ভূজের মরুতে হিংলাজ মাতার সন্ধানে : প্রথম পর্ব : – গিরিতীর্থ হিংলাজ

জীবন – মৃত্যু – জরায় 

আজ এ ধরণী ভরায় । 

আজ কাঁপিছে আমার বাক্য

 যদিও নহি আমি , ঋষি – শাক্য ! 

ওগো ভগবান করো হে মোরে , 

তোমার হীরকোজ্জ্বল 

অন্তর দাস । 

ঘুচাইতে পুঞ্জীভূত কালিমা——-

 মিশাইবো মম জীবন , 

চলে যাবে কণা – অণু ধূলিমা ।

 জনমিবে নব নব বৃক্ষ তব – পারিজাত কাননে মরুতীর্থ – পথিকের জীবজল জুটিবে , 

আহা , বড় সম্মানে….

ভুজ থেকে ৯০ কিলোমিটার দূরে মাতানোরমঢ়ের হিংলাজ মাতার মন্দির। কিন্তু সিন্ধ ও বেলুচিস্তানের যেখানে হিংলাজ মায়ের অবস্থান তিনি ভুজের ৯০ কিলোমিটার দূরে অধিষ্ঠিতা হলেন কি করে? আজ সে গল্প বলি। 

ভারত আধ্যাত্মিক দেশ। ভারতের প্রতি কণায়, উৎসবে, ব্যসনে, রাষ্ট্রবিপ্লব, রাজদ্বারে যাI একান্তভাবে মানুষের সঙ্গের যুগযুগান্ত ধরে অবস্থান করেছিল তা হল আধ্যাত্মবাদ। রামায়ণ যুগ হোক বা মহাভারত অথবা মধ্যযুগের ভক্তিআন্দোলন বা আধুনিককালের স্বাধীনতা সংগ্রাম, অখণ্ড ভারতীয় মননে প্রতি মুহূর্তে আধ্যাত্মবাদ বিরাজ করেছে। সেই আধ্যাত্মবাদকে সোপান করে আসমুদ্রহিমালয় অবস্থিত কত শত তীর্থস্থান ,কত শত পীঠস্থানে মানুষের নিত্য আনাগোনা হয়। সুবিশাল ভারতীয় উপমহাদেশের বুকে ছড়িয়ে থাকা এমন বহু পীঠস্থানে মানুষের ইচ্ছে থাকলেও দেশভাগের পর থেকে যেতে পারেন না। যেমন- সারদা মন্দির, মার্কণ্ডেয় সূর্য মন্দির, ঝুলেলাল মন্দির ,মরুতীর্থ হিংলাজ ইত্যাদি। বর্তমান পাকিস্তানের করাচি থেকে লাসবেলার মরুপ্রান্তর ও সন্ত্রাসী মৌলবাদের দুর্গম পথ পেরিয়ে হিংলাজ মাতাকে দর্শন করার সৌভাগ্য আজও ৯৯% মানুষ অর্জন করতে পারেন না। তাই বলে কি মা সন্তানের ইচ্ছা অপূর্ণ রাখবেন? তিনি অন্য উপায়ে সকল মনোবাঞ্চা পূর্ণ করেছেন। 

আমার বড় পিসির নিজের একটি ছোট্ট লাইব্রেরি ছিল ছাদের চিলেকোঠার ঘরে। সেখানে ভ্রমণ, আধ্যাত্মিক ইত্যাদি বইয়ের সম্ভার ছিল বেশ লোভনীয়। মনে আছে এক গরমের ছুটিতে অবধূতের ” মরুতীর্থ হিংলাজ” গোগ্রাসে পড়ে শেষ করেছিলাম। গ্রীষ্মের ছুটির দুপুরের নিত্য সঙ্গী হয়ে উঠেছিল সেই বই। হিংলাজ প্রসঙ্গে ওনার অপূর্ব লেখনি আমাকে কল্পনাতেই মরুভূমি, উঠ, উত্তপ্ত বালি , তৃষ্ণার যন্ত্রণা পেরিয়ে নিয়ে গেছিল ব্রহ্মময়ী কোটি সূর্যতেজী হিংলাজ মাতার মন্দিরে। যেখানে মাতার ব্রহ্মতালুর তেজ আজও জাজ্বল্যমান হয়ে আছে। তবে সেখানে এই মানব দেহে হয়তো যাওয়া আমার এজন্মে আর সম্ভব হবে না। তবে এই ভারতে তা সম্ভব। কি করে ? বলছি…

