদর্শ পুরতঃ প্রভুম্ ।। দৃষ্টা কৃশাঙ্গীং বালাঞ্চ কৃপয়া চ কৃপানিধিঃ । পূজাঞ্চ কারয়ামাস চকার চ স্বয়ং হরিঃ ।। বরঞ্চ প্রদদৌ তস্যৈ পূজিতা ত্বং ভবে ভব । বরং দত্তা চ কল্যাণ্যৈ ততশ্চান্তর্দধে হরিঃ ।। প্রথমে পূজিতা সা চ কৃষ্ণেন পরমাত্মনা । দ্বিতীয়ে শঙ্করেণৈব কশ্যপেণ সুরেণ চ । মুনিনা মনুনা চৈব নাগেন মানবাদিভিঃ। বভূব পূজিতা সা চ ত্রিষু লোকেষু সুব্ৰতা ।। (দেবীভাগবত: নবমস্কন্ধ, ৪৮. ১৯-২৩)

‘ দেবী মনসা পুষ্কর তীর্থে গমন করে তিন যুগ ধরে পরমাত্মা শ্রীকৃষ্ণের ধ্যান করে সিদ্ধ হলেন এবং ভগবান শ্রীকৃষ্ণের দর্শন পেলেন। কৃপানিধি শ্রীহরি সেই কৃশাঙ্গী বালিকাকে দেখে, স্বয়ং নিজে পূজা করলেন ও অন্য সকলের দ্বারা পূজা করাইলেন। ভগবান হরি এরপর সেই বালিকাকে ‘তুমি ত্রিজগতে পূজ্যা হও’ বলে আশীর্বাদ করে অন্তর্হিত হলেন। পরমাত্মা শ্রীকৃষ্ণ, প্রথমে মা মনসার পূজা করলেন। এরপর মহাদেব ও কশ্যপ মুনি মা মনসার পূজা করলেন। ক্রমে ক্রমে মুনি, মনু, নাগ এবং মানব প্রভৃতি ত্রিলোকবাসী লোকজন সেই দেবীর নিষ্ঠার সাথে পূজা করতে লাগলেন।

 দেবাদিদেব মহাদেব মনসা দেবীকে দিব্যজ্ঞান প্রদান করে সামবেদ অধ্যয়ন করিয়ে শ্রীকৃষ্ণের উপাসনা করতে নির্দেশ দেন। সে নির্দেশনা অনুসরণ করে দেবী মনসা পুষ্কর তীর্থে গিয়ে তিন যুগ ধরে শ্রীকৃষ্ণের অষ্টাক্ষর যন্ত্র জপ করেন। দেবীর আরাধনায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ প্রসন্ন হয়ে তাঁকে দর্শন দেন। আমরা ঈশ্বরকে যতই আলাদা স্বরূপে উপাসনা করি, সে সকল উপাসনা একই ঈশ্বরের কাছেই পৌঁছে যায়। শুধু হৃদয়ে ভক্তি থাকলেই যথেষ্ট। পৌরাণিক কাহিনী মধ্যে অনেক রূপক গল্প আছে, এ গল্পগুলো সত্য নাও হতে পারে, কিন্তু এর অন্তর্নিহিত অর্থটি সত্য। রূপকের আবরণে মোড়ানো থাকে বলে আমরা অনেক সময়েই ধরতে পারি না। দেবীভাগবতের এ নবম স্কন্ধের মনসাদেবীর কাহিনীর সাথে কথাগুলো শতভাগ সত্য। আমরা এ পৌরাণিক আখ্যানটিতে দেখি, দেবী প্রথমে কৈলাশ পর্বতে গিয়ে দেবাদিদেব মহাদেবের আরাধনা করলেন; তাঁর আরাধনায় তুষ্ট হয়ে শিব তাঁকে দর্শন দিলেন। তিনি দেবী মনসাকে এরপরে নির্দেশ দিলেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আরাধনা করতে। দেবাদিদেব শিবের নির্দেশে দেবী পুষ্কর তীর্থে গিয়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আরাধনা করলেন এবং তাঁর দর্শন পেলেন।এ আখ্যানটিতে সবচেয়ে মজার বিষয় হল, মনসাদেবী যাদের নিষ্ঠার সাথে উপাসনা করেছেন, সেই মহাদেব এবং শ্রীকৃষ্ণই মনসাদেবীকে দর্শন দিয়ে তাঁর পূজা করলেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণই মনসাদেবীর পূজা প্রবর্তন করেন। পৌরাণিক কাহিনীটিতে আমরা দেখছি, ভগবান শিব এবং কৃষ্ণকে যেমন দেবী মনসা আরাধনা করেছেন; তেমনিভাবে ভগবান শিব এবং শ্রীকৃষ্ণও দেবী মনসার আরাধনা করেছে। অর্থাৎ ভক্ত হয়ে যিনি আরাধনা করেছেন, তিনিই আবার পরক্ষণে তাঁর ইষ্টদ্বারা আরাধিত হয়েছেন। এ ঘটনাগুলো আমাদের একটি বিষয় উপলব্ধি হয় এবং শিক্ষা দেয় যে; স্রষ্টা ভিন্ন রূপে আরাধিত হলেও, আদতে তিনি এক এবং অদ্বিতীয়।

ভগবান শ্রীকৃষ্ণ প্রথম দেবী মনসার পূজা করলেন। এরপর ভগবান শিব ও কশ্যপ মুনি দেবী মনসার পূজা করেন। এর ধারাবাহিকতায় ক্রমে ক্রমে মুনি, মনু, নাগ এবং মানব প্রভৃতি ত্রিলোকবাসী লোকজন দেবী মনসার পূজা নিষ্ঠার সাথে করতে লাগলেন।

প্রপঞ্চসারে বলা হয়েছে – 

মেধা প্রজ্ঞা প্রভা বিদ্যাধির্ধৃস্মৃতিবুদ্ধয়ঃ।

বিদ্যেশ্বরীতি সংপ্রোক্তা ভারত্যা নব শক্তয়ঃ।

এনারা সকলেই মাতৃকা, সকলেই সাক্ষাৎ মহাবিদ্যা। মাতৃকা দেবীর পূজা বহু প্রকারে হয়ে হয়ে থাকে একথা পূর্বেই বলেছি। সুপ্রাচীন এক তন্ত্র , নাম মালিনীবিজয়তন্ত্র। সেই সুপ্রাচীন তন্ত্রে কয়েকজন পূর্ণফলপ্রদা মহাবিদ্যার নাম উল্লেখ করা হয়েছে। তন্মধ্যে বাসলী বাগবাদিনী নামও আছে। এই তন্ত্র হতে ক্ষেমরাজ অতি প্রাচীন বচন বলে শ্লোক উদ্ধার করেছেন। ক্ষেমরাজ অভিনবগুপ্তের শিষ্য। এতে বর্ণিত মহাবিদ্যার নাম এইরূপ: 

অথ বক্ষ‍্যাম্যহং যা যা মহাবিদ্যা মহীতলে।

দোষজালৈরসংস্পৃষ্টাক্তা সর্বাহি ফলৈঃ সহ।।

কালী নীলা মহাদুর্গা ত্বরিতা ছিন্নমস্তকা।

বাগবাদিনী চান্নপূর্ণা তথা প্রত্যজিরা পুনঃ।।

কামাখ্যা বাসলী বালা মাতঙ্গী শৈলবাসিনী।

ইত্যাদ্যাঃ সকলা বিদ্যাঃ কলৌ পূর্ণফলপ্রদাঃ।।

এই বাসলী তন্ত্রসম্মতা মহাবিদ্যা। বাসলী বাগেশ্বরী শব্দের রূপান্তর । বাগীশ্বরী – বাইসরী- বাসরী- বাসলী। এই শব্দ হাজার হাজার বৎসর পূর্বে তন্ত্রশাস্ত্রে স্থান পেয়েছে। কেমন করে এই বাসলী তন্ত্রে প্রবেশ করে তা জানা যায় না। তবে সম্ভবতঃ বাগীশ্বরী শনৈঃ শনৈঃ বাসলীতে পরিণত হয়ে থাকবেন ।  বাসলী দেবী সরস্বতী তা মনে করবার কিছু কারণও আছে। 

প্রসঙ্গত জৈন প্রাকৃতে বাইসরী ” বাএসরী” হয়েছে। তপগচ্ছীয় শ্রাবকপ্রতিক্রমণান্তর্গত ” কল্যাণকংদং” স্তুতির শেষ বা চতুর্থ গাথায় এই “বাএসরী” পদটি প্রাপ্ত হয় । গাথাটি হল – 