এই তীর্থ-দেবতার ধরণীর মন্দির-প্রাঙ্গণে

যে পূজার পুষ্পাঞ্জলি সাজাইনু সযত্ন চয়নে

সায়াহ্নের শেষ আয়োজন; যে পূর্ণ প্রণামখানি

মোর সারা জীবনের অন্তরের অনির্বাণ বাণী

জ্বালায়ে রাখিয়া গেনু আরতির সন্ধ্যাদীপ-মুখে

সে আমার নিবেদন তোমাদের সবার সম্মুখে

হে মোর অতিথি যত।

কাথিয়াওয়াড়ের অন্তর্গত পার্বত্য পালিতানায় অবস্থিত সিদ্ধাচল পর্বত। সেখানে আছে অজস্র জৈন মন্দির। এই সিদ্ধাচলের নাম গিরিতীর্থ হিংলাজ। এই পর্বতের আরো ২১ টি নাম আছে। তার মধ্যে একটি বহুল প্রচলিত এবং বিখ্যাত নাম হল শত্রুঞ্জয়। এই নামে  পাহাড়ের পিছনে একটি নদীও আছে। পাহাড়ের উপর থেকে দাঁড়িয়ে দেখলে নীচে রুক্ষ ভূমির বুক চিরে নদী প্রবাহিত হয়ে চলেছে। সিদ্ধাচল জৈনদের নিকট পবিত্র তীর্থস্থান। ঠিক যেমন একসময় বঙ্গের রাঢ় অঞ্চল ( তেলকুপি, তাম্রলিপ্ত ) ছিল। 

নীচের ধর্মশালা থেকে পর্বতারোহন শুরু করতে হয়। উঠতে একটু কষ্ট হয়। সঙ্গে একটু কর্পূর থাকলে দেখবেন ওটা শুঁকে পাহাড়ে উঠতে কষ্ট কম হয়। শ্বাস টান ওঠে না। আমি এটা জানতাম না। আমাকে গুরুদোম্বরে এক মারোয়াড়ি বৃদ্ধা তাঁর থেকে কিছুটা কর্পূর দিয়ে এটা বলেছিলেন। তখন তো জানতাম না যে আমার ভিতরে কর্কট রোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে ! এত কষ্ট হয়েছিল ১৭০০০ ফুট উঁচুতে, আমার নাক দিয়ে রক্ত বেরিয়ে যায়। উনি তখন আমাকে শুশ্রূষা করেছিলেন। যাক গে, বেশি কষ্ট হলে পর্বতের বাঁকে বাঁকে কিছু প্রশস্ত স্থান আছে সেখানে বসে পড়তে পারেন। বেশ একটা প্রাচীন অনুভূতি হবে।

 