কুন্দিন্দু গোকখীর- তুসারবন্না

সরোজহথ্থা কমলে নিসন্না

বাএসরী পুথ্থয়বগগহথা

সুহায় সা অমৃহসয়াপসখা।।

সংস্কৃতে এই শ্লোকটি হল – 

কুন্দেন্দুগোক্ষীরতুষারবর্ণা

সরোজহস্তা কমলে নিষন্না

বাগীশ্বরী পুস্তকবর্গহস্তা

সুখায় সা নঃ সদা প্রশস্তা।।

দেবী সরস্বতী বাগীশ্বরীই বাসলী। এই দেবীকে তো চণ্ডীদাস উপাসনা করতেন। তাঁর বাসলী দেবী ছিলেন সাক্ষাৎ চতুর্ভুজা সরস্বতী মূর্তি। বীরভূমের নানুরে অলিখিত ভাবে আজও তিনি কুলদেবী। বাঁকুড়ার বেলেতোড়ে আর একটি চতুর্ভুজা দেবী সরস্বতী ” বাসলী ” মূর্তি আছে। আরও নানা স্থানে দেবী বাসলীর মূর্তি দেখা যায়। 

 বিষ্ণুপাদমন্দিরের প্রধান চত্বরে প্রবেশের জন্য দ্বিতীয় স্তরে যে দ্বার আছে  এবং যেখানে ফুল ,জল, নৈবেদ্য বিক্রি হয় , সেই দ্বারে দক্ষিণ দিকের প্রাচীরগাত্রে এক কুলুজীতে অতি প্রাচীন প্রস্তর খোদিত দেবী সরস্বতীর মূর্তি আছে। সেখানে তিনি চতুর্ভুজা , বীণাপুস্তকহস্তা স্মিতবদনা। দেবী সেখানে বাসিরী ( বাগীশ্বরী) নামে প্রসিদ্ধা। 

নানুরের বাসলী মাতৃকা দেবী । ইনিও সরস্বতী মূর্তি । নানুরের বাসলী দেবীর নিকটে শারদীয়া পূজার সপ্তমীর দিন হতে বলির ব্যবস্থা আছে নবমীর দিন পর্যন্ত ছাগ, মহিষ এবং একটি মেষর বলি দেবার বিধি আছে। এছাড়া অন্য সময়ও লোকে বলি মানসিক করে যায় । সময় মত বলি এনে পুরোহিত দ্বারা নিবেদন করা হয়। এই দেবীর নবপত্রিকা স্নানের সময় হাঁড়ি পথে দেবীর উদ্দেশ্যে একটি শুকর উৎসর্গ করে। বাসলী বা বাগীশ্বরীই মনসা।ডক্টর সুকুমার সেন এই ঐক্যের কথা বলেছেন। বাসলী অনেক স্থানেই সিংহারূঢ়া দেবী সরস্বতী , অনেক স্থানে ষোড়শী চণ্ডী। সুধীভূষণ ভট্টাচার্যের মতে তন্ত্রের সরস্বতীই হলেন বাসলী , তিনিই মঙ্গলচণ্ডী। তিনি মহাকালী। মহাকালী নাগহস্তা ও নাগযজ্ঞোপবীতিনী।

জৈনদের ধ্যানমন্ত্রে মহাকালীকে বলা হয়েছে , ” বরদ পাশাধিন্ঠিত দক্ষিণভূজাং নাগাঙ্কশান্বিত বামকরাম।” তাঁর হস্তে নাগাঙ্কুশ।মার্কণ্ডেয় পুরাণের দেবীমাহাত্ম্য অংশে পাওয়া যায় আদ্যাশক্তি মহামায়া স্বাত্তিকরূপে সরস্বতী এবং তামসিক রূপে মহাকালী। তিনিই প্রলয়কালে মহাকালী , সৃজনকালে মহালক্ষ্মী এবং বিকাশকালে মহাসরস্বতীরূপে অবতীর্ণা হন। দেবী সরস্বতীর হস্তে থাকে অক্ষমালা , অঙ্কুশ, বীণা এবং পুস্তক।