এসব বাঁকে উঠতে গিয়ে পাশেই পাহাড়ের গায়ে এক দেবীমূর্তি খোদাই করা মন্দির আছে। দেবী রক্তবস্ত্র পরিহিতা। দেবীর সামনে ধূপ দীপ জ্বলে, ফুল পাতা ছড়িয়ে ভক্তরা পুজো দেন। দেবীর মন্দির গাত্রে পাহাড় খোদিত গুজরাটি ভাষায় দেবীর পরিচয় লেখা। পড়তে না পারলে কোনো অসুবিধা নেই। স্থানটি দিয়ে বহু ভক্ত বিশেষত কাথিয়াওয়াড়ি ভক্তের সমাগম হয়। কত জন দেখবেন লাঠি ভর করে উপরে উঠতে উঠতে ধপাস করে বসে পড়েন। তাঁদের কাউকে জিজ্ঞাসা করলেই বলে দেবেন। হাঁপাতে হাঁপাতে জোর গলায় হয়তো বলবেন , ” হিংলাজ কি হাদো”।  হ্যাঁ ঠিক ধরেছেন। এটাই সেই হিংলাজ। ভগবতী হিংলাজ মাতার মন্দির। মরুতীর্থের হিংলাজ এখানে গিরিতীর্থের অধিষ্ঠাত্রী। ভারী গোল বাঁধল তো ? কি হবে এখন? দুই তীর্থ একটি কাথিয়াওয়াড়ের কাছে অন্যটি বালুচ। দূরত্ব অনেক। তবুও একই ব্রহ্মময়ী দুই থানেই অবস্থান করছেন কি করে ? হিংলাজে দেবীর ব্রহ্মরন্ধ্র পড়েছিল। সেখানে তিনি জ্বালামুখী হয়ে অবস্থান করছেন। কিন্তু এখানে কি ? 

তপোমগ্ন হিমাদ্রি ব্রহ্মরন্ধ্র ভেদ করি চুপে

বিপুল প্রাণের শিখা উচ্ছ্বসিল দেবদারুরূপে।

সূর্যের যে জ্যোতির্মন্ত্র তপস্বীর নিত্য-উচ্চারণ

অন্তরের অন্ধকারে, পারিল না করিতে ধারণ

সেই দীপ্ত রুদ্রবাণী– তপস্যার সৃষ্টিশক্তিবলে

সে বাণী ধরিল শ্যামকায়া; সবিতার সভাতলে

করিল সাবিত্রীগান;স্পন্দমান ছন্দের মর্মরে

ধরিত্রীর সামগাথা বিস্তারিল অনন্ত অম্বরে।

এর একটা পৌরাণিক কথন আছে। কাথিয়াওয়াড়ী যে কোনো ভক্তদের কাছে আপনি জিজ্ঞাসা করলে তাঁরা বলে দেবেন। – শুনবেন নাকি ? শুনুন তবে! অতি প্রাচীন কালে আজ যেখানে করাচি সেখানে একটি গভীর অরণ্য ছিল। সেখানে হিঙ্গল নামক এক ভয়ানক রাক্ষসের বাস ছিল। তার ভারী উপদ্রব ছিল। পশু , পক্ষী, মানব কেউই তাঁর হাত থেকে রক্ষা পেত না। ওই গহীন অরণ্য এবং ভয়াল রাক্ষসের হাত থেকে নিস্তার পেলে তবেই মরুতীর্থ যাত্রীরা সেই ব্রহ্মরন্ধ্র জ্বালামুখীর নিকট পৌঁছতে পারতেন। তবে যাওয়া বা আসার পথে প্রায় সকলেই ওই রাক্ষসের খাদ্য হতেন। একবার কাশ্মীর থেকে কাশ্যপ গোত্রীয় এক মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষি ওই স্থান অতিক্রম করে ব্রহ্মময়ীর কাছে যাচ্ছিলেন। রাক্ষস এসে সেই ঋষিকে আক্রমণ করল। ঋষি নির্ভয়ে দুর্গাসপ্তশতী উচ্চারণ করতে লাগলেন। ঋষির উদাত্ত কন্ঠে আবাহনে দেবী অম্বিকা সেই গহীন আঁধার অরণ্য মাঝে আবির্ভূতা হলেন। অরণ্যদেবীর ভয়াল রূপ ধারণকে মহাকালী হিঙ্গলকে বিনাশ করলেন। হিঙ্গল তাঁর রাক্ষস জীবনে বহুল পাপ করেও যখন দেখল দেবীর হাতে তাঁর নিধন হচ্ছে , তখন সে দেবীর নিকট বর প্রার্থনা করলে, ” হে মা অম্বিকা! তোমার হাতে নিধন হয়ে আজ আমার আত্মা উদ্ধার হল। তাই আমার কোনো অন্তিম কামনা নেই। তবে, একটি অনুরোধ – যেখানে নীল আকাশ, সোনার বালুকা আছে, যেখানে পর্বত ও নীল নদীর জলে স্নাত হয় , যেখানে কোনো হিংসা, দ্বেষ , লোভ, ক্রোধ নেই সেখানেও তুমি আমার নামে অধিষ্ঠাত্রী থেকো। ” দেবী হিঙ্গলের সেই বাসনা পূরণ করলেন। সেই হতে দেবী মরুতীর্থ এবং অহিংসার পুণ্যভূমি সিদ্ধাচলে অবস্থান করছেন। 