অনুমান করা যায় , নাগ নিয়ন্ত্রণকারী অঙ্কুশ এখানে নাগের অধিষ্ঠাত্রীদেবীর পরিচায়ক। তিনি নাগভয়হারিণী নাগদমনকারিণী। নাগ এখানে হস্তী। নাগ হস্তীর প্রয়োগ আসাম অঞ্চলে প্রাপ্ত একটি মূর্তির মধ্যে দেখা যায়। দেবী সেখানে নাগেন্দ্র বাহিনী। আসামের শিলাঘাট থেকে পাওয়া একটি মূর্তিতে দেবী হস্তীর উপর আসীন। সাধারণভাবে নাগেন্দ্র শব্দটি বিশালাকার একটি সর্পকে বোঝায়, কিন্তু এখানে তা হয় নি। বিক্রমপুর অঞ্চল থেকে প্রাপ্ত একটি মূর্তির কথা নলিনীকান্ত ভট্টশালী বলেছেন। মূর্তিটি মহামায়ার মূর্তি। এর নিম্নাংশ লিঙ্গমূর্তির উপর স্থাপিত এবং উর্ধাংশ একটি ধ্যান নিরত দেবী মূর্তি। তাঁর হস্তে বেদ এবং অক্ষমালা। দেবী হস্তধৃত পুস্তক এবং অক্ষমালা বিদ্যার দেবীকেই ইঙ্গিত করে। 

তন্ত্রসার গ্রন্থে মা বাসলী বা বাশুলী তাঁর ধ্যানমন্ত্রে এভাবে বর্ণিত:

মা তপ্তকাঞ্চনবর্ণা, দ্বিভুজা, উগ্ররূপা, খড়্গ ও খেটকহস্তা, রক্তবসনা, মুণ্ডমালাবিভূষিতা। জটামুকুটশোভিত মা শবের ওপরে অবস্থান করেন।

এছাড়া ধর্মপূজাবিধানে মা বাসলীর বন্দনার নির্দেশ আছে, সেখানে মা এই প্রণাম মন্ত্রে বন্দিত:

বিশালবদনা দেবী বিশালনয়নোজ্জ্বলে।

দৈত্যমাংসস্পৃহে দেবী বিশালাক্ষী নমোহস্তুতে। মায়ের ধ্যানমন্ত্র অবশ্য ধর্মপূজা বিধানে যা পাই, তা তন্ত্রসার থেকে ভিন্ন। ধর্মপূজাবিধানে মা সিঁদুরবর্ণা, বিকটদন্তা, মুণ্ডমালিনী, হাস্যমুখরা, খড়্গহস্তা, রক্তপানরতা, মায়ের পায়ে নূপুরমঞ্জরী। মা বাশুলীর সঙ্গে মঙ্গলচণ্ডিকার অভিন্নতাও ঘোষিত হয়েছে এই ধ্যানমন্ত্রে।

 রাঢ়ভূমির সর্বত্র যদিও বাশুলী পূজিত হয়েছেন, বস্তুত তিনিই রাঢ়অধিষ্ঠাত্রী দেবী, কিন্তু তাঁর উপাসনার উৎস ও ব্যাপকতা সম্ভবত প্রাচীন সুহ্ম, বর্তমানের হুগলি জেলায় সূচিত। মা বাশুলীর মূর্তির বিভিন্নতা লক্ষণীয়। তা মায়ের পূজার প্রাচীনত্ব এবং মায়ের আদি পূজা নানা রূপে প্রচারিত হওয়ার দিকে ইঙ্গিত করছে। তা ইঙ্গিত করে যে বাশুলী আদিতে সর্বময়ী জগজ্জননী প্রকৃতিমাতৃকা হিসেবে উপাস্য ছিলেন বলেই তাঁর নানা রূপভেদ আছে।

হুগলির সিনেট অঞ্চলে বিশালাক্ষী ও বিষলক্ষ্মী/বিষহরি মনসা দুই ভগ্নীরূপে পূজিত হন, অতএব মা সত্যই সর্বময়ী। তিনি সরস্বতী, তিনি চণ্ডী, তিনি কালী, তিনিই মনসা।

ক্রমশঃ

©দুর্গেশনন্দিনী

তথ্যঋণ স্বীকার : ১. ঋগ্বেদ্

২. মার্কণ্ডেয় পুরান

৩. শ্রী শ্রী চণ্ডী

৪. সরস্বতী তত্ত্ব

৫. সরস্বতী সভ্যতার ইতিহাস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.