দেবীর মন্দির পেরিয়ে এবার আরও উচ্চের পথে পা বাড়ানো। নীচে থেকে অজস্র ভক্ত আসে। তাঁরা হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে চিৎকার করে ওঠে , “হিংলাজ মাতা কি হাদো ,কদে হাত মুকী চাদো।” অর্থাৎ, হিংলাজ চড়াই বড় দুর্গম, তাই কোমড়ে হাত রেখে চলো। হিংলাজ চড়াই অতিক্রম করে আরো উপরে উঠলে সিন্দুর চর্চিত বজরংবলী বসে আছেন। তাঁর থেকে পথ দুই ভাগ হয়ে গেছে। একটি গেছে উত্তরে, অন্যটি দক্ষিণে। উত্তরের যে সর্বোচ্চ শিখর সেখানে অঙ্গারেশ্বরের আস্তানা। সেই স্থান পার হয়ে আরও উচ্চ শিখরে উঠলে সিদ্ধাচলের যে অপরূপ রূপ তা অবর্ণনীয়। সে রূপ দেখলে মানবকূলের সিদ্ধিলাভ হবেই। তা যেমনই সুন্দর , তেমনই রমণীয় এবং পবিত্র। সিদ্ধাচল অজস্র ভক্তের অশ্রুসিক্ত পুণ্যভূমি। সুন্দর মন্দিরাদি শোভিত অলকাপুরী।

সিদ্ধাচলের মন্দির স্থাপত্য অপূর্ব।  মন্দিরের তোরণদ্বার অতিবড় নাস্তিকের হৃদয়েও ভক্তিরসে আপ্লুত হয়ে উঠবে। মন্দির স্থাপত্যের দিকে তাকালে দুটি চক্ষু বিস্ময় বিস্ফারিত হয়ে ওঠে। কি অসম্ভব কর্মকাণ্ড। একমাত্র কোনো বিশ্বকর্মা বা ময়দানব ব্যতীত এই অলকাপুরী এই ইন্দ্রপুরী রচনা করা অসম্ভব। মন্দিরের পর মন্দির। তারপর মন্দির। তারওপর মন্দির। আবার মন্দির। প্রথম যে মন্দিরটিতে প্রবেশ হয়, তা চৌমুখী মন্দির। সে মন্দির এত বিশাল ও উচ্চ যে , ৪০ কিলোমিটার দূরে হতে একে দেখা যায়। এরপর একে একে আছে কুমারপাল, বিমলাশাহ, শান্তিনাথ হয়ে আদিনাথের মন্দির। আছে জৈনদের অধিষ্ঠাত্রী দেবী চক্রেশ্বরীর মন্দির। আদিনাথ মন্দিরে বহু শ্বেতাম্বর সম্প্রদায়ের জিনন ভিক্ষুণী বসে ধ্যান করেন। তাঁরা পুণ্যতীর্থে পরিত্রাতারুপিণী দেবীমূর্তিন্যায় প্রতীয়মান হয়ে থাকেন।

ছবি : শ্ৰী অজয় কোনার

ক্রমশঃ

©দুর্গেশনন্দিনী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